ইসমাইল কাদারে : তাঁর সর্বগ্রাসীবাদকে প্রতিহত করার পাঠ অনুপ্রাণিত করবে

 "এই সময়ের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন তারা অসুখী ছিলেন।কিন্তু শিল্প সব কিছুর ঊর্ধ্বে। শিল্প কোনও শাসনের অধীনে অসুখী বা সুখী নয়," বলেছিলেন ইসমাইল কাদারে। ১ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে তিরানায় প্রয়াত হলেন এই বিশ্ববিখ‌্যাত সাহিত্যিক।

ইসমাইল কাদারে : তাঁর সর্বগ্রাসীবাদকে প্রতিহত করার পাঠ অনুপ্রাণিত করবে


দ্বৈপায়ন কর

২০১০ সালে একটি সাক্ষাৎকারে ইসমাইল কাদারে (Ismail Kadare) বলেছিলেন, “আমি দুটি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সময় সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছি: একটি কালোতম অধ্যায় যা ৩৫ বছর ধরে চলে (১৯৫৫-১৯৯০), অন্যটি ২০ বছরের স্বাধীনতা। উভয় ক্ষেত্রেই, যে জিনিসটি সাহিত্যকে ধ্বংস করতে পারে তা অভিন্ন: সেলফ-সেন্সরশিপ।”

তিনিই পারেন এই মন্তব‌্য করতে যাঁর উপন্যাস ‘দ্য প্যালেস অব ড্রিমস’ (The Palace of Dreams) ১৯৮১ সালে তাঁর নিজের দেশ আলবেনিয়ার কমিনিউস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ণ সমালোচনার দায়ে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে কাদারে গণতন্ত্রের পক্ষে মন্তব‌্য। ফলে তাঁকে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। গত ১ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে আলবেনিয়ার তিরানায় প্রয়াত হলেন কাদারে। যাঁর রচনা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতা এবং কথাসাহিত্যের মাধ্যমে বলকানের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে স্পষ্টভাবে অন্বেষণ করেছে।

১৯৩৬ সালে গ্রীক সীমান্তের কাছে অটোমান দুর্গের শহর জিরোকাস্টারে জন্মগ্রহণ করেন কাদারে। সেই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা, যেখানে আলবেনিয়ান একনায়ক এনভার হোক্সা একসময় থাকতেন। কাদারের সাহিত্য যাত্রার শুরু তাঁর ১৭ বছর বয়সে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ দিয়ে। তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের পর কাদারে মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউটে সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য একটি সরকারী বৃত্তি পান। ১৯৬০ সালে তিনি আবার আলবেনিয়ায় ফিরে আসেন। এরপরেই তাঁর প্রথম দিকের সাহিত‌্যকর্মগুলির জন‌্য ‘সেন্সরশিপের’ মুখে পড়েন।

হোক্সার নিপীড়নমূলক শাসন সত্ত্বেও কাদারের উপন্যাসগুলিতে সমসাময়িক সমাজের সমালোচনা করার জন্য রূপক ও মিথকে শৈল্পিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। 'দ্য জেনারেল অফ দ্য ডেড আর্মি' (The General of the Dead Army) (১৯৬৩) প্রকাশের মধ‌্য দিয়ে তিনি সর্বাধিক প্রচারের আলোকে আসেন। উপন‌্যাসটিতে যুদ্ধোত্তর আলবেনিয়ায় একজন ইতালীয় জেনারেলের সৈন্যদের দেহাবশেষ অনুসন্ধান করার গল্প বলা হয়েছে। শুরুতে আলবেনিয়ায় উপন‌্যাসটি সমালোচিত হয়। তবে উপন্যাসটি ১৯৭০ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক প্রশংসা লাভ করে।

সৃজনশীল অভিব্যক্তি এবং রাজনৈতিক টিকে থাকার মধ্যে ভারসাম‌্যের ক্ষমতা কাদারের কর্মজীবন জুড়ে স্পষ্ট ছিল। তাঁর ১৯৮১ সালের উপন্যাস, ‘দ্য প্যালেস অফ ড্রিমস’, সর্বগ্রাসীবাদের একটি রূপক সমালোচনা। সেটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবুও, কাদারে আলবেনিয়ান রাইটার্স ইউনিয়ন এবং পিপলস অ্যাসেম্বলির মধ্যে একটি অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হন। তিনি বিদেশে গিয়েছেন একাধিকবার, অব‌্যহত থেকেছে সাহিত‌্যকর্মও। নোবেল পুরস্কারের জন‌্য একাধিকবার তাঁর নাম আলোচনায় উঠে এলেও, কাদারের ভক্তরা বারবার হতাশ হয়েছেন।

আলবেনিয়া আশির দশকের শেষের দিকে সংস্কার শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে কাদারে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আরও সরব হয়ে ওঠেন। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে, কমিউনিজমের পতন আসন্ন হলে, আলবেনিয়ান সিক্রেট পুলিশ, সিগুরিমির হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে কাদারে প্যারিসে পালিয়ে যান। তিনি ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন।

প্যারিসে বসবাসকালে কাদারে লেখালেখি অব্যাহত রেখেছিলেন। সেই সময় তিনি সর্বগ্রাসীবাদের উপর আরও বেশি আলোকপাত করতে থাকেন। "দ্য ব্লাইন্ডিং অর্ডার" (The Blinding Order) এবং ‘দ্য পিরামিড’ (The Pyramid)-এর মতো কাজগুলি ঐতিহাসিক রূপকতার মাধ্যমে নিপীড়ক শাসনের সমালোচনা করেছে। তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি বেড়েছে, তিনি ২০০৫ সালে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লিজিওন ডি'অনার অর্জন করেন। ২০০৫ সালে ম্যান বুকার (Booker Prize) আন্তর্জাতিক পুরস্কার চালু হয়। প্রথম বছরেই পুরস্কৃত হন কাদেরে।

কাদেরের জীবন ও কাজকর্ম বিতর্কমুক্ত ছিল না। কিছু সমালোচক তাঁকে একজন ‘গিরগিটি’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন, নিজেকে পশ্চিমের ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে উপস্থাপন করার সময় কমিউনিস্ট শাসনের দাবিতেও পথ চলেছেন। কাদেরে নিজে অবশ‌্য এই দাবিগুলি খারিজ করে দিয়েছিলেন, দাবি করেছিলেন যে তাঁর কাজ নিজেই একটি প্রতিরোধের কাজ করে।

বিতর্ক সত্ত্বেও, টলানো যায়নি কাদারেকে। তাঁর উপন্যাস ‘দ্য সিজ’ (The Siege) (২০০৮), যা অটোমান তুর্কিদের প্রতিরোধকারী একটি আলবেনিয়ান দুর্গকে চিত্রিত করে, একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত‌্যকর্ম হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিল। কাদেরে এই ব‌্যাপারে একনিষ্ঠ ছিলেন যে সত্যিকারের সাহিত্য রাজনীতিকে অতিক্রম করে।

২০১৯ সালে, কাদারে তাঁর পুরানো বসতভিটায় একটি সংগ্রহশালা উদ্বোধন করতে তিরানায় ফিরে আসেন। তাঁর কর্মজীবনের নির্যাসটি হল– তাঁর কাজ শুধুমাত্র সাহিত্যের আইন অনুসরণ করে, যা তিনি নিজেই একাধিকবার বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, "এই সময়ের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন তারা অসুখী ছিল।কিন্তু শিল্প সব কিছুর ঊর্ধ্বে। শিল্প কোনও শাসনের অধীনে অসুখী বা সুখী নয়।"

সাহিত্যে ইসমাইল কাদারের গভীর প্রভাব, সর্বগ্রাসী শাসনের অধীনে মানবজাতির অবস্থা সম্পর্কে তাঁর অন্বেষণ এবং শৈল্পিক সততার প্রতি তাঁর আত্মত‌্যাগ বিশ্বব্যাপী পাঠক চিরকাল স্মরণে রাখবে। চিরকাল সাহসী কলমে লাললিত হবে বিশ্বের সর্বত্র। তিনি একটি সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছেন যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন