Short Story : তোজো আর আশ্চর্য যন্ত্র : অরূপ কর

বুকটা ধক করে উঠল তার। তোজো খবরটা পড়তে শুরু করল। খবরের সারমর্ম হল, ইসরোর ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে যুক্ত এক ভারতীয় বিজ্ঞানী গত এক সপ্তাহ ধরে বেপাত্তা।

Short Story : তোজো আর অদ্ভুতুড়ে যন্ত্র : অরূপ কর
AI Generated


শীতের সকালের নরম রোদ ঢুকছে ঘরে। পড়ার টেবিলে তোজো হোমটাস্কে মগ্ন। পাশের চেয়ারে রোদ পোহাতে পোহাতে ঠাম্মির চোখ খবরের কাগজের পাতায়। তোজোকে নিয়মিত তিনি ভাল খবর দেখে পড়েও শোনান। খুন, জখম, চুরি-ছিনতাই, জালিয়াতির খবরগুলি এড়িয়ে যান পাছে নাতির মনে সমাজ-সংসার সম্পর্কে খারাপ ধারণা  হয়।

আজকের কাগজের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর, সামনের রবিবার উল্কাপাত হবে বহুদিন বাদে। ঠাম্মা তোজোকে পড়ে শোনালেন খবরটা। খবরে বলছে, কলকাতায়ও উল্কাপাত দেখা যাবে। রাত ১টা নাগাদ। তোজোর চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের মতো ব্যাপারে গভীর আগ্রহ। পৃথিবীর দিকে গ্রহাণু, উল্কার ধেয়ে আসার খবর তার জিজ্ঞাসু মনে আলোড়ন তোলে।

কিন্তু রবিবারের আসন্ন উল্কাপাতের খবর শুনে তোজো পড়ল মহা দোটানায়। কারণ সেদিন রাতেই যে চলতি কাতার বিশ্বকাপে পর্তুগাল আর আর্জেন্তিনার ম্যাচ! রোনাল্ডো বনাম মেসির টক্কর যা নিয়ে পারদ চড়তে শুরু করেছে। মেসির বাঁ পায়ের শিল্প সে উপভোগ করে, কিন্তু তাকে বেশি টানে বিপক্ষের পেনাল্টি চত্বরে রোনাল্ডোর ক্ষিপ্রতা। গোলশিকারী সিআরসেভেনের বিরাট ভক্ত সে।

রোনাল্ডো-মেসি দ্বৈরথ না উল্কাবৃষ্টি-কোনটা দেখবে? তোজো ভেবে দেখল, রোনাল্ডো-মেসি লাইভ টক্কর পরদিন রিপিট টেলিকাস্ট হতে পারে, কিন্তু উল্কাপাত তো রিপিট হবে না। সুতরাং উল্কাপাত মিস করলে আর হয়তো দেখাই হবে না। আবার কবে হবে কে জানে? তাই দ্বিতীয়টাই সে দেখবে।

সেদিন মামাবাড়িতে রাতে নেমন্তন্ন আছে। মামাতো দাদা বড়দার জন্মদিন। বাবা প্ল্যান করেছে, রাতে ওখানেই সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করবে, খেলা দেখবে। বড়দা, ছোড়দাও তোজোকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাচটা উপভোগ করবে বলে আশায় আছে।

তোজো মনে মনে ঠিক করেছে, বাকিরা যখন টিভির পর্দায় ব্যস্ত থাকবে, তখন সে আর বড়দা-ছোড়দা উল্কাবৃষ্টি দেখবে। তবে ছাদে উঠে নয়, মামাবাড়ির প্রশস্ত বাগানে। বাগান বলতে আম-জাম-নিম-বেল গাছের সারি। অনেক পুরানো দিনের বাড়ি। ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি, সাপ-খোপ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বড়দা-ছোড়দা খুব সাহসী। গভীর রাতে বাবা-মার নজর এড়িয়ে দরজা খুলে বাগানে ঢুকে আম কুড়োয়। ভয় পাওয়ার প্রশ্ন নেই।

রবিবার এল। জন্মদিনের কেক কাটা, খাওয়া দাওয়া শেষ। টিভিতে খেলা শুরু হয়েছে। তোজো, বড়দা-ছোড়দা ঘুমে ঢলে পড়ার অভিনয় করে পাশের ঘরে ঘুমোবে বলে চলে এল। রাত একটা। পাশের ঘরটা ভাল করে দেখে নিয়ে সন্তর্পনে পা টিপে তিনজন সিড়ি ভেঙে নেমে এল বাগানে। ঠায় আকাশের দিকে নজর। কিন্তু কোথায় উল্কাপাত! ধৈর্য্য হারাচ্ছে বড়দা-ছোড়দা। তোজো কিন্তু আশা ছাড়তে নারাজ। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যখন, উল্কা পড়বেই।

শেষ পর্যন্ত শুরু হল একটা-দুটো উল্কাপতন দিয়ে। তোজোদের আশা, ছিটকে-ছাটকে দু-একটা উল্কার টুকরো যদি বাগানে এসে পড়ে! সেজন্যই তো এই প্রতীক্ষা।

Short Story : তোজো আর অদ্ভুতুড়ে যন্ত্র : অরূপ কর
AI Generated

তারপর শুরু হল কালবৈশাখীর বিকালে টুপটাপ করে আম পড়ার মতো জ্বলন্ত উল্কাপতন। সে এক বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো ব্যাপার। বাগানেও একটা-দুটো পড়ল। সঙ্গে আনা টর্চ জ্বেলে তোজোরা ঝোপঝাড়ে পড়া নিভে যাওয়া উল্কার সন্ধান পেল। বাপ রে! একেবারে গর্ত হয়ে গেছে বাগানে। উল্কাখণ্ডের গায়ে হাত দিয়ে দেখল, যেন শক্ত পাথর। তোজোর ইচ্ছে ছিল, একটা টুকরো স্কুলে নিয়ে গিয়ে কেমিস্ট্রি স্যারকে দেখিয়ে উল্কার ব্যাপারে অনেক কিছু জানবে। ইট দিয়ে বাড়ি মেরে উল্কার কয়েকটা ভাঙা টুকরো ব্যাগে ভরে নিল ওরা।

কিন্তু আর তো বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। তোজো বাকিদের বলল, এবার চল, চল, বাবারা ঘরে আমাদের দেখতে না পেলে কিন্তু পিঠের ছাল তুলবে। ঘরে ফিরে যদিও গোল বাঁধল উল্কার মালিকানা নিয়ে। তোজোর দাবি, সে দুটো পেয়েছে। ওগুলো তার। কিন্তু বড়দা-ছোড়দার দাবি, ওদের বাগানে পড়েছে, তাই ওরাই উল্কার প্রকৃত মালিক। তোজো মনঃক্ষুন্ন হল, কিন্তু বয়সে বড় বলে আপত্তি না করে ওদের কথা মেনে নিল। তবে তার মাথায় তখন অন্য প্ল্যান কাজ করছিল।

দুই দাদা একটু পরে ঘুমিয়ে পড়তেই তোজো একা একা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে ঢুকল। সঙ্গে টর্চ। ওরা চলে আসার পরও হয়তো উল্কা পড়েছে। তারই সন্ধান করছে সে। কিন্তু হতাশ হল তোজো। না, আর এখানে থাকা নয়। বড়রা জানতে পারলেই চাবকে সিধে করে দেবে। বড়দা-ছোড়দাকে পাশে পাওয়া যাবে না। তোজো দ্রুত সিঁড়ির দিকে পা বাড়ল।

আর তখনই.....ওর নজর গিয়ে পড়ল একটু দূরে, কাঁটাগাছের ওপর। কী পড়ে আছে ওটা? তোজো টর্চ মেরে দেখল, একটা ছোট্ট লাল বাক্স। পাশে একটা সাদা কাগজ। তাতে হিংস্র ডাইনোসরের মুখ। নীচে লেখা, Warning, Be Prepared. We are coming!

বাক্সে লাগানো ছোট্ট অ্যান্টেনা। অজস্র সুইচ। বিপ বিপ করে শব্দ হচ্ছে। বেগুনি আলো বেরচ্ছে। হাতে নিয়ে তোজো নাড়াচাড়া করতেই বাক্স থেকে কথা বেরতে শুরু করল। 'ইসরো, ইসরো, সিস্টেম ০০০০০251999, লোকেশন যাদবপুর। সেন্ড টিম'।

শব্দ ক্রমশঃ জোরালো হচ্ছে। বিপদ আঁচ করে তোজো সঙ্গে সঙ্গে একটা সুইচে চাপ দিতেই বাক্সটা চুপ করে গেল। আলোও নিভে গেল। তোজো সেটা পকেটে ঢুকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকে দেখল, দুই দাদা ঘুমে কাদা। পাশের ঘরে টিভি চলছে। মানে তখনও খেলা শেষ হয়নি। তোজো জামাকাপড়ের ব্যাগের ভিতর বাক্স, কাগজটা ঢুকিয়ে চেন আটকে নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু চোখে তার ঘুম নেই। বাক্সটা কাদের? ইসরোর কোনও বিজ্ঞানীর? কিন্তু এখানে কী করে এল? কোনও বিপদ আসছে না তো? এমনই একগাদা প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে। বড়দা-ছোড়দার সামনে তো ওটা বের করার প্রশ্নই ওঠে না। কখন সকাল হবে, বাড়ি ফিরবে, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল তোজো।

পরদিন কতক্ষণে বাবা-মা অফিস যাবে, ঘড়ির দিকে নজর তার। তর সইছে না। ঠাম্মি খবরের কাগজ পড়ছেন। রান্নাঘরে উষা পিসিকে কিছু একটা বলতে উঠে যেতে কাগজের একটা পাতা তোজোর সামনে পড়ল। পাতাটা সরাতে যাবে, এমন সময় তার চোখ আটকে গেল একটা খবরের হেডিংয়ে। 'ইসরোর গবেষণা-যন্ত্র সহ নিখোঁজ বিজ্ঞানী'।

বুকটা ধক করে উঠল তার। তোজো খবরটা পড়তে শুরু করল। খবরের সারমর্ম হল, ইসরোর ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে যুক্ত এক ভারতীয় বিজ্ঞানী গত এক সপ্তাহ ধরে বেপাত্তা। তাঁর গবেষণা প্রকল্পের সব তথ্য চিপে ভরে একটা বাক্সে রাখা ছিল। সেটা থাকার কথা গোপন ভল্টে। যে ভল্ট খোলার পাসওয়ার্ড শুধু তিনি আর ইসরোর ডিরেক্টরের জানার কথা। সেই বিজ্ঞানীর সঙ্গে প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনার জন্য ডিরেক্টর কথা বলতে চাইছিলেন। কিন্তু হঠাত্ কাউকে কিছু না বলে কয়ে সেই বিজ্ঞানী উধাও হয়ে যাওয়ায় ডিরেক্টরের মনে সন্দেহ হয়। তিনি ভল্ট তল্লাসি করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন, বাক্সটা নেই!

তবে কি ইসরোর হারিয়ে যাওয়া সেই বাক্সটাই তোজোর হাতে এসেছে? কিন্তু সঙ্গের কাগজে লেখা হুঁশিয়ারিটা! ইসরোর তো এসবে জড়িত থাকার কথা নয়। সেটাও তোজোকে ভাবিয়ে তুলল। তার মানে কি লক্ষ কোটি বছর আগে লুপ্ত ডাইনোসররা আবার পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াবে? লকডাউনের সময় না হয় গাড়ি-ঘোড়া না চলায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জানোয়াররা শহরের রাস্তায় বেরত। কিন্তু ডাইনোসররা কলকাতার রাস্তায় নামলে তো সব তছনছ করে দেবে!

এর মধ্যেই তোজোর মামাবাড়িতে একটা ঘটনা ঘটেছে। একটা গাছ কাটার লোক এসেছিল বাগান পরিষ্কার করতে। কিন্তু গাছ কাটার চেয়ে তার বেশি আগ্রহ ছিল অন্যদিকে। সে কিছু একটা আঁতিপাতি করে খুঁজছিল। আপন মনে বিড়বিড় করে কিছু বলছিল। একবার নাকি সিঁড়ি বেয়ে দোতলা অবধি উঠে এসেছিল। দাদু ধমক দিতেই দৌড়ে নীচে নেমে যায়। কাজ সেরে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার বাড়িটা দেখছিল। তোজোর শুনে মনে হল, কী খুঁজছিল লোকটা। বাক্স-যন্ত্রটা!

কিন্তু তোজোর এখনও ব্যাগ থেকে সেই বাক্স-যন্ত্রটা বের করে দেখাই হয়নি। কাল সে যাবে বজবজ মহেশতলার কোলের বাগানে, যেখানে তার পিসেমশাইয়ের ছোটপিসির বাড়ি। তিনি তোজোর দাদাভাইয়ের অক্কাই। এলাকাটা নির্জন। জঙ্গল-ডোবা আছে। ও বাড়িতে অনেকগুলো ঘর। বাড়ির পাশেই একটা ফাঁকা জমি। সেখানে মাঝেমধ্যে কোত্থেকে বেরয় একটা গোসাপ। থপথপ করে ডানদিক, বাদিক দেখতে দেখতে ডোবার দিকে চলে যায়। তোজোর ওখানে যাওয়ার একটা বড় কারণ গোসাপটাকে দেখার নেশা। তোজো খবর পেয়েছে ওই জমিতে সম্প্রতি কেউ একটা তিনতলা বাড়ি করেছে। তবে গোসাপটা এখনও আসাযাওয়া করে।

দুপুরের ট্রেনে তোজো, দাদাভাই যাচ্ছে বজবজ। তাদের সামনেই এক গেরুয়াবসনধারী সাধু। মাঝেমধ্যেই জয় মা, জয় মা বলে ডেকে উঠছেন। ঝোলা থেকে চকলেট বের করে খাচ্ছেন। তোজোরা ইসরো, মিসাইল নিয়ে আলোচনা করছিল। সাধুবাবা ওদের আড়চোখে দেখছিলেন। তোজোকে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, বেড়াইতে যাচ্ছো খোকা?

নুঙ্গি স্টেশনে তোজোদের সঙ্গেই নামলেন তিনি। তারপর ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেলেন যেন। তোজোরাও তার কথা ভুলে গেল। অক্কাইয়ের বাড়ি পৌঁছে রাতে জানালা দিয়ে ওরা পাশের বাড়িটাকে দেখতে পেল। কেমন যেন ভূতুড়ে বাড়ি। কেউ থাকে না নাকি!

পরদিন সকাল। দাদাভাই আর তোজো জানালায় বসে আছে গোসাপ দর্শনের আশা নিয়ে। ব্যাগ থেকে বাক্স-যন্ত্রটা বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে তোজো। একবার এই সুইচ টেপে তো আরেকবার আরেকটা। এমন করতে করতে আচমকা যন্ত্রটা অন হয়ে গেল। সেই বেগুনি রশ্মি। সেই 'ইসরো, ইসরো, সিস্টেম ০০০০০251999।' তবে এবার তার সঙ্গে বলল, মিঃ সান্যাল, কনট্যাক্ট প্লিজ। লোকেশন মহেশতলা। তোজোর কাছে স্পষ্ট হল, এই যন্ত্র কোথায় আছে, সেটা বোঝা যায়।

Short Story : তোজো আর অদ্ভুতুড়ে যন্ত্র : অরূপ কর
AI Generated

কিন্তু কে এই মিঃ সান্যাল? তিনিই কি সেই নিখোঁজ বিজ্ঞানী। এসব ভাবনার মধ্যেই আচমকা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল গোসাপটা। জিভ বের করছে, ঢোকাচ্ছে। তোজোদের উপস্থিতি টের পেয়ে ওদের দিকে চেয়ে রয়েছে। তোজোর আঙুলের চাপে আচমকা একটা সুইচ অন হতেই একটা ক্যামেরার লেন্স বেরিয়ে এল! দাদাভাই বলল, তোজো ওর ছবি তোল! আচমকা লেন্সটা গোসাপের দিকে ঘুরিয়ে ক্লিক করতেই অভাবনীয় কাণ্ড। লেন্স থেকে একটা গোলাপী রে ছিটকে পড়ল গোসাপের গায়ে, সেটা ক্রমশঃ বড় হতে হতে একটা ডাইনোসরের চেহারা নিল। সঙ্গে ভীষণ গর্জন। মারাত্মক ব্যাপার। এবার যদি গিলতে আসে!

তোজো ভয় পেয়ে গেল। দাদাভাই সঙ্গে সঙ্গে ওই সুইচ দুবার টিপে ক্যামেরা অফ করতেই আবার ডাইনোসর ছোট্ট গোসাপ হয়ে গেল! হেঁটে ডোবার দিকে চলে গেল ধীর পায়ে হেঁটে।তার মানে বাক্স-যন্ত্রে জীবজন্তুর চেহারা ছোট, বড় করা যায়। এটা কি ডঃ সান্যালের আবিষ্কার? সেটা কেউ চুরি করেছে?

এর মধ্যেই পাশের সেই বাড়ির ওপরের একটা জানালা খুলেছিল। একটা মুখ দেখা গেল। তোজোর মুখটা চেনা চেনা লাগল। তবে কিছু বোঝার আগেই বন্ধ হয়ে গেল জানালাটা।

তোজোদের কেন যেন মনে হল, বাড়িটার ভিতরে এমন কোনও রহস্য আছে যার সঙ্গে বাক্স-যন্ত্র আর হুঁশিয়ারির সম্পর্ক থাকতে পারে। সন্ধ্যাবেলা তোজো, দাদাভাই কাউকে কিছু না বলে পাশের বাড়িটায় হানা দেবে ঠিক করল। কিন্তু এভাবে আচমকা ঢুকে বিপদ ঘনিয়ে আসবে না তো! তোজো নিয়মিত তার পুলিশ-মামাকে আপডেট দেয়। মামা বলে দিয়েছেন অ্যাকশন নেওয়ার আগে তাঁকে জানাতে। দরকার হলে তিনি ফোর্স পাঠাবেন। তোজো মামাকে আজ যা হয়েছে, সবটা বলল। ও বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছে, সেটাও জানাল। মামা না করলেন না।

শীত আসছে। সন্ধ্যা নামতেই গা ছমছমে পরিবেশ বাড়িটার বাগানে। ওরা দুজনে আস্তে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে এক বিশাল ডোবারম্যান। চেন দিয়ে বাঁধা অবশ্য। মাথা ঠান্ডা রেখে বাক্স-যন্ত্রের সেই সুইচটা দুবার টিপতেই কুকুরটা এক নিমেষে ছোট হয়ে গিয়ে কুই কুই করতে লাগল। কোথায় তার তেজ! দোতলায় উঠতেই একটা ঘর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। একটু জল। আর পারছি না। ভগবান বাঁচাও। ওরা ভিতরে ঢুকেই দেখে উল্টো দিকে মুখ করে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা এক প্রৌঢ়কে। আর পাশের একটা চেয়ারে পরচুলা, একটা গেরুয়া বসন আর পাগড়ি! ওরা দ্রুত সেই প্রৌঢ়কে বাঁধনমুক্ত করল।

তোজো বলল, আপনি কি ডঃ সান্যাল, ইসরোর বিজ্ঞানী? হাঁফাতে হাঁফাতে ঘাড় নাড়িয়ে তিনি বললেন, চক্রান্ত। বিরাট চক্রান্ত। ও একটা ঠগ। কার কথা বলছেন? বলতে বলতেই ঘরে ঢুকল ট্রেনের সেই সাধুবাবা। সাধুর বসন নেই।

তোজোকে দেখেই বলল, তোরা! এখানে কী করছিস? যা, বেরো। নয়তো.....। রিভলভারটা তাক করা তোজোদের দিকে। কিন্তু তার কথা শেষ হতে না হতেই দাদাভাই বাক্স যন্ত্রের সুইচটা দুবার টিপে দিয়েছে। চোখের সামনে সাধুবাবা ছোট হয়ে গেল। ততক্ষণে লোকাল থানার পুলিশ ঢুকে পড়েছে। বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে তারা। হাতকড়া পড়ল সাধুবাবার হাতে। বাকিটা শোনালেন ডঃ সান্যাল।

সাধুবাবা ইসরোয় তাঁর অধীনে কাজ করে। নাম কান্তি ভুরিয়া। সে ভাল বাংলা জানে বলে কাজের ফাঁকে দুজনের আলাপ গড়ায় বন্ধুত্বে। কিন্তু বন্ধুর ছদ্নবেশে কান্তির অসত্ উদ্দেশ্য ধরা পড়ে কিছুদিনের মধ্যেই। যখন ডঃ সান্যালের কয়েকটা রিসার্চ পেপার চুরি করে নিজের নামে একটা নামী জার্নালে ছাপিয়ে বের করে কান্তি। ডঃ সান্যালের জন্তু-জানোয়ারের চেহারা বদলে দেওয়ার গবেষণার খবর সে রাখত। একদিন ইসরো অফিসে তাঁরই ঘরে তাঁকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে বাক্স-যন্ত্রটা হাতিয়ে নেয়।

কান্তির প্ল্যান ছিল, টাকা নিয়ে শত্রু দেশকে সেটা পাচার করা। সেটা জেনে ফেলেন ডঃসান্যাল। একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে একদল লোক অপহরণ করে তাঁর মোবাইলটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়। তাঁকে মহেশতলার বাড়িতে এনে বন্দি করে রেখে অত্যাচার চালায় কান্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কান্তির উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বাক্স-যন্ত্র সে ধরে রাখতে পারেনি।

জেরায় সে পুলিশকে জানায়, একদিন ঘরের দরজা খোলা পেয়ে তার বাড়িতে একদল হনুমান ঢুকে তাণ্ডব চালায়। ওরা ফলমূলের সঙ্গে কান্তির ঘরে টেবিলের ওপর রাখা বাক্স-যন্ত্রটাও নিয়ে চম্পট দেয়। সেটাই ওরা নেড়েচেড়ে দেখে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল তোজোর মামা-বাড়ির বাগানে!

এর কয়েকদিন পর। ডঃ সান্যাল সুস্থ হয়ে উঠে তোজো, দাদাভাইকে ডেকে আমন্ত্রণ জানালেন ইসরোয়। ডিরেক্টরকে তিনি রাজি করিয়েছেন, ইসরোটা ঘুরে দেখতে পারবে ওরা।

তোজো খুব খুশি। বড়দা ভাই, ছোড়দা ভাই অবাক হয়ে গেল সব শুনে। তোজো ইসরো ঘুরতে যাওয়ার আগে তাদের বলে গেল, ভাগ্যিস, তোরা সেদিন উল্কার টুকরো দিতে চাসনি। নইলে তো এত কিছু ঘটতই না। আমারও ইসরো ঘোরার সুযোগই আসত না।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন