ভারতীয় ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের একটি বড় তাৎপর্য রয়েছে কারণ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশরা সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করেছিল, যার পরে ক্রমে সমগ্র দেশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আনা হয়েছিল।
“বহু দিন ধরে' বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি,বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”
ভারতের ঐতিহাসিক স্থানগুলি চিরকালই বাঙালি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে, অনেক বাঙালিই বাংলার ঐতিহাসিক স্থানগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও, সেগুলিতে বেড়াতে যাওয়ার তাগিত অনুভব করেন না। বাংলার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। কম খরচে, অল্পদিনের ছুটিতে এবার শীতে সেই ঐতিহাসিক জায়গাগুলো ঘুরে দেখা যেতে পারে। আর বাংলার ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল নবাবী শাসনামলের কেন্দ্রস্থল মুর্শিদাবাদ।
‘মুর্শিদাবাদ’ নামটি ‘মুকসুদাবাদ’ নামে পরিচিত স্থান থেকে এসেছে যা মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনামলে বাংলার রাজধানী ছিল। ব্রিটিশদের আবির্ভাবের আগে মুর্শিদাবাদ শহর ছিল বাংলার রাজধানী। ভারতীয় ইতিহাসে এর একটি বড় তাৎপর্য রয়েছে কারণ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশরা সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করেছিল, যার পরে ক্রমে সমগ্র দেশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আনা হয়েছিল। ইংরেজদের বাংলা জয়ের পরও মুর্শিদাবাদ কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনিক কেন্দ্রের মর্যাদা পেয়েছিল। শহরটি এখনও মসজিদ, সমাধি এবং বাগান সহ নবাবদের স্মৃতি বহন করে এবং হাতির দাঁতে খোদাই, সোনা ও রূপার সূচিকর্ম এবং রেশম বয়নের মতো শিল্পগুলি ধরে রেখেছে। ঐতিহাসিক আগ্রহের মধ্যে রয়েছে নিজামত কিলা (নবাবদের দুর্গ) যা হাজারদুয়ারি প্রাসাদ, মতিঝিল, মুরাদবাগ প্রাসাদ এবং খোশবাগ কবরস্থান রয়েছে। মুর্শিদাবাদ আজ কৃষি, হস্তশিল্প এবং রেশম চাষের কেন্দ্র।
১) মুর্শিদাবাদের কথা উঠলেই সবার মুখে প্রথম আসে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের কথা। এই বিশাল প্রাসাদ, যা প্রায় ৪১ একর জুড়ে এবং ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত, মুর্শিদাবাদ বা এমনকি বাংলার অন্য সব স্থাপতে্যর থেকে আলাদা। বিশালকার ভবনে ১০০০টি প্রবেশপথ রয়েছে বলেই ‘হাজারদুয়ারি’ নামকরণ হয়েছে। বাস্তবে, আসল-নকল মিলিয়ে হাজারটি দরজা, নকলগুলি বিভ্রান্ত করার জন্য।
২) ভাগরথী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত মনোরম প্রাসাদটি ‘কিলা নিজামত’ নামে পরিচিত। প্রাসাদের বাইরের দিকে ‘নিজামত ইমামবাড়া’, ‘ওয়াসিফ মঞ্জিল’, ‘বাচ্চাওয়ালি গম্বুজ’, এবং ‘মুর্শিদাবাদ ক্লক টাওয়ার’ রয়েছে। কিলা নিজামত প্রাসাদটি অতীতে একটি রাজকীয় বাসস্থান ছিল। আজ প্রথম দুর্গটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ভাগীরথীর জলে তলিয়ে গিয়েছে। এখানে সিরাজ-উদ-দৌলার মূল্যবান তরবারিসহ বাংলার নবাব, অভিজাত ও ব্রিটিশ শাসকদের গৃহস্থালির জিনিসপত্র ও শখের জিনসিপত্র রাখা হয়েছে।
৩) কাঠগোলা বাগান একসময় জগৎ শেঠের বাগানবাড়ি ছিল, যিনি মুর্শিদাবাদের একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। এটি মুর্শিদাবাদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। জগৎ শেঠের কাঠের ব্যবসার কারণে এই জায়গাটির নাম হয়েছে কাঠগোলা বাগান। সে সময় বিদেশি ও বাঙালি অভিজাতরা প্রায়ই আসতেন এখানে।
এই বিশাল প্রাসাদে কিছু আশ্চর্যজনক স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে যা যে কোনও সাধারণ মানুষকে অবাক করে দেবে। সুবিশাল প্রাসাদ, বিস্তৃর্ণ উদ্যান, জলাশয়, আদিনাথের মন্দির, মাইকেল এঞ্জেলোর একটি মূর্তি মন টানে। জগৎ শেঠের বাগানবাড়ির সঙ্গে সংযোগকারী একটি বিশাল সুড়ঙ্গ ছাড়াও ভাগীরথীর জল সুড়ঙ্গটিকে দুর্গম করে তুলেছে।
৪) ‘মতিঝিল’ আসলে একটি প্রাসাদ এবং একটি হ্রদ ছিল। এই মনোরম হ্রদটি খনন করিয়েছিলেন ঘশেটি বেগম। প্রাসাদ ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও হ্রদটি রয়ে গেছে আজও। মতিঝিল পরে লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ প্রভুদের বাসস্থান হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ আধিকারিকদের সঙ্গে এর সংযোগের কারণে, এটি সাধারণত ‘কোম্পানি টাইগার’ নামে পরিচিত ছিল।
৫) ‘ওয়াসিফ মঞ্জিল’ প্রাসাদটি মুর্শিদাবাদের নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা খান নির্মাণ করেছিলেন। হাজারদুয়ারির দক্ষিণে অবস্থিত এবং অনেক পরে নির্মিত এই প্রাসাদটিকে ‘নিউ প্যালেস’ নামে পরিচিত। ১৮৬৭ সালের ভূমিকম্পের প্রভাবে মূল প্রাসাদটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। এই প্রাসাদটির চারপাশ এতটাই অত্যাশ্চর্য যে সেখানে একটি কৃত্রিম পাহাড়ও তৈরি করা হয়েছিল। পাহাড়টি পুনর্নির্মাণ করা হয়নি, তবে প্রাসাদটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল।
৬) ‘কাটরা মসজিদ’ মুর্শিদাবাদের আরেকটি আকর্ষণীয় এবং সু-পরিচালিত পর্যটন কেন্দ্র। মুর্শিদকুলী খাঁর অনুগামী মুরাদ ফরাশ খান ১৭২৪ সালে এই মসজিদটি তৈরি করেন। মুর্শিদকুলি খাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাকে মসজিদের পূর্ব দিকের সিঁড়ির নিচে সমাধিস্ত করা হয়।
সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধি ছাড়াও রানীভবনীর চারমন্দির, জগদ্বন্ধু ধাম, কিরীটেশ্বরী মন্দির, জাহানকোষা কামান, জগৎ শেঠের বাড়ি এবং আজিমুন্নেসার সমাধি ইত্যাদি অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন