পত্রিকা-আলোচনা : সমাজে-মননে উপেক্ষা মানে শুধুই কি অবহেলা?

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে আলকাপের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশকালেও বেঁচে থাকা সেই আলকাপ কালের গতিতে হারিয়ে যেতে বসেছে। তার কারণ উপেক্ষা। লোকনাট্যের অনেক ধারাকেই যেমন উপেক্ষা করা হয়ে থাকে। 

পত্রিকা-আলোচনা : সমাজে-মননে উপেক্ষা মানে শুধুই কি অবহেলা?


সে ছোকরাকে রাখতে হবে মেয়েদের মতো লম্বা চুল। পরনে সর্বক্ষণ থাকবে ফ্রক। হাতে চাঁদির চুড়ি। তাকে ভুলে থাকতে হবে সে পুরুষ। মেয়েদের মতো চলন-বলন হতে হবে। সর্বদা মেয়েদের লক্ষ্য করে ভঙ্গিগুলো শিখতে হবে। আসরে তাকে তো শাড়ি-ব্লাউস পরানো হবেই। কিন্তু এভাবে থাকতে থাকতে খুব শিগগির সে বদলে যবে চেহারা ও মানসিকতায়।

সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একজায়গায় বলেছেন, ওস্তাদ বলেন, এ যেন কাঠ-খড়-মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ে রঙ মাখিয়ে চোখ এঁকে সাজ পরিয়ে পুজো। মনের ভেতর আছে এক মোহিনী নটী। তাকে পুরুষের শরীরে রূপ দিই। মাটি নরম না হলে যেমন প্রতিমা গড়া যায় না, তেমনি যে বয়সে দেহ কোমল থাকে, সেই বয়স না হলে চলে না। প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়। আমার এই পুতুলটার বেলাও তাই। ‘নামুতে বারো ওপরে বিশ’। তারপর বিসর্জন। কারণ আর ধরে রাখা যায় না ভেতরের পুরুষকে। সে ঠেলে বেরিয়ে আসে। গলা কর্কশ হয়ে যায়। কোমলতা নষ্ট হয়। তখন কেশ কাটো। চাদির চুড়ি খোলো। খড়-কাঠ-বাঁশের ঠাট বেরিয়ে পড়েছে। মায়ার খেলা শেষ।

আমরা সিরাজ সাহেবের বিভিন্ন লেখায় আলকাপ ও আলকাপের অন্দরের ছবি ফুটে উঠতে দেখেছি। শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদের খোশবাসপুর গ্রামে। তখনই তার পরিচয় ‘আলকাপ’ এই লোকনাটকের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে নিজেই একজন আলকাপ শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তাই নয়, রাতের পর রাত এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, এই অঞ্চল থেকে ওই অঞ্চল, এমনকি মাসের পর মাস এই দলের সঙ্গেই কাটিয়েছেন।

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে আলকাপের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশকালেও বেঁচে থাকা সেই আলকাপ কালের গতিতে হারিয়ে যেতে বসেছে। তার কারণ উপেক্ষা। লোকনাট্যের অনেক ধারাকেই যেমন উপেক্ষা করা হয়ে থাকে। সিরাজ সাহেব আমৃত্যু আলকাপের এক গুণমুগ্ধ বিদগ্ধ ব্যক্তি। আলকাপ এই লোককনাটকের ফর্ম নিয়ে তার অনেককালের গবেষণা। সেখানে তিনি পাশ্চাত্যের নাটকের ফর্ম-এর সঙ্গে কোথাও কোথাও মিলের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে আলকাপ দর্শকদের নাটক। আলকাপের শিল্পীরা সমাজজীবনের ভেতর থেকে, বীজ সংগ্রহ করে দর্শকের মধ্যে তার প্রাণ সঞ্চার করেছেন। তার মনে হয়েছে থার্ড থিয়েটারের যে ফর্ম তা আসলে আলকাপেরই নাট্যরীতি। তাঁর কথায়, “গ্রামের গাজনে নবান্নে পালাপার্বণে পুরুষানুক্রমে যে খুচরো নাটক বা তাৎক্ষণিক নাটক অভিনীত হয়ে এসেছে, যার বিষয়বস্তু সমকালীন গ্রামীণ কোনও ঘটনা এবং যে নাটককে বলা হয় ‘সঙ’, তাই তো আসলে পোস্টার ড্রামা। তবু গ্রামের ডিমভাজা শহরে সায়েবদের কাছে শেখা ওমলেট হয়ে ওঠে।”

মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে নির্মলেন্দু কুণ্ডু ও রাজকুমার ঘোষের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা’-র বইমেলা সংখ‌্যাটি আগেই হাতে পেয়েছি। এই চৈত্রের এক দুপুরে সেটা উল্টে-পাল্টে দেখছিলাম। তাদের পত্রিকার এই সংখ‌্যার বিষয়বস্তু ‘উপেক্ষিত’। সম্পাদকরা খুব খেদের সঙ্গেই বলেছেন, সমাদরের বিপরীতে স্থান করে নেয় আনাচার, অবহেলা আর উপেক্ষা। ...এক শ্রেণীর উত্তরণের সঙ্গে জুড়ে থাকে অন‌্য শ্রেণীর ক্রমিক অবনমন। তেমনই উপেক্ষিত আলকাপ সংস্কৃতি। 

পত্রিকার এই সংখ‌্যায় কৌশিক বড়ালের একটি দীর্ঘ নিবন্ধে সেই উপেক্ষিত আলকাপ লোকসংস্কৃতি নিয়ে তথ‌্যসমৃদ্ধ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। শস‌্য-শ‌্যমলা বঙ্গের আনাচে-কানাচে দৃশ‌্যমান হয় বিভিন্ন ধরনের লোকনাট‌্য। মধ‌্যবঙ্গের একটি বিশিষ্ট লোকনাট‌্য হল আলকাপ। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় আলকাপের সর্বাধিক সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হলেও উভয় বঙ্গের বিস্তৃর্ণ অঞ্স, এমনকী সীমান্তবর্তী বিহারেও কোনও কোনও এলাকায় এই নাট‌্যধারার প্রচলন রয়েছে। তবে এর উৎসভূমি মালদা। তা বীরভূমের উত্তরাংশ, মালদলের দক্ষিণাংশ, বিহারের সাঁওতাল পরগণা জেলার পূর্বাংশ এবং বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার পশ্চিমাংশে ছড়িয়ে পড়েছে।

এই ‘লুপ্তপ্রায়’ আলকাপ লোকনাট‌্য নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখাটি পত্রিকার এই সংখ‌্যার সম্পদ। শুধু তা-ই নয়, আমার মতে, উপেক্ষিত লোকনাট‌্যটি নিয়ে যারা আগামীদিনে আরও গবেষণা করবেন, তাদের কাছেও এটি একটি মূল‌্যবান রত্ন হিসাবে বিবেচিত হবে। 

শুধু আলকাপ লোকনাট‌্য কেন, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে আরও অনেক কিছুই উপেক্ষিত। তারমধে‌্য যেমন রয়েছে মূকাভিনয়, খনপালাকার, স্থাপত‌্যরীতি তেমনই আবার উপেক্ষিত লোক-সম্পর্ক, এমনকী ভৌগলিক অঞ্চলগত উপেক্ষা। এই সব বিষয়গুলি দুই সম্পাদক ১৮০ পৃষ্ঠার বইয়ের মধ্যে তুলে ধরছেন। বিষয়-বৈচিত্রের কারণে পত্রিকাটি অবশ‌্যই সংগ্রহযোগ‌্য। তবে সেই সঙ্গে এই গুরুতর প্রশ্নটাও উঠে গেল যে উপেক্ষিত মানেই কী অবহেলা? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া? কালের পরিবর্তন বা আম জনতার রুচির দোহাই দিয়ে ঐতিহ‌্যকে উপেক্ষার অর্থ যে ইতিহাস থেকে নিজেদেরই মুছে ফেলা, তা তো আমরা জানি। 

একটি ক্ষুদ্রপত্রিকা শুধু অ-নামীদের গল্প-কবিতায় সমৃদ্ধ বা ভারী ভারী ভাষণের আধার হবে, এমন কোনও মানে নেই। সেই প্রত‌্যাশা পূরণ করছে পত্রিকার কলকাতা বইমেলা সংখ‌্যাটি। তবে কয়েকটা ত্রুটির দিকে মন দিতে হবে। পত্রিকার অলঙ্করণ আরও আকর্ষণীয় করা যেত। তাতে লেখাগুলি হারিয়ে যেত না। অক্ষরগুলি এত ছোট যে বয়স্কদের বইটি পড়তে খুবই অসুবিধা হবে। তবে, এটাও ঠিক কাগজ-কালি ও ছাপার খরচ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে অল্প পৃষ্ঠায় অনেক বিষয় ধরতে গিয়ে হয়তো অক্ষর ছোট রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। যদি ক্ষুদ্রপত্রিকার যাত্রা অব‌্যহত রাখতে হয়, তবে অবশ‌্যই পাঠককে তাদের পাশে থাকতে হবে। 

আমাদের পদক্ষেপ - কলকাতা বইমেলা সংখ‌্যা

প্রচ্ছদ বিষয় : উপেক্ষিত

যুগ্ম-সম্পাদক : নির্মলেন্দু কুণ্ডু  রাজকুমার ঘোষ

প্রকাশস্থান : খাগড়া, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

প্রাপ্তিস্থান : ধ‌্যানবিন্দু, বিশ্বাস বুক স্টল (বহরমপুর)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন