নোবেল বিজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাই দ্য সি’-তে এক জয়াগায় লতিফ মাহমুদ চিন্তা করে, “এটা হলো সেই বাড়ি যেখানে আমি বাস করি, এটা হলো সেই ভাষা যেটা, প্রত্যেক তৃতীয় প্রান্তের পিছনে দাঁড়িয়ে, আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে ও তিরস্কার করে।”
এক শরণার্থীর অব্যক্ত বেদনা, এক ছিন্নমূল মানুষের কান্না একজন শরণার্থী ছাড়া আর কে-ই বা এভাবে বর্ণনা করতে পারেন। দেশভাগের পর বাংলাদেশ থেকে চলে আসা উদ্বাস্তু, সিরিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরের ডিঙ্গায় ভেসে যাওয়া ভবিষ্যৎ, মায়ানমার থেকে তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে লুকিয়ে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গা জনজাতি, কিংবা হালফিলে তালিবান দখল নেওয়া আফগানিস্তান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে ইউরোপের কোনও শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর কণ্ঠস্বর এক। এমনই। একা কান্নার কোনও ভাষা হয় না।
উপনিবেশবাদের কারণে মানুষের দুর্দশা ও শরণার্থী জীবনের ঘটনা আপসহীন ও করুণভাবে চিত্রিত করার জন্য আবদুলরাজাক গুরনাহকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। নোবেল কমিটি ফর লিটারেচার এক বিবৃতিতে বলেছে, “আদুলরাজাক গুরনাহর উপন্যাস গৎবাঁধা বর্ণনার বাইরে। উপন্যাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিশ্বের অন্যান্য অংশের মানুষের কাছে সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।” ১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার ভারত মহাসাগর ঘেঁষা দ্বীপ জানজিবারের এক সাধারণ পরিবারে গুরনাহর জন্ম। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। কিন্তু তৎকালীন উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ১৯৬৮ সালে জানজিবার ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন তিনি। ওই আন্দোলনের কারণে আবর বংশোদ্ভূতদের উপর নেমে আসে নির্মম দমনপীড়ন। সেই কাহিনীই গুরনাহর লেখার উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রিটেনে থিতু হয়ে গুরনাহ যখন লেখালেখি শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স ২২। জীবন থিতু হয়েছে বটে, কিন্তু কখনওই তিনি শিকড় ভোলেননি। ব্রিটেনে বসবাসের পরও তিনি তার মাতৃভাষা ছাড়েননি। ওই ভাষা ছিল তার যোগাযোগর প্রধান মাধ্যম। সাহিত্যচর্চা অবশ্য ইংরেজিতেই।
১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় জানজিবার। কিন্তু ১৯৮৪ সালের আগে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। শুধু বাবার মৃতু্যর পর তিনি একবার গিয়েছিলেন নিজ দেশে। গুরনাহ সম্পর্কে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বলছে, “সত্যের প্রতি, আবদুলরাজাক গুরনাহর যে নিষ্ঠা, ঘটনার অতি সরলীকরণে তার যে ঘোর আপত্তি পাঠককে তা নাড়া দেয়। তাঁর উপন্যাস গতানুগতিক ধারা বর্ণনার রীতি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দৃষ্টির সামনে মেলে ধরেছে সংস্কৃতি বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এক পূর্ব আফ্রিকাকে– যার সঙ্গে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের কোনও মিল নেই। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা নিজেদের আবিষ্কার করে সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতি, মহাদেশ থেকে মহাদেশের মাঝে কোনও এক শূন্য রেখায়, যে জীবন তাদের ছিল আর যে জীবন তাদের সামনে ভাঁজ খুলতে শুরু করেছে, তার মাঝে এক অবলম্বনহীন অস্তিত্বে তারা নিজেদের খুঁজে পায়, এই অনিশ্চয়তার কোনও সমাধান নেই। তিনি যখন ইংল্যান্ডে আসেন, ‘আশ্রয়প্রার্থী’ বা এ রকম শব্দগুলোর অর্থ তখন আজকের মতো ছিল না। এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৬০-এর সেই সব দিনের চেয়ে আজকের পৃথিবীতে হিংসা অনেক বেশি। ফলে যেসব দেশে জীবন নিরাপদ বলে মনে করা হয়, তাদের উপর চাপও বেশি। অবধারিতভাবে অনেক বেশি মানুষ এখন সেসব দেশে যাচ্ছে আশ্রয়ের আশায়।”
আবদুলরাজাকের প্রথম তিনটি উপন্যাস হচ্ছে ‘মেমোরি অব ডিপার্চার’ (১৯৮৭), ‘পিলগ্রিমস ওয়ে’ (১৯৮৮) এবং ‘দোতেই’ (১৯৯০)। এই তিনটি উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে শরণার্থী বিষয়ক অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য ইসু্য। তার চতুর্থ উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’ যেটি লেখা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক পূর্ব আফ্রিকাকে ঘিরে। এটি বুকার প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিল। অবশেষে সেই উপন্যাসই তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দিল। ১৯৯৬ সালে তার উপন্যাস অ্যাডমাইরিং সাইলেন্সে উঠে আসে এক তরুণের জানজিবার ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে প্রবেশ, বিয়ে ও শিক্ষক হওয়ার গল্প। ২০ বছর পর নিজ দেশে ফিরে বিয়ে এবং জীবনবোধের গল্প নিয়ে লেখেন ‘বাই দ্যা সি’ (২০০১) যেটি সালেহ ওমর নামে এক আশ্রয়হীন বালকের কথা, যে সমুদ্রের পাশের এক শহরে বাস করে।
ঔপনিবেশিকবাদ, দাসত্বের বেড়াজালে আত্মপরিচয় এবং দেশান্তরের বিষয়গুলি স্থান পেয়েছে আবদুলরাজাকের সমস্ত সাহিত্যকর্মে। শরণার্থীদের জীবন কীভাবে বদলে যায়, নতুন জীবনের সঙ্গে কীভাবে অভিযোজন রপ্ত করে, কীভাবে জীবনকে প্রভাবিত করে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, এসবই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর লেখায়।
২০০৪ সালে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক নিবন্ধে আবদুলরাজাক বলেন, জানজিবারে থাকার সময় তাঁর সাহিত্যিক হওয়ার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডে এসে বুঝতে পারলেন তার ফেলে আসা জীবনের কাহিনী তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি। ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার পাশাপাশি চলতে থাকে সাহিত্যচর্চা। গুরনাহর জীবনের বাঁক বদলে দেয় তার উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি দারুণ প্রশংসিত হয়। উপন্যাসটিতে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তানজানিয়ায় এক বালকের বেড়ে ওঠার গল্পের বর্ণনা করা হয়েছে নিপুণভাবে। মনে হয়, লেখক তাঁর নিজের জীবনী-ই তুলে ধরেছেন এখানে।
আবদুলরাজাক তাঁর ছেলেবেলায় দেখেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে থাকা সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ জীবন। বড় হয়ে সহ্য করেছেন শরণার্থী জীবনের কষ্ট। সেই অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের লেখায়, তুলে ধরেছেন বিশ্বাবাসীর সামনে। বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে সংঘাত, হিংসা ও রাজনৈতিক কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে এসব মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার, নিজ মাতৃভূমি থেকে হয়েছেন বিতাড়িত। এর আন্তর্জাতিক সমাধান প্রয়োজন। আবদুলরাজাক গুরনাহ মনে করেন, এই পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে হয়তো বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট আর ঔপনিবেশিকতাবাদের দুষ্ট ক্ষত একদিন আলোচনায় আসবে। প্রকৃত আলোচনায় এলে সমাধানের পথও হয়তো ক্রমশ বের হবে। কিন্তু সমাধান দরকার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন