দেবাশিস
অস্ত্রহাতে তালিবান আফগানিস্তান দখলের পর বিশ্ববাসী সাম্প্রতিককালের ভয়ঙ্করতম শরণার্থী-যন্ত্রণার ছবিটি দেখেছে। এর কয়েকবছর আগে মায়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বাংলাদেশে। সবারই ইচ্ছা থাকে চিরচেনা গণ্ডিতে জীবনটা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু কোনও কোনও সময় পরিস্থিতি মানুষকে ভালোবাসার বন্ধন ছিঁড়তে বাধ্য করে। পূর্বপুরুশের ভিটে-মাটি ছেড়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে হয়। অভাগা মানুষগুলোর সামনে প্রতিনিয়ত তখন শুধুই অনিশ্চয়তা। তার যেন কোনও দেশ নেই। সে ভারী যন্ত্রণার। যে মানুষটিকে শিকড় উপড়ে সেভাবে দেশত্যাগ করতে হয়, একমাত্র সেই জানে সে যন্ত্রণা!
আবদুলরাজাক গুরনাহর লেখার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে ঔপনিবেশিকতার দুর্দশা, ফুটে উঠেছে শরণার্থীর সেই যন্ত্রণা। চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ–তানজানিয়ান কথাসাহিত্যিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ। সাহিত্যে ‘আপোষহীন ও নিবিড়ভাবে’ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব ও উপসাগরীয় অঞ্চলে শরণার্থীদের জীবন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিনি এই সম্মান পেলেন তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’-এর জন্য।
৭৩ বছর বয়সী গুরনাহ সর্বসাকুলে্য দশটি উপন্যাস লিখেছেন। এর মধ্যে তাঁর ‘প্যারাডাইস’ অন্যতম। উপন্যাসটি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ‘বুকার পুরস্কার’ ও ‘হুইটব্রেড’ পুস্কারের জন্য শর্টলিস্টেডও হয়েছিল। উপন্যাসটি বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তানজানিয়ার কাল্পনিক শহর কাওয়াতে জন্ম নেওয়া ছেলে ইউসুফের গল্প। ইউসুফের বাবা একজন হোটেল ব্যবসায়ী এবং আজিজ নামে একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী আরব বণিকের কাছে ঋণগ্রস্ত। গল্পের প্রথম দিকে বাবার ঋণ পরিশোধের জন্য ইউসুফকে আজিজের কাছে বিনা পারিশ্রমিকে কাজে যোগ দিতে হয়। ইউসুফ যখন আজিজের দলে যোগ দেন, সেই সময় আজিজের নেতৃত্বে বণিকদলটি মধ্য আফ্রিকা এবং কঙ্গো অববাহিকার কিছু অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এটা সেই সমস্ত অঞ্চল, যেখানে অনেক প্রজন্ম ধরে কেউ বাণিজ্য করতে আসেনি। এখানে, আজিজের বণিক দলটিকে স্থানীয় উপজাতি, বন্যপ্রাণী এবং কঠিন ভূখণ্ডের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। এরপ যখন আজিজের দল পূর্ব আফ্রিকায় ফিরে আসে, ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। জার্মান সেনাবাহিনী তানজানিয়ায় ঝঁাপিয়ে পড়লে আজিজ তাদের প্রতিরোধে নামে। জোর করে আফ্রিকান পুরুষদের সৈন্য হিসাবে নিয়োগ করে আজিজ।
গুরনাহ এমন একজন কথাসাহিত্যিক যাঁর সাহিত্য বরাবর আনুপূর্ব সত্যান্বেষণে উন্মুখ। প্রথাগত বর্ণনার সরল অভিমুখ থেকে সরে এসে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শোষণের শিকার শিকড় থেকে উৎপাটিত, উদ্বাস্তু মানুষের অসহায়তার কার্যকারণ সূত্র উদ্ঘাটনে বিস্ময়কর বিশ্লেষণে পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘মেমরি অফ ডিপার্চার’ থেকে গত বছর প্রকাশিত ‘আফটারলাইভস’ পর্যন্ত সকল রচনায় তিনি মানুষের পার্থিব অস্তিত্বের নিগূঢ় কারণ অনুসন্ধান করে ফিরেছেন। তিনি বারবার দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে শাসিত মানুষের মনন, দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতিতে ঔপনিবেশিকতার কালোছায়া দীর্ঘকাল বিদ্যমান থাকে। তিনি আরও প্রমান করেছেন যে আফ্রিকায় দাসপ্রথা ইউরোপীয়দের আগমনে পূর্ব থেকেই চালু ছিল।
চিনুয়া আচেবে থেকে শুরু করে গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, প্রায় সকল আফ্রিকীয় লেখক তাঁদের সাহিত্যে ঔপনিবেশিকতার একটি জাতীয়তাবাদী উপাখ্যান উপস্থাপন করেছেন। গুরনাহের উপন্যাসের অভিমুখ কিন্তু মোটেই তেমনটা নয়, বরং যেখানে তিনি ব্যক্তিমানুষের অস্তিতসংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন। পরাধীন মানুষের অসহায়ত্ব, বাস্তুচ্যূতি, অভিবাসন, আত্মপরিচয়ের সংকট ও বাধ্যতামূলক বিবর্তন, সম্মান ও মার্যাদাহানি ইত্যাদি নানা বিষয়-আশয় তাঁর রচনার কেন্দ্রে স্থান করে নিয়েছে। মানুষ কীভাবে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তা নানা ভাবে চিত্রিত হয়েছে গুরনাহের লেখায়। ভিন দেশে গিয়ে বসতি স্থাপনকারী মানুষের ‘বিদেশী’ পরিচয় কখনও মুছে যায় না। প্রকৃতপক্ষে, দেশ ছেড়ে আসা মানুষ মৃত্যু পর্যন্ত নিরাশ্রয়ই থেকে যায়। দেশ ছেড়ে এসে দারিদ্র, শত্রুতা, বা প্রতিকূলতার দুর্দশার ললাটলিখন থেকে পরিত্রাণ মেলে না।
গুরনাহকে ১৮ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ৭৩ বছর বয়সে পৌঁছেও দেশত্যাগের ব্যাথা, অনিশ্চিত জীবনের মর্মব্যাথা তঁার মধে্য সজীব। গতবছর প্রকাশিত তঁার সর্বশেষ উপন্যাস ‘আফটারলাইভস’ পাঠক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ উপন্যাসের একটি চরিত্র হামজা দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে এই বলে ফুঁপিয়ে ওঠে, “এত চিৎকার, এত আর্তনাদ, এত রক্তক্ষরণ’। এই শব্দগুচ্ছ যেন দীর্ঘকাল ঔপনিবেশক শাসনে থাকা আফ্রিকা মহাদেশের পরাধীন জনসত্তার করুণ প্রতিচ্ছবি। ঔপনিবেশ-পূর্ব, ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশ তিন প্রজন্মের কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘আফটারলাইভস’। গুরনাহ এ উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন কীভাবে পরাধীনতার অবসান হলেও ঔপনিবেশিক শাসনের অপচ্ছায়া প্রলম্বিত হয়ে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা চলে গেলেও থেকে যায় ‘চিৎকার, আর্তনাদ ও রক্তপাত’।
একটিমাত্র উপন্যাসে গুরনাহের মূল্যায়ন সম্ভব নয়। লেখনশৈলীর বৈশিষ্ট হল বিভিন্ন চরিত্রের সমবায়ে একটি গল্পবিশ্ব গড়ে তোলা– যা নানা স্থান, বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং বর্ণময় চরিত্রের মানুষের বর্ণনায় সমৃদ্ধ। তার উপন্যাসের আখ্যানভাগ একই সঙ্গে কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে আকর্ষণীয়। নানা ঘটনা ও দুঘর্টনার অনুপুঙ্খ বর্ণনায় উপন্যাসের অবয়ব বিকশিত হয়। সংলাপ ব্যবহার করেন তিনি কেবল কাহিনীর প্রয়োজনে, অপরিহার্যভাবে। গতিময় বর্ণনায় তার চরিত্রগুলি উপন্যাসের কলেবরে বাস্তব হয়ে ওঠে। তার ভাষা প্রাঞ্জল ও মনোহর।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন