রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাহসী ‘মুখ’ তিনি। ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর মতো অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁকে ৩১ বছরের কারাদণ্ড ও ১৫৪ বার বেত্রাঘাতের শাস্তি দেওয়া হয়। তবু মনোবল ভাঙা যায়নি।
১৯৮১-র জুনের শেষদিক। মেয়েটি তখন মাত্র ন’বছরেরে। কিন্তু এর মধ্যেই কীভাবে যেন তার জীবন দেশের অস্থির রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় মেয়েটি বাড়িতে নিজের মনে খেলছিল। তার মায়ের উৎসুক নজর ছিল টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদে। রোজ সন্ধ্যায় টিভি বুলেটিন শোনা তাঁর দৈনিন্দিন একটি জরুরি কাজ। প্রিয়জনরা কারান্তরালে থাকলে যেমনটা হয় আরকি... বিশেষ করে দেশে যখন একটি কট্টরপন্থী কতৃত্ববাদ সরকার থাকে। মেয়েটি একসময় খেলা থামিয়ে দেখলো তার মা মাটিতে আছাড়াপাছাড় খেয়ে কান্নাকাটি করছে। সে কাছে আসতে তাকে জড়িয়ে ধরে আবারও কাঁদতে থাকে মা। বালিকাটি জানতে পারে তার মামাকে মৃতু্যদণ্ড দিয়েছে আদালত। এই বালিকাই পরবর্তীকালে ইরানের মানবাধিকার আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেলন। তিনি নার্গেস মোহাম্মদি।
ইরানি বিপ্লবের প্রাক্কালে ১৯৭৮ সালে আজেরি সম্প্রদায় অধু্যষিত জানজানে শহর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একটি বড় সংঘর্ষের সাক্ষী হয়। সেই সময় একজন সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসাবে মোহাম্মদির মামাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁর মা সপ্তাহে একবার তাঁর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে যেতেন। শুনতেন ইরানের কারাগারগুলিতে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর অকথ্য অত্যাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলি। পরে মায়ের কাছে সেই সব ঘটনার কথা শুনে বড় হতে থাকেন মোহাম্মদি। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাহসী ‘মুখ’ হয়ে ওঠেন তিনি। যা তাঁকে ২০২৩ সালে শান্তি নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। নারীর অধিকারের জন্য তাঁর নিরলস সওয়াল এবং সরকারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই তাঁকে ‘আশার প্রতীক’ যেমন করে তুলেছে, তেমনই ইরানি প্রশাসনের নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুও হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু মোহাম্মদি দীর্ঘসময় জেলে কাটিয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর কণ্ঠরোধ করা যাবে না। যায় না।
নার্গেস মোহাম্মদকে ২০১০ সাল থেকে একাধিকবার বন্দী করা হয়েছে। তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে তাঁকে রাখা হয়েছে। ওই কারগারটিকে সাধারণত রাজনৈতিক বন্দীদের কেন্দ্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়। ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর মতো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মোহম্মদিকে ৩১ বছরের কারাদণ্ড ও ১৫৪ বার বেত্রাঘাতের শাস্তি দেওয়া হয়। তাতোও তাঁকে দমানো যায়নি। কারাগারে কঠোর শর্ত থাকা সত্ত্বেও, মোহাম্মদি নারী ও রাজনৈতিক বন্দীদের অধিকার রক্ষায় বারবার সরব হয়েছেন। তিনি ইরানের বিচার বিভাগের অপব্যবহার এবং কারাগার ব্যবস্থার প্রকৃত অগণতান্ত্রিক ও মানবতা বিরোধী রূপটি বিশ্বের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন। গত বছর এভিন কারাগার থেকে লেখা একটি চিঠিতে মোহাম্মদি সরকার বিরোধী বিক্ষোভের সময় আটক নারীদের যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ দেন। এই ধরনের উদ্ঘাটন ইরানী নারীদের, বিশেষ করে রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধকে চ্যালেঞ্জ করে এমন সহিংসতার দিকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সহকর্মী নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদির প্রতিষ্ঠিত ‘ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টার’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদি লিঙ্গ-ভিত্তিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে বিষয়টি নিয়ে সরব হন মোহাম্মদি। সেই সময় তিনি ফের বিশ্বব্যাপী প্রচারে আসেন। ইরানের কঠোর পোষাক বিধি অমান্য করে ঠিকমতো হিজাব না-পরে বেরোনোর অপরাধে রাস্তা থেকে মাহসাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতেই মৃত্যু হয় ইরানি-কুর্দ তরুণী বছর বাইশের মাহসার। তাঁর মৃতু্য দেশব্যাপী প্রতিবাদের জন্ম দেয়। সেই সময় মোহাম্মদি ন্যায়বিচারের দাবিতে সরব হন। কারারুদ্ধ থেকেও তাঁর সাহসী কণ্ঠস্বর ইরানী নারী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্দশার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংহতি এবং সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। নোবেল কমিটির তাকে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত তার অদম্য চেতনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের স্বীকৃতি।
সম্প্রতি, মোহাম্মদিকে চিকিৎসার জন্য এভিন কারাগার থেকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তার আইনজীবী মোস্তফা নিলি জানান, তার হাড়ের একটি টিউমার অস্ত্রোপচারের জন্য জামিন মিলেছে। যদিও টিউমারটি ম্যালিগন্যান্ট নয়, তবে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে, ভালো যত্নের প্রয়োজন।
ধারাবাহিক নিপীড়নের মুখে নার্গেস মোহাম্মদির সাহস বিশ্বব্যাপী অনুরণিত হচ্ছে। তাঁর কাহিনী মানবাধিকার রক্ষাকারীদের ত্যাগ এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে স্থায়ী লড়াইয়ের একটি অনুপ্রেরণা। তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে বিশ্ব সম্প্রদায় শুধু তাঁর প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করেনি, সেইসঙ্গে ইরানের মানবাধিকারের ভয়াবহ অবস্থার উপরেও আলোকপাত করেছে। মোহাম্মদির যাত্রা একটি সর্বজনীন সত্যকে তুলে ধরে– ন্যায়বিচার, সাম্য এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম প্রায়শই একটি মহান ব্যক্তিগত মূল্যের বিনিময়ে আসে। তবুও, এই আদর্শের প্রতি তাঁর অটল প্রতিশ্রুতি অগণিত ব্যক্তিকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বিশ্ব দেখছে, তাঁর সাময়িক মুক্তি আশার একটি মুহূর্ত, কিন্তু তাঁর স্থায়ী স্বাধীনতা এবং ইরানের সমস্ত নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য লড়াই এখনও শেষ হয়নি।
![]() |
নার্গেস মোহাম্মদি |
ইরানি বিপ্লবের প্রাক্কালে ১৯৭৮ সালে আজেরি সম্প্রদায় অধু্যষিত জানজানে শহর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একটি বড় সংঘর্ষের সাক্ষী হয়। সেই সময় একজন সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসাবে মোহাম্মদির মামাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁর মা সপ্তাহে একবার তাঁর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে যেতেন। শুনতেন ইরানের কারাগারগুলিতে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর অকথ্য অত্যাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলি। পরে মায়ের কাছে সেই সব ঘটনার কথা শুনে বড় হতে থাকেন মোহাম্মদি। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাহসী ‘মুখ’ হয়ে ওঠেন তিনি। যা তাঁকে ২০২৩ সালে শান্তি নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। নারীর অধিকারের জন্য তাঁর নিরলস সওয়াল এবং সরকারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই তাঁকে ‘আশার প্রতীক’ যেমন করে তুলেছে, তেমনই ইরানি প্রশাসনের নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুও হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু মোহাম্মদি দীর্ঘসময় জেলে কাটিয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর কণ্ঠরোধ করা যাবে না। যায় না।
নার্গেস মোহাম্মদকে ২০১০ সাল থেকে একাধিকবার বন্দী করা হয়েছে। তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে তাঁকে রাখা হয়েছে। ওই কারগারটিকে সাধারণত রাজনৈতিক বন্দীদের কেন্দ্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়। ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর মতো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মোহম্মদিকে ৩১ বছরের কারাদণ্ড ও ১৫৪ বার বেত্রাঘাতের শাস্তি দেওয়া হয়। তাতোও তাঁকে দমানো যায়নি। কারাগারে কঠোর শর্ত থাকা সত্ত্বেও, মোহাম্মদি নারী ও রাজনৈতিক বন্দীদের অধিকার রক্ষায় বারবার সরব হয়েছেন। তিনি ইরানের বিচার বিভাগের অপব্যবহার এবং কারাগার ব্যবস্থার প্রকৃত অগণতান্ত্রিক ও মানবতা বিরোধী রূপটি বিশ্বের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন। গত বছর এভিন কারাগার থেকে লেখা একটি চিঠিতে মোহাম্মদি সরকার বিরোধী বিক্ষোভের সময় আটক নারীদের যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ দেন। এই ধরনের উদ্ঘাটন ইরানী নারীদের, বিশেষ করে রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধকে চ্যালেঞ্জ করে এমন সহিংসতার দিকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সহকর্মী নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদির প্রতিষ্ঠিত ‘ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টার’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদি লিঙ্গ-ভিত্তিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে বিষয়টি নিয়ে সরব হন মোহাম্মদি। সেই সময় তিনি ফের বিশ্বব্যাপী প্রচারে আসেন। ইরানের কঠোর পোষাক বিধি অমান্য করে ঠিকমতো হিজাব না-পরে বেরোনোর অপরাধে রাস্তা থেকে মাহসাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতেই মৃত্যু হয় ইরানি-কুর্দ তরুণী বছর বাইশের মাহসার। তাঁর মৃতু্য দেশব্যাপী প্রতিবাদের জন্ম দেয়। সেই সময় মোহাম্মদি ন্যায়বিচারের দাবিতে সরব হন। কারারুদ্ধ থেকেও তাঁর সাহসী কণ্ঠস্বর ইরানী নারী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্দশার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংহতি এবং সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। নোবেল কমিটির তাকে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত তার অদম্য চেতনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের স্বীকৃতি।
সম্প্রতি, মোহাম্মদিকে চিকিৎসার জন্য এভিন কারাগার থেকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তার আইনজীবী মোস্তফা নিলি জানান, তার হাড়ের একটি টিউমার অস্ত্রোপচারের জন্য জামিন মিলেছে। যদিও টিউমারটি ম্যালিগন্যান্ট নয়, তবে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে, ভালো যত্নের প্রয়োজন।
ধারাবাহিক নিপীড়নের মুখে নার্গেস মোহাম্মদির সাহস বিশ্বব্যাপী অনুরণিত হচ্ছে। তাঁর কাহিনী মানবাধিকার রক্ষাকারীদের ত্যাগ এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে স্থায়ী লড়াইয়ের একটি অনুপ্রেরণা। তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে বিশ্ব সম্প্রদায় শুধু তাঁর প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করেনি, সেইসঙ্গে ইরানের মানবাধিকারের ভয়াবহ অবস্থার উপরেও আলোকপাত করেছে। মোহাম্মদির যাত্রা একটি সর্বজনীন সত্যকে তুলে ধরে– ন্যায়বিচার, সাম্য এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম প্রায়শই একটি মহান ব্যক্তিগত মূল্যের বিনিময়ে আসে। তবুও, এই আদর্শের প্রতি তাঁর অটল প্রতিশ্রুতি অগণিত ব্যক্তিকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বিশ্ব দেখছে, তাঁর সাময়িক মুক্তি আশার একটি মুহূর্ত, কিন্তু তাঁর স্থায়ী স্বাধীনতা এবং ইরানের সমস্ত নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য লড়াই এখনও শেষ হয়নি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন