রতিকান্ত
কখনও কখনও অনুভবের বৈচিত্র্য এবং প্রকাশভঙ্গির সারল্য কবিতার সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। তেমনটাই কবি সা’আদুল ইসলামের কবিতাগুলি। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য স্বতঃস্ফূর্ততা এবং স্বচ্ছতা। সেটা অধিকাংশক্ষেত্রেই পাঠককে স্পর্শ করেছে। সদ্য আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তাঁর কবিতা সংকলন গ্রন্থ ‘সে আসবে বলে’। এখানে কবিতাগুচ্ছের মধ্যে যে ঘন আবেগের স্ফূরণ আছে তা প্রচলিত কবিসাধনার চেয়ে অনেকটাই স্বতন্ত্র।
বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটি কবিতায় চোখ আটকে গেল–
“বন্ধনী ছাড়া ক’রে একাকার করি,
বহমানতার জালে ধুয়ে নিই খঞ্জ প্রলাপ
ছেড়ে দিই পাহাড় ডিঙোতে
দিক তবে পুনরায় দলবৃত্ত লাফ”
কবিতার শীর্ষক ‘সুচেতনা চাঁদ ভাসে আকাশগঙ্গায়’। অন্য কবিতাতেও ছত্রে ছত্রে সংহত বেদনার আভাস তাঁর উচ্চারণকে দেয় এক অনন্যতা। এই চাঁদ নিয়ে কবির সা’আদুলের আরেকটি কবিতা, ‘আহ্লাদী চাঁদে লেগেছে গ্রহণ’–
“শুধু অনিমেষ দেখে
সেই-ই সুচেতনা চাঁদে
চোখ তার গেঁথে যায়
কণ্ঠবেঁধা হয়ে ঝুলে থাকে
সোনালী ডানার চিল
অ্যালবাট্রস পাখি”
সা’আদুলের কবিতাগুচ্ছ ছুঁয়ে যায় মধ্যরাতে ঘুমহারানো দীর্ঘশ্বাস ফেলা একাকীকে, জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রান্ত করা মানুষ কিংবা উঠতি তরুণ কিংবা তরুণীর রক্তাক্ত হৃদয়কে। তাঁর কবিতার মায়াজাল থেকে তাই মুক্তি মেলে না, পুরো বইটি বারবার আগ্রাসীর মতো গিলেও। আমরা জানি, কবিতার ইতিহাসে প্রেমের কবিতার চাইতে শক্তিশালী কবিতা কখনও হয়নি, প্রেমের কবির চাইতে বড় কবি কেউ হননি আমাদের হৃদয় আসনে, আর হয়ত তাই, সা’আদুল হয়ে উঠেছেন তারুণ্যের কবি। কবির কাছে এ তারুণ্য বয়সের নয়, শরীরেরও নয়। এই তারুণ্য মনের, যা ভাবতে সাহস জোগায়।
সা’আদুলের কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রটি অভিনব। তিনি লিখেছেন–
“কষ্টের ঘায়ে ঘাটা পড়ে গেলে
পাণ্ডপলিপিরা করে আয়োজন।
দাবানলে জ্ব’লে বিমূঢ় গাছেরা
‘কুসুম কুসুম’ ডাকে সারাখন;
ফেবুলা ভোগুলা আমার,
অনেক হারিয়ে ফেলা প্রিয়জনকে তোমারই জন্য খুঁজে পেলাম! নাও এটা!
নীচে ফুটনোট– ফেবু হল ফেসবুক আর আদরের ডাক ভোগুলা।
কবি হয়তো এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে নাগরিক শিক্ষিত সমাজে ফেসবুক এর প্রভাব ঠিক কতখানি। শুধু ফেসবুক নয়, সামাজিক অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও আমাদের জীবনে কতটা আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে আছে। এটি কবির সমসাময়িক সচেতনতা।
আবার রাষ্ট্রীয় চেতনাও রয়েছে এই কাব্য-মণ্ডলিতে। ওই কবিতাটিই তো মন ছুঁয়ে যায়।
“তিলপিয়ালির চাঁদের চোখে মহাকাল রাখছে চোখ
মহাকাল কথা বলে, শেখাচ্ছে সে কী সবক?
হিংসা নয়, রক্তও নয়, রক্তগোলাপ হোক
দ্বেষ নয়, দেশের জন্য ভালোবাসার স্তবক।”
সঙ্গে কবি একটি চাঁদের ছবি দিয়েছেন। যেটি ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে রাত ১১.২৪ মিনিটে তোলা, তাঁর গ্রাম তিলপিতে, পিয়ালি নদীর ধার থেকে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, মাত্র পাঁচদিন আগে কাশ্মীরে পুলওয়ামায় সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। একজন কবির জীবনে একটি কবিতাই যেমন তাঁকে স্মরণীয় করে রাখে, তেমনি কবিতায় একটি লাইনই যথেষ্ট পুরো কবিতার জন্য অথবা ঐ লাইনটির জন্যই পুরো কবিতাটা। কবি আ’সাদুল যেমন লিখেঠেন,– ‘হিংসা নয়, রক্তও নয়, রক্তগোলাপ হোক
দ্বেষ নয়, দেশের জন্য ভালোবাসার স্তবক।’ একজন কবির কাছে এই উপলব্ধিটি সহজাত, কিন্ত তা বের হয়ে এলো তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। এটাই কবিতার স্বার্থকতা। কাব্যগ্রন্থটির স্বার্থকতা। এতটুকু বলতে পারি, অনেকের কবিতার বই পড়তে বসে মনে হয় যে প্রতিটি কবিতার কথা যেন একই, আবার কবি কী বলতে চাইছেন, তা কঠিন কঠিন শব্দের ভীরে দুর্বোধ্য। কবি সা’আদুলের কবিতা সাধারণ কাব্যপ্রেমীর কবিতা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন