রায়বেরিলিতে মনোনয়ন জমার সময়েই ইন্দিরা বুঝতে পেরেছিলেন, সব ঠিক নেই। সাংবাদিক নীরজা শুনিয়েছেন ক্ষমতার অলিন্দের অনেক অকথিত কাহিনী। বইয়ের খবর দিলেন দ্বৈপায়ন কর
দেশের প্রধানমন্ত্রীদের একটি সিদ্ধান্ত, বা কোনও কোনও সময় সিদ্ধান্ত না নেওয়া, ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়। তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তগুলোর কারণ হিসাবে জনসমক্ষে যা বলে থাকেন, তা সবসময় প্রকৃত কারণ না-ও হতে পারে। পরবর্তীকালে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ময়না তদন্ত করলে তার অন্য ব্যাখ্যা উঠে আসে।
প্রায় আট মাস আগে প্রকাশিত একটি বই, সোমবার থেকে হঠাৎই জোর চর্চায় উঠে এসেছে। একটি রাজনৈতিক বই - বহু পুরস্কারে সম্মানিত সাংবাদিক নীরজা চৌধুরীর (Neerja Chowdhury) লেখা হাউ প্রাইম মিনিস্টারস ডিসাইড (How Prime Ministers Deside)। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সোমবার দুই সপ্তাহের জন্য বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়েছে দিল্লির রাউস এভিনিউ আদালত। তাঁকে তিহার জেলে রাখা হয়েছে। আদালতে তাঁর আইনজীবীরা জেলে কেজরিওয়ালকে তিনটি বই দেওয়ার জন্য আর্জি জানান। রামায়ণ, মহাভারত এবং নীরজা চৌধুরীর এই বইটি। তবে যাঁরা রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক আলোচক এবং রাজনৈতিক সাংবাদিকদের অবশ্য পাঠ্য এই বইটি।
নীরজা শুরু করেছেন ২১ মার্চ ১৯৭৭ তারিখটি থেকে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক ভাবে অতি তাৎপর্যপূর্ণ। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন দিল্লির ১ নম্বর সফদরজঙ্গ রোডে দেখা করতে এসেছেন নেহরু-গান্ধী পরিবারের বহু পুরনো ঘনিষ্ঠ দুই শিল্পপতি ভাই। মিসেস গান্ধীর সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। এমনকি যিনি একমাস আগেও প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন, আজ তিনি সংসদও নন।রায়বেরিলিতে নিজের কেন্দ্রেও তিনি পরাজিত।
এই পরাজয়ে ভীষনভাবে ভেঙে পড়েন ইন্দিরা। তিনি রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিয়ে পাহাড়ে গিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলি কাটানো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর কাছে এই পরাজয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এই ইন্দিরাই একাত্তরের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে সাক্ষাৎ মা দুর্গা হয়ে উঠেছিলেন। আর জরুরি অবস্থা জারি করে, গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করে ভিলেন হয়ে গিয়েছেন।
দেওয়াল লিখন কী তিনি পড়তে পারেননি? হয়তো পড়েছিলেন। ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, রায়বেরিলিতে মনোনয়ন জমার সময়েই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সব ঠিক নেই। এমনকি অভিনেতা দিলীপ কুমার যেদিন রায়বেরিলিতে ইন্দিরা হয়ে প্রচারে এসেছিলেন, তাঁর বক্তৃতার পরেই ভিড় কেটে যায়। ইন্দিরার বক্তৃতা শুরু পর্যন্ত কেউ অপেক্ষা করেননি। অথচ, ইন্টেলিজেন্স তাঁকে রিপোর্ট দিয়েছিল, তিনিই ফের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছেন। একদিন আগেও, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন ডি তেওয়ারি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ফিরবে। কিন্তু, গণনা শুরুর কিছু পর থেকে ছবি বদলাতে থাকে।
ওই শিল্পপতি যখন ইন্দিরাকে জানান যে তিনি পিছিয়ে পড়ছেন, খুব শান্ত কণ্ঠে ব্যবধান জানতে চান। যা ঘটবার ঘটে গিয়েছে। তখনই পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেন ইন্দিরা। নীরজা লিখছেন, একদিকে দীর্ঘ সময়ের ঠিকানা, ১ সফদরজঙ্গ রোডের সরকারি বাংলো ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট, যা তিনি নিজের পছন্দের হস্তশিল্প দিয়ে সাজিয়েছিলেন, আর সেই সঙ্গে একজন মা হিসাবে, দুই সন্তান রাজীব-সঞ্জয় আর তাদের পরিবারের জন্য উদ্বেগ। বিশেষ করে সঞ্জয়ের জন্য তিনি বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল, জরুরি অবস্থার সময়ে সঞ্জয়ের ভূমিকা যা ছিল, তাতে নতুন সরকার তাঁর উপর প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না। ভীত ইন্দিরাকে বলতে শোনা যায়, "ওরা ওকে বাঁচতে দেবে না।" এ ভাবেই ঘটনা এগোতে থাকে।
যাই হোক, এর বিপরীতে সদ্য ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা পার্টি সরকার কিছুতেই ইন্দিরা-ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। ইন্দিরার লয়াল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বি ডি জাত্তি কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিতে সরকার ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ ফিরিয়ে দিলে জনতা সরকার সে সময় সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেছিল। সেনা বাহিনীর প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি জাত্তি সেই সেনা অভ্যুত্থানে...।
তবে এটাও ঠিক, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই (তাঁরই এক সময়ের ডেপুটি) যখন জানতে পারেন যে ইন্দিরা তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তিনি নিজে প্রাক্তন নেত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাঁদের দিক থেকে কারও শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
এমনই চমকে ওঠার মতো ঘটনার পর্দা উন্মোচিত হয়েছে নীরজার কলমে। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে ছয়জন প্রধানমন্ত্রীর সময়কালের আকর্ষণীয় বিবরণ দিয়েছেন লেখিকা। প্রাইম সোর্স-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উঠে আসা তথ্য ছবির আড়ালের ঘটনাগুলি প্রকাশ করে, যা সেই সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীদের নেওয়া সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল। লেখিকা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, ভি.পি. সিং, পি.ভি. নরসিমহা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিং প্রমুখের ব্যক্তিগত প্রোফাইল, তাদের কৌশল, চাপ, ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক লাভ যা তাদের কাজকে প্রভাবিত করেছিল তা তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন।
নরেন্দ্র মোদি দিল্লির মসনদে আসার আগে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীদের অভিজ্ঞতা কম ছিল, অথচ তাঁরাও বড় ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিন দশক আগে, ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্তমূলক কর্তৃত্বের সাথে শাসন করেছিলেন। তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত হন। যাইহোক, তার প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং নিপুণ কৌশলের গল্প, যা রাজনৈতিক শ্রেণীর জন্য পাঠ রাখে।
বইটি বলে যে ইন্দিরা তার নিজের নির্বাচনী এলাকা রায়বরেলি হারানোর অত্যাশ্চর্য ধাক্কা খেয়ে পাহাড়ে অবসর নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তার কয়েক বছর আগে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর যখন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয় তখন তাকে দুর্গা হিসেবে সমাদৃত করা হয়। কিন্তু যখন জনতা পার্টির সরকার তার ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি পাল্টা লড়াই করার জন্য আবার উঠে দাঁড়ান। শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন, তিনি তাঁর সবচেয়ে উগ্র বিরোধীদের, জয় প্রকাশ নারায়ণ এবং রাজ নারায়ণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, যার ফলে পরবর্তীতে তাদের সমালোচনার ধার কমাতে হয়েছিল। রাজনীতিতে কোনও স্থায়ী শত্রু নেই। ২০১৯ সালে, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস যখন শিবসেনার সঙ্গে জোট করে, হয়েছিল, তখন তাদের অবশ্যই ইন্দিরার প্রতি বাল ঠাকরের সমর্থনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
রাজীব গান্ধীর অধ্যায়টি পাঠককে সেই যুগের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় যখন শাহ বানোকে নিয়ে গুঞ্জন এবং উভয় ধর্মের বিশ্বাসীদের খুশি করার অভিপ্রায়ে বাবরি মসজিদের তালা খোলার বিপরীত প্রভাব ছিল। ভিপি সিং-এর মণ্ডল কমিশন পর্ব দেশের রাজনীতিকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। সেই সময়ে মন্দিরের রাজনীতিও তুঙ্গে উঠছিল। নরসিমহা রাওয়ের আমলে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । তবে বাজপেয়ী এবং নরসিমহা রাও-এর সময় একে অপরের প্রতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার জন্য তাঁদের নমনীয় মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। সংকটকালে তাঁরা একে অপরকে সাহায্য করেছেন। রাও, বাজপেয়ীকে তাঁর পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন এবং রাও তাঁকে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেই পোখরান পর্ব ভারতের শক্তি প্রদর্শনের আরেক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। নীরজা চার দশক ধরে বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রীর সময়ে রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেছেন। নীরজা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদির সিদ্ধান্ত গ্রহণের শৈলী তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে তাঁর মনে হয়েছে। যেহেতু মোদির মেয়াদ এখনও চলেছে, তাঁর কাছের লোকেরা এখনও কথা বলতে কুণ্ঠিত হতে পারেন, তাই মূল সিদ্ধান্তগুলির প্রকৃত বিবরণ প্রকাশ্যে আসে আরও কয়েক বছর লাগতে পারে। কিছু অনুমান অনুসারে মোদিকে নিয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ বই লেখা হয়েছে। তাঁর কার্যকালের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে পর্দা ওঠানোর জন্য ভবিষ্যতে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন হবে।
সহজ ও সরল ভাষায় গল্পের আকারে ঘটনার বিবরণ বইটিকে সব ধরনের পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। চমকপ্রদ গল্পগুলো সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশে আলোকপাত করে এবং পাঠকদের নিয়ে যায় এক মনোমুগ্ধকর যাত্রায়। বইটি আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের অবদানের সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন।
প্রায় আট মাস আগে প্রকাশিত একটি বই, সোমবার থেকে হঠাৎই জোর চর্চায় উঠে এসেছে। একটি রাজনৈতিক বই - বহু পুরস্কারে সম্মানিত সাংবাদিক নীরজা চৌধুরীর (Neerja Chowdhury) লেখা হাউ প্রাইম মিনিস্টারস ডিসাইড (How Prime Ministers Deside)। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সোমবার দুই সপ্তাহের জন্য বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়েছে দিল্লির রাউস এভিনিউ আদালত। তাঁকে তিহার জেলে রাখা হয়েছে। আদালতে তাঁর আইনজীবীরা জেলে কেজরিওয়ালকে তিনটি বই দেওয়ার জন্য আর্জি জানান। রামায়ণ, মহাভারত এবং নীরজা চৌধুরীর এই বইটি। তবে যাঁরা রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক আলোচক এবং রাজনৈতিক সাংবাদিকদের অবশ্য পাঠ্য এই বইটি।
নীরজা শুরু করেছেন ২১ মার্চ ১৯৭৭ তারিখটি থেকে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক ভাবে অতি তাৎপর্যপূর্ণ। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন দিল্লির ১ নম্বর সফদরজঙ্গ রোডে দেখা করতে এসেছেন নেহরু-গান্ধী পরিবারের বহু পুরনো ঘনিষ্ঠ দুই শিল্পপতি ভাই। মিসেস গান্ধীর সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। এমনকি যিনি একমাস আগেও প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন, আজ তিনি সংসদও নন।রায়বেরিলিতে নিজের কেন্দ্রেও তিনি পরাজিত।
এই পরাজয়ে ভীষনভাবে ভেঙে পড়েন ইন্দিরা। তিনি রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিয়ে পাহাড়ে গিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলি কাটানো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর কাছে এই পরাজয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এই ইন্দিরাই একাত্তরের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে সাক্ষাৎ মা দুর্গা হয়ে উঠেছিলেন। আর জরুরি অবস্থা জারি করে, গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করে ভিলেন হয়ে গিয়েছেন।
দেওয়াল লিখন কী তিনি পড়তে পারেননি? হয়তো পড়েছিলেন। ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, রায়বেরিলিতে মনোনয়ন জমার সময়েই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সব ঠিক নেই। এমনকি অভিনেতা দিলীপ কুমার যেদিন রায়বেরিলিতে ইন্দিরা হয়ে প্রচারে এসেছিলেন, তাঁর বক্তৃতার পরেই ভিড় কেটে যায়। ইন্দিরার বক্তৃতা শুরু পর্যন্ত কেউ অপেক্ষা করেননি। অথচ, ইন্টেলিজেন্স তাঁকে রিপোর্ট দিয়েছিল, তিনিই ফের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছেন। একদিন আগেও, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন ডি তেওয়ারি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ফিরবে। কিন্তু, গণনা শুরুর কিছু পর থেকে ছবি বদলাতে থাকে।
ওই শিল্পপতি যখন ইন্দিরাকে জানান যে তিনি পিছিয়ে পড়ছেন, খুব শান্ত কণ্ঠে ব্যবধান জানতে চান। যা ঘটবার ঘটে গিয়েছে। তখনই পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেন ইন্দিরা। নীরজা লিখছেন, একদিকে দীর্ঘ সময়ের ঠিকানা, ১ সফদরজঙ্গ রোডের সরকারি বাংলো ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট, যা তিনি নিজের পছন্দের হস্তশিল্প দিয়ে সাজিয়েছিলেন, আর সেই সঙ্গে একজন মা হিসাবে, দুই সন্তান রাজীব-সঞ্জয় আর তাদের পরিবারের জন্য উদ্বেগ। বিশেষ করে সঞ্জয়ের জন্য তিনি বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল, জরুরি অবস্থার সময়ে সঞ্জয়ের ভূমিকা যা ছিল, তাতে নতুন সরকার তাঁর উপর প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না। ভীত ইন্দিরাকে বলতে শোনা যায়, "ওরা ওকে বাঁচতে দেবে না।" এ ভাবেই ঘটনা এগোতে থাকে।
যাই হোক, এর বিপরীতে সদ্য ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা পার্টি সরকার কিছুতেই ইন্দিরা-ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। ইন্দিরার লয়াল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বি ডি জাত্তি কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিতে সরকার ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ ফিরিয়ে দিলে জনতা সরকার সে সময় সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেছিল। সেনা বাহিনীর প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি জাত্তি সেই সেনা অভ্যুত্থানে...।
তবে এটাও ঠিক, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই (তাঁরই এক সময়ের ডেপুটি) যখন জানতে পারেন যে ইন্দিরা তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তিনি নিজে প্রাক্তন নেত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাঁদের দিক থেকে কারও শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
এমনই চমকে ওঠার মতো ঘটনার পর্দা উন্মোচিত হয়েছে নীরজার কলমে। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে ছয়জন প্রধানমন্ত্রীর সময়কালের আকর্ষণীয় বিবরণ দিয়েছেন লেখিকা। প্রাইম সোর্স-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উঠে আসা তথ্য ছবির আড়ালের ঘটনাগুলি প্রকাশ করে, যা সেই সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীদের নেওয়া সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল। লেখিকা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, ভি.পি. সিং, পি.ভি. নরসিমহা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিং প্রমুখের ব্যক্তিগত প্রোফাইল, তাদের কৌশল, চাপ, ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক লাভ যা তাদের কাজকে প্রভাবিত করেছিল তা তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন।
নরেন্দ্র মোদি দিল্লির মসনদে আসার আগে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীদের অভিজ্ঞতা কম ছিল, অথচ তাঁরাও বড় ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিন দশক আগে, ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্তমূলক কর্তৃত্বের সাথে শাসন করেছিলেন। তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত হন। যাইহোক, তার প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং নিপুণ কৌশলের গল্প, যা রাজনৈতিক শ্রেণীর জন্য পাঠ রাখে।
বইটি বলে যে ইন্দিরা তার নিজের নির্বাচনী এলাকা রায়বরেলি হারানোর অত্যাশ্চর্য ধাক্কা খেয়ে পাহাড়ে অবসর নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তার কয়েক বছর আগে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর যখন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয় তখন তাকে দুর্গা হিসেবে সমাদৃত করা হয়। কিন্তু যখন জনতা পার্টির সরকার তার ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি পাল্টা লড়াই করার জন্য আবার উঠে দাঁড়ান। শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন, তিনি তাঁর সবচেয়ে উগ্র বিরোধীদের, জয় প্রকাশ নারায়ণ এবং রাজ নারায়ণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, যার ফলে পরবর্তীতে তাদের সমালোচনার ধার কমাতে হয়েছিল। রাজনীতিতে কোনও স্থায়ী শত্রু নেই। ২০১৯ সালে, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস যখন শিবসেনার সঙ্গে জোট করে, হয়েছিল, তখন তাদের অবশ্যই ইন্দিরার প্রতি বাল ঠাকরের সমর্থনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
রাজীব গান্ধীর অধ্যায়টি পাঠককে সেই যুগের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় যখন শাহ বানোকে নিয়ে গুঞ্জন এবং উভয় ধর্মের বিশ্বাসীদের খুশি করার অভিপ্রায়ে বাবরি মসজিদের তালা খোলার বিপরীত প্রভাব ছিল। ভিপি সিং-এর মণ্ডল কমিশন পর্ব দেশের রাজনীতিকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। সেই সময়ে মন্দিরের রাজনীতিও তুঙ্গে উঠছিল। নরসিমহা রাওয়ের আমলে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । তবে বাজপেয়ী এবং নরসিমহা রাও-এর সময় একে অপরের প্রতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার জন্য তাঁদের নমনীয় মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। সংকটকালে তাঁরা একে অপরকে সাহায্য করেছেন। রাও, বাজপেয়ীকে তাঁর পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন এবং রাও তাঁকে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেই পোখরান পর্ব ভারতের শক্তি প্রদর্শনের আরেক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। নীরজা চার দশক ধরে বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রীর সময়ে রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেছেন। নীরজা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদির সিদ্ধান্ত গ্রহণের শৈলী তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে তাঁর মনে হয়েছে। যেহেতু মোদির মেয়াদ এখনও চলেছে, তাঁর কাছের লোকেরা এখনও কথা বলতে কুণ্ঠিত হতে পারেন, তাই মূল সিদ্ধান্তগুলির প্রকৃত বিবরণ প্রকাশ্যে আসে আরও কয়েক বছর লাগতে পারে। কিছু অনুমান অনুসারে মোদিকে নিয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ বই লেখা হয়েছে। তাঁর কার্যকালের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে পর্দা ওঠানোর জন্য ভবিষ্যতে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন হবে।
সহজ ও সরল ভাষায় গল্পের আকারে ঘটনার বিবরণ বইটিকে সব ধরনের পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। চমকপ্রদ গল্পগুলো সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশে আলোকপাত করে এবং পাঠকদের নিয়ে যায় এক মনোমুগ্ধকর যাত্রায়। বইটি আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের অবদানের সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন