শক্তির উৎস সন্ধানে। দেবাশিস কর্মকার । পর্ব-১

Shakti Utsa Snandhane


দেবাশিস কর্মকার

পর্ব-১

সরু পিচের রাস্তাটা অন্ধকার থাকলেই বেশি মানাতো। ধিঙ্গিপানা সরু ল‌্যাম্পপোস্টের মাথায় বাল্বের টিমটিমে আলো আরওই বিরক্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে। তবু ইতিউতি লোকজনের জটলা। চাপাস্বরে কী আলোচনা চলছে, সবাই খানিক আতঙ্কিত কি! ছাপা কমদামী ইজের পরা আদুল গায়ের ছেলেটির অবশ‌্য নিজের খেয়ালে তিড়িং-তিড়িং করে লাফাচ্ছে। সব সময় ও অমনই লাফায়। দাঁড়াতে শেখার পর থেকে আড়াই বছরে তাকে কেউ কখনও স্থির হতে দেখেনি। ঘুমিয়েও না। তার হাতের কচি আঙুলগুলো বাবার শক্ত হাতে চেপে ধরা। লাফাতে-লাফাতে কখন কী বিপদ বাধায় কে জানে!

মসজিদের সবুজ রঙা কাঠের দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন মৌলবী সাহেব। পরনের সাদা লম্বা জোব্বাতে তাঁকে আবছা আলোতেও বেশ ঠাওর করা যাচ্ছে। ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জ্বর কমেছে? এখন কেমন আছে?

বাবা বললেন, ‘দেখছেনই তো...না হলে কী আর...’

মৌলবী সাহেব মেহেন্দি করা দাড়িতে হাত ঘষে বললেন, ‘সাবধানে রাখবেন, দিনকাল তো বিশেষ সুবিধার নয়...’

দু’দিন আগেই সন্ধ‌্যার পর ধুম জ্বর নিয়ে ছেলেটি  বাবার সঙ্গে এসেছিল এই মসজিদে। বাবার হাতে ছিল স্টিলের গ্লাসে ভর্তি জল।  মৌলবী সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন তখন। আজানের পর জল পড়ে দিয়েছিলেন। ততক্ষণ, জ্বরে কাহিল ছেলেটি অসীম ধৈর্য নিয়ে কাঠের বেঞ্চে বাবার পাসে বসেছিল। সেই জলপড়া মা দিনে তিনবার করে খাইয়েছে। তাতেই...

মৌলবী সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন পাথরের স্ল‌্যাবের উপর। তার নীচেই পাঁকে পূর্ণ অগভীর কাঁচা ড্রেন। রাস্তার দক্ষিণ দিকে সারবাঁধা ঘরবাড়ির পিছনে আবার এঁদো খাল। এই পচা ভাদ্রতে নর্দমা আর সেই এঁদো খাল দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ছেলেটির আদুল গায়ে, পায়ে মশা বসছে। ছেড়ে থাকা হাত অনবরত বুকে-পিঠে চালিয়ে ছেলেটি মশা তাড়াচ্ছে। পায়ে পায়ে পা ঘঁষছে মাঝে মাঝে। এখন তার মৌলবী সাহেব আর বাবার মধ‌্যে কী কথা হচ্ছে, তাতে কান নেই। থাকার কথাও নয়। তার চোখ চারদিকে পাক খেতে খেতে পূর্বাঞ্চল উদ্বাস্তু উচ্চপ্রাথমিক বিদ‌্যালয়ের দালানে আটকে গেছে। আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে মোড়া কী ওগুলো? নাকি মুখটুকু বেরিয়ে আছে? মানুষ, নাকি পুতুল? স্কুলের হলুদ সিমন্টের উঠোনে শোয়ানো। সারবাঁধা, চারটে। কিংবা চারজন।

বাবার হাতের বাঁধনটা বড্ড শক্ত। পা লেংচে মাথা উঁচু করে ভালো করে দেখার চেষ্টা বৃথা। সামনের কালো কোলাপসিবল গেট টেনে দেওয়া হয়েছে। তার সামনে ক্রমে ভীড় জমে গেছে। স্কুলবাড়ির কার্নিস থেকে ঝুলে আসা বাল্বের আলোটা ক্রমে ঢেকে যায়। হাফপ‌্যান্ট পরা পুলিশ...মোটা লাঠি...বন্দুক..., ভারী বুটের শব্দ। ছেলেটির গোলপাকানো চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ঘুরতে থাকে। স্কুলের ভারী লোহার গেট ধরে কারা যেন ঝাঁকুনি দিচ্ছে, প্রচণ্ড সে ঝাঁকুনি। যেন এখনই সেটা সবশুদ্ধু ভেঙে পড়ে যাবে। আহা...কী আর্তনাদ...আমার রাখালকে ফিরিয়ে দাও...ফিরিয়ে দা-ও-ও-ও...। কে কাঁদে?

কে রাখাল? কে নিয়ে গেল? কাদের সঙ্গেই বা গেল?

কুচকুচে কালো রঙের দামড়া গাড়িটা তীব্র কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে গেল।

চোখ জ্বালা করছে। নাকে পেট্রোল পোড়া তীব্র গন্ধ। যেন কেউ গ‌্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে রেখেছে আমাকে। আর সিনেমার মতো এতক্ষণ এসব দেখাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে গেল। তারপরেও বেশি অনেকক্ষণ সিলিংয়ের দিকে চেয়ে শুয়ে রইলাম। আবছা নীল আলো ছড়ানো আমার বেডরুমে ফিরে আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। লম্বা শ্বাস নিলাম। এসির মধ‌্যেও ঘেমে গেছিলাম। চাদর সরিয়ে ফেলাতে এখন আরাম পাচ্ছি। পাশ ফিরে দেখলাম ঋতু ঘুমচ্ছে। ঘুমের ওষুধ খায় তো, তাই শুলেই ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আবার ঘুম আসা মুশকিল।

আমি সন্তর্পনে উঠে বাথরুম সেরে এসে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। এখান রাত সাড়ে তিনটে বাজে। আবার ঘুম আনার চেষ্টা করতে হবে।

আজকাল মাঝেমাঝেই রাতে ঘুমের মধ‌্যে এই স্বপ্নটা দেখছি। এই নিয়ে আজ তিন দিন। সত‌্যিই কী এ স্বপ্ন?

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন