মনমোহন সিং এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) এবং অন্যান্য মন্ত্রকের অফিসগুলিতে সাংবাদিকদের অবাধ যাতায়াত ছিল। সংবাদমাধ‌্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনও সরকার মর্যাদা না দিলে এটা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। লিখছেন দ্বৈপায়ন কর

সংবাদমাধ‌্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনও সরকার মর্যাদা না দিলে এটা সম্ভব হওয়ার কথা নয়।
মনমোহন সিং। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। ছবি ফ্লিকার।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে ৩৩ বছরের সংসদীয় কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সেই সূত্রে প্রায় সাড়ে তিন দশকে জনজীবনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সংবাদমাধ‌্যম। সেখানে তাঁকে একজন পণ্ডিত ব‌্যক্তি এবং ভারতে অর্থনৈতিক স্থপতি হিসাবে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রায় সব লেখকই মনে করিয়ে দিয়েছেন, মৃদুভাষী অর্থনীতিবিদকে ১৯৯১ সালে কীভাবে অর্থমন্ত্রকের শীর্ষে বসিয়েছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও। তাঁকে দেশের সঙ্কটাপন্ন অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাতে আবদ্ধ অর্থনৈতিক নীতিগুলি থেকে বেরিয়ে আসার পথ অনুসন্ধান করা যায়। সেই কাজে সফল হয়েছিলেন ড. সিং। তিনি উদারীকরণের সূচনা করে, উচ্চ বৃদ্ধির হার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্প্রসারণের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ছবিটি বদলে দিয়েছিলেন।

ড. সিং-এর রাজনৈতিক পথচলা আরেকটি উল্লেখযোগ্য মোড় নেয় ২০০৪ সালে। কেন্দ্রে ক্ষমতা গখল করে কংগ্রেস নেতৃত্বের জোট। সেইসময় কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর দাবি ‌ত‌্যাগ করেন। তিনিই প্রধানমন্ত্রী পদে মনমোহন সিংয়ের নাম প্রস্তাব করেন। পরের নির্বাচনেও জিতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে পুরো পাঁচ বছর পূর্ণ করেন ড. সিং।

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহনের দশ বছরের মেয়াদ অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী ছিল। তবে তাঁর কৃতীত্বগুলিকে আজ স্মরণ করতে গিয়ে যদি সেই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, ক্ষমতাসীন জোটের নেতৃত্ব কিংবা সরকারের নীতির সমালোচনায় সংবাদমাধ্যমের অভূতপূর্ব স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয়, তবে মস্ত ভুল হবে। ভারত-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে এগোতে গিয়ে বাম দলগুলির সমর্থন হারাতে হয় মনমোহন সরকারকে। সে যাত্রায় মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম ইউপিএ সরকারকে বাঁচিয়ে দেয়। মনমোহল এই চুক্তি নিয়ে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে সফল হলেও, সেই সময় বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্টদের দ্বারা কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রগুলি তাঁর মেয়াদের অন‌্যান‌্য ‘ফ্ল‌্যাগশিপ’ নীতিগুলিরও ব‌্যাপক কভারেজ যেমন দিয়েছে, তেমনই সমালোচনা করেছে। সেই ভূমিকা কিন্তু হালফিলে, বর্তমান সরকারের আমলে ফৌজদারি আইনের সংশোধনের মতো পদক্ষেপগুলি নিয়ে সংবাদমাধ‌্যমের সেই ভূমিকা দেখা যায়নি। এমনকী, ড. সিং-এর আমলে সংবাদমাধ‌্যম অবাধে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের অধিকার-ভিত্তিক আইন গঠন এবং ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যে তাঁর প্রভাবশালী ভূমিকার বিষয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

সংবাদমাধ‌্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনও সরকার মর্যাদা না দিলে এটা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। বস্তুত, ডা. সিংয়ের সময়ে মন্ত্রিপরিষদের সদস‌্য এবং আমলাদের সঙ্গে সহজ আলাপচারিতার মাধ্যমে সরকারী কার্যক্রম সম্পর্কে সংবাদমাধ‌্যমের যোগাযোগ সহজতর করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) এবং অন্যান্য মন্ত্রকের অফিসগুলিতে সাংবাদিকদের অবাধ যাতায়াত ছিল।

ডা. সিংয়ের প্রেস উপদেষ্টা, প্রাক্তন সাংবাদিক সঞ্জয় বারু, সাংবাদিকদের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের একটি উন্মুক্ত লাইন বজায় রেখেছিলেন। সংসদ সংবাদিক এবং আইন প্রণেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আদান-প্রদানের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেছিল। বলাবাহুল‌্য, এই পরিবেশ স্বচ্ছতা ও তথ্য আদান-প্রদানকে উৎসাহিত করেছিল।

তারপর থেকে ছবিটা নাটকীয়ভাবে বদলাতে থাকে। গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। সংসদে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে। সংবাদমাধ‌্যম এবং আধিকারিকদের মধ্যে ‘অনানুষ্ঠানিক’ মেলামেশা হ্রাস করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক মুখপাত্ররা সাংবাদিকদের এড়িয়েই চলেন।

ইউপিএ সরকার অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তারা প্রেস সেন্সরশিপের চাইতে প্রেসের সঙ্গে কথা বলাটাই পছন্দ করত। এমনকী, ২০১১ সালে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, বিরোধী শিবির থেকে তোলা দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের সময়েও সংবাদমাধ‌্যমের কাজ অবাধ ছিল। আজকের সংবাদমাধ‌্যম সরকারী নীতির সমালোচনা এবং রাজনৈতিক গতিবিধির উপর বস্তুনিষ্ঠভাবে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হতে পারে।

তাঁর উত্তরসূরির বিপরীতে সংবাদমাধ‌্যম ডা. সিংয়ের কাছে পৌঁছতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি অসংখ‌্যবার সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়েছেন। কঠিন প্রশ্নগুলির জবাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিংয়ের শেষ সাংবাদিক সম্মলনটি তাঁর একটি মন্তব্যের জন‌্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যেখানে তিনি বলেছিলেন, “It will be a disaster if Modi becomes Prime Minister of India.”

লেখকের মতামত নিজস্ব। ‘বইতন্ত্র’ সেগুলিকে সমর্থন না-ও করতে পারে বা তার জন্য দায়ী নয়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন