সপ্তাহের মধ‌্যমণি : উস্তাদ জাকির হুসেন

তাঁর তবলার ধ্বনি অনন্তকাল ধরে অনুরণিত হবে, বিশ্বকে মনে করিয়ে দেবে যে ছন্দ শুধু সঙ্গীত নয়, এটি জীবনই।

সপ্তাহের মধ‌্যমণি : উস্তাদ জাকির হুসেন


বাহ তাজ!

নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশনের পর্দায় একটি চায়ের ব্র‌্যান্ডের বিজ্ঞাপনের সূত্রে আম জনতার ‘উস্তাদ’ হয়ে উঠলেন জাকির হুসেন। শুধু তা-ই নয়, ধ্রুপদি ঘরানা ঢুকে পড়ল আটপৌঢ়ের চার দেওয়ালে।

যদি কেউ প্রশ্ন করেন, উস্তাদ জাকির হুসেন তাঁর শিল্পী জীবনে ভারতের জন‌্য কোন অবদান রেখে গেলেন, তাহলে এটিই হবে তার উত্তর। এটিই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতীত্ব।

একমাথা ঝাঁকড়া চুল, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, আর তবলার ঝঙ্কার, জাকির হুসেন বলতে এই ছবিটাই আপামর ভারতীয়র মনে গেঁথে গেল সেই থেকে। তিনি তবলাবাদক, তবলচি। আমরা জানতাম গানের সঙ্গে গায়কের সঙ্গত করেন তবলচি। কিন্তু সেটাই যে একক পরিবেশনযোগ‌্য, তার ধারণাই ছিল না। পরবর্তীতে অন‌‌্য যন্ত্রসঙ্গীতে সঙ্গত করেছেন উস্তাদ হুসেন।

এই জাকির হুসেনকে আমরা চিনি। কিন্তু তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা খুব অল্প মানুষই জানেন।

জাকির হোসেন মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি প্রায়শই বলতেন যে শিক্ষাজগতে তাঁর এই সামান‌্য সময় তাঁকে শৃঙ্খলা ও ‘টাইম ম‌্যানেজমেন্ট’ শিখিয়েছে। এটি এমনটি একটি গুনাবলি যা তাঁকে আন্তর্জাতিক ক‌্যারিয়ারে ভারসাম‌্য বজায় রাখতে সাহায‌্য করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রথম দিকের দিনগুলিতে জাকির হুসেন ভারতীয় প্রবাসীদের হাউস পার্টি এবং ছোট ছোট অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতেন। প্রতি রাতে মিলত ৭৫ ডলার। কিন্তু এই অনুষ্ঠানগুলির সূত্রেই তাঁর যোগাযোগ বেড়েছে, পরিচিতি হয়েছে। পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে তিনি কনসার্ট করেছন, শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন, তার শিকড়টি কিন্তু প্রোথিত হয়েছিল সেই সময়েই।

জাকিরকে রুপালি পর্দায় অভিনয়েও দেখা গিয়েছে। ১৯৮৩-তে ‘হিট অ্যান্ড ডাস্ট’ এবং ১৯৯৭-এ ‘সাজ’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। যদিও তাঁর ভূমিকা ছোট ছিল, তার সিনেমাটিক ফ্লেয়ার তাঁর শৈল্পিক ব্যক্তিত্বে অন্য মাত্রা যোগ করে।

জন ম্যাকলাফলিনের সঙ্গে জাকিরের ‘শক্তি’ কারও অজানা নয়। তবে খুব কম লোকই জানেন জাকির হুসেন ল্যাটিন পারকাশনবাদক এবং এমনকি পশ্চিমী শাস্ত্রীয় সঙ্গীদের সঙ্গে ক্রস-জেনার সঙ্গত শুরু করেছিলেন। তাঁর অ্যালবাম ‘প্ল্যানেট ড্রাম’ ১৯৯২ সালে শ্রেষ্ঠ ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যালবামের জন্য প্রথমবার গ্র্যামি জিতেছিল। এটি তাঁর বেড়া ভাঙা শিল্প চেতনার প্রতিক।

লন্ডনের এমসিসি লর্ডস ক্রিকেট ক্লাবে জাকিরের একটি পারফরম্যান্সের কথা খুব অল্প সংখ‌্যক জানেন। সেদিন ক্রিকেট ধারাভাষ্যের সঙ্গে তবলার ছন্দ মিশ্রিত করে এক অনন্য সিম্ফনি তৈরি করেছিলেন জাকির। যা এমনকি ক্রিকেট উত্সাহীদেরও মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল।

তাঁর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও জাকির হুসেন তরুণ শিল্পীদের সময় দিতেন। নীরবে ছাত্রদের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করা, তাদের যন্ত্রের যোগান দিতে সাহায্য করা বা ট্রাগেল করা শিল্পীদের জন্য পারফরম্যান্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, এমন বহু ঘটনা রয়েছে।

জাকির হুসেনের শৈল্পিকতা কেবল ছন্দেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন তিনি। ভারত-পাক শীর্ষ সম্মেলনে শান্তির জন্য তাঁকে পারফর্ম করতে দেখা গিয়েছে যেমন, তেমনই প্রচুর মানবিক সাহায্যের জন‌্য কনসার্টে উপস্থিত থাকতেন। মহাত্মা গান্ধীর শতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে তাঁর ‘বৈষ্ণব জন তো’ গানটি স্মৃতিতে থেকে যাবে চিরকাল।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন