চরে নৌকা ভিড়লে তিনিই সবার আগে নৌকা থেকে নামবেন৷ বাউলে হাওয়ার গন্ধ শুঁকে বলতে পারেন, তিনি কতদূরে আছেন। আশপাশে থাকলে উচ্চৈস্বরে মন্ত্র বলে তেনাকে দূরে পাঠিয়ে দিতে পারেন।
লিখছেন দেবাশিস কর্মকার।
মধ্য ডিসেম্বরের হাড় হিম করা শীত৷ কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি৷ সজনেখালি থেকে চলেছি বন দফতরের লঞ্চে৷ গন্তব্য পঞ্চমুখানি৷ এখন সুন্দরবনের জঙ্গলে চলছে বাঘশুমার৷ কয়েকটি টিমে কাজ হচ্ছে৷ ভোর থেকে নদীর চড়ায় চলে ‘খোঁচ’-এর সন্ধান৷ নদীতে জোয়ার আসার আগেই শেষ করতে হয় সেই কাজ৷ আমি এই রকম একটি টিমের সঙ্গী৷ পঞ্চমুখানিতে রয়েছে আরও একটি টিম৷ সেখানকার কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন দায়িত্বে থাকা বন আধিকারিক৷ সঙ্গ ধরেছি তাঁর৷ চরিদিক কুয়াশায় ঢাকা৷ খানিক দূরের কিছুও ভালভাবে ঠাওর করা যায় না৷ তাই লঞ্চ চলেছে মন্থর গতিতে৷ চালকের কেবিনে একজন দেহাতি সারেঙ পাথরের মূর্তির মতো স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে৷ লঞ্চের দুই দিকে দু’জন বন্দুকধারী রক্ষী৷ মোটরের একটানা গোঙানির আওয়াজে মাথা ঝিম-ঝিম করে৷
তেনার খোঁজে
সুন্দরবনের নদীতে লঞ্চগুলো সোজাপথে চলে না৷ সাপের মতো ঘুরে ঘুরে চলে৷ নদীর মাঝে জেলেদের মাছ ধরার জাল পাতা থাকে৷ সোজা যেতে গেলে জাল ছিঁড়ে যাবে৷ তাই সেগুলিকে বাঁচিয়ে এভাবেই চলতে হয়৷ উত্তরে হাওয়াতেও মাঝনদীতে অত্যন্ত গুমোট লাগে৷ চড়ার কাছে লঞ্চ ঘেঁষলেই আমার কৌতূহলী চোখ খোঁজে ‘তেনাকে’৷ এ সময় তিনি নাকি নদীতে আসেন জল খেতে! কিন্ত্ত ভাগ্য সহায় না হলে দেখা মেলে না৷ ‘তুমি তাঁকে দেখতে না পেলেও, তিনি তোমার ওপর নজর রেখেছেন৷’ –অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ৷ এখানে তাঁর নাম মুখে আনা নিষিদ্ধ৷ হয় ‘তিনি’ বলতে হবে, নয়তো ‘বড়মিঞা’৷ তিনি সোঁদরবনের বাঘ৷ নদীর জলে ফসফরাস আছে৷ এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে জলের স্রোতে ঝিকিমিকি৷ কোনও সময় নদীর একদিকে জঙ্গল, অন্যদিকে লোকালয়৷ পরক্ষণেই আবার বদলে যায়৷ মাঝে মাঝেই লোকালয়ের দিক থেকে আসে বাজি ফাটানোর বিকট শব্দ, খানখান হয়ে যায় নিশুতি রাতের স্তব্ধতা৷ তেনাকে লোকালয় থেকে দূরে রাখার নিরীহ চেষ্টা৷
সংঘাত
উৎসব-হীন রাতে এই আতস-মেলা সুন্দরবনে বাঘ-মানুষ সংঘাতেরই প্রতীক৷ দ্বীপপুঞ্জের এই সংঘাত ততটাই পুরনো, যত পুরনো সুন্দরবনে জঙ্গল কেটে আবাদ করার ইতিহাস৷ জঙ্গলে মানুষের অনধিকার প্রবেশ এবং লোকালয়ে বাঘের চলে আসা– এখানে বাঘ-মানুষ সংঘাতের দু’টি ক্ষেত্র৷ সংঘাতের জন্য কিছুদিন আগে পর্যন্ত সুন্দরবনের বাঘকে ‘মানুষখেকো’ বলে বদনাম করা হত৷ কিন্ত্ত কোনও গবেষণাতেই সেই দাবির পক্ষে তেমন কোন বলিষ্ঠ প্রমাণ মেলেনি৷
জঙ্গলের গল্প
২৫৮৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প৷ দেশের পনেরোটি ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্যতম৷ ১৯৭৩ সালে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ব্যাঘ্র প্রকল্পের কাজ শুরু হয়৷ ব্যাঘ্র প্রকল্পের ১৩৩০ বর্গকিলোমিটার কোর এলাকা জাতীয় উদ্যান হিসাবে চিহ্নিত৷ এই জাতীয় উদ্যানের পরিধি হল, পূর্বে হরিণভাঙা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে মাতলা নদী ও উত্তরে নেতিধোপানি, চমটা, চাঁদখালি ও বাঘমারা ফরেস্ট ব্লক৷ বহু শতাব্দী ধরেই ‘নরখাদক’ বাঘের জন্য সুন্দরবন সুবিদিত৷ ১৬৬৫-৬৬ সালের সুন্দরবন ভ্রমণের বিবরণে ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়ঁা বার্নিয়ে লিখেছিলেন, দ্বীপগুলির অনেক জায়গাতেই ছোট দাঁড়নৌকা থেকে নামা বিপজ্জনক৷ রাতে গাছের সঙ্গে বাঁধা নৌকা তীর থেকে খানিকটা দূরে রাখা হয়৷ কারণ প্রায়ই কেউ না কেউ বাঘের শিকার হয়৷ মাঝিরা ঘুমিয়ে থাকলে সুযোগ বুঝে নৌকায় উঠে কোনও একজনকে তুলে নিয়ে যেতে সুন্দরবনের বাঘ পটু৷ সুন্দরবনে বাঘ-মানুষ সংঘাতের কারণ হিসাবে এখানে ব্যাঘ্র প্রকল্প ও লোকবসতির নিবিড়তার কথা বলা হয়৷
সুন্দরবনের জঙ্গলে প্রবেশের হাজারো নিয়ম৷ সজনেখালিতে একটি মন্দির রয়েছে৷ সেখানে অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীরা হলেন বনবিবি, দক্ষিণরায় এবং কালু শেখ৷ সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাস, তঁারা জঙ্গলে বাঘ ও সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন৷ সেখানে পুজো না করে কেউই জঙ্গলে প্রবেশের কথা চিন্তাও করে না৷ বৈধভাবে জঙ্গলে প্রবেশ করতে হলে সজনেখালির ফরেস্ট বিটের অফিসে নির্দিষ্ট বনদফতরের অনুমতি নিতে হয়৷ তখন সঙ্গে দেওয়া হয় দু’জন বন্দুকধারী রক্ষী৷ নিজস্ব অস্ত্র নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ বেআইনি৷ অবশ্য জঙ্গলে বাঘের আক্রমণের মুখে পড়লে সেই রক্ষীরও গুলি করে বাঘকে ঘায়েল করার অনুমতি নেই৷ তারা শূন্যে গুলি চালিয়ে বাঘকে তাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে মাত্র৷ আর দলের সঙ্গে থাকেন একজন ‘বাউলে’। সুন্দরবনের এই সব অঞ্চলে তঁাদের প্রচণ্ড খাতির৷
চরে নৌকা ভিড়লে তিনিই সবার আগে নৌকা থেকে নামবেন৷ বাউলে হাওয়ার গন্ধ শুঁকে বলতে পারেন, তিনি কতদূরে আছেন। আশপাশে থাকলে উচ্চৈস্বরে মন্ত্র বলে তঁাকে দূরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। জঙ্গলচারীদের দৃঢ় বিশ্বাস, বড়মিয়া বাউলের বাধ্য৷ তাই বৈধ হোক বা অবৈধ, প্রত্যেক জঙ্গলযাত্রায় দলে একজন বাউলে থাকা অবশ্য জরুরি৷
বাউলের মন্ত্রোচ্চারণপর্ব মিটলে, দু’চারজন চড়ায় নেমে আতস বাজি ফাটাবে৷ সাবধানের তো মার নেই। বাউলের মন্ত্র কাজে না এলে বাজির বিকট শব্দে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি। তারপর বাকি সবাই নৌকা থেকে নামাই বিধেয়৷ জঙ্গলে প্রবেশে এভাবেই বহুস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্হা অবলম্বন করা হয়ে থাকে৷ এরপরও বাঘের গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে মাটির মুখোশ কিংবা ‘টাইগার্ড’ নামে ফাইবারের তৈরি একপ্রকার শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করা হয়৷ সঙ্গে রাখা হয় হেঁতালের ডালও।
মাটির নিকানো দাওয়ায় উবু হয়ে বসে ছিলেন মনোরঞ্জন হাজরা৷ বয়স শুনলে বৃদ্ধ তঁাকে মোটেই বলা চলে না৷ তবে চেহারা তা মানে না৷ শরীর ভেঙে গিয়েছে মধ্য চল্লিশেই৷ চোখ দু’টো বড় শুষ্ক, আর ভাষাহীন৷ একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে৷ সঁদা গন্ধের আঘ্রাণে এক অদ্ভুত ভাল লাগা৷ এখানে বৃষ্টি হলে মাটি অত্যন্ত পিচ্ছিল হয়ে যায়৷ সতর্কভাবে না চললে ‘আলুর দম’ হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না৷ অবশ্য পরক্ষণেই জল শুষে নেয় মাটি৷ তখন আর পায়ে কাদাও লাগে না৷
মনোরঞ্জন শোনাচ্ছিলেন বাঘের গল্প৷ অরণ্যে যাওয়া মানুষ বাঘের চরিত্তির বোঝেন ভাল৷ আলাপের শুরুতেই বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম– আপনি বাঘ দেখেছেন?
সেই শূন্য দৃষ্টি আমার দিকে ফিরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মনোরঞ্জন৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, জঙ্গলে যেতে হয়, বাঘ দেখব না! আমার ছোট ছেলেটাকেই তো বাঘে নিয়ে গেল৷ ব্ল্যাকে গিয়েছিল৷ আর সে ফেরেনি৷ ছেলের শোকে ওর মা-ও গেল৷ বেশিদিন বঁাচল না৷
অবশ্য এরপরও মনোরঞ্জনের বড় ছেলে জঙ্গলে যায়৷
সুন্দরবনে বেশির ভাগ জমি একফসলি৷ অন্য সময়ে কিছু লঙ্কা বা অন্য আনাজের চাষ হয়৷ রুজির টানে তাই জঙ্গলে কাঠ কাটতে যেতেই হয়৷ বেআইনিভাবে অর্থাৎ বন দফতরের অনুমতি না নিয়ে যাওয়া৷ তাই সেই জঙ্গল-গমনকে এখানে ‘ব্ল্যাক’ বলা হয়ে থাকে৷
কথিত আছে, জঙ্গল ওদের ডাকে৷ সেই ডাক অগ্রাহ্য করার শক্তি ওদের কারও নেই৷
কাঠ কাটতে যাওয়া ছাড়াও মধু ও মোম সংগ্রহে, খঁাড়িতে মাছ-কঁাকড়া ধরতেও জঙ্গলে যেতে হয়৷ বন দফতরের দেওয়া ডাকেও বছরে বেশ কয়েক বার জঙ্গলে যেতে হয়৷ তখন সরকারিভাবে জঙ্গলে গাছ কাটা বা মধু সংগ্রহের কাজ চলে৷
জলে কুমির ডাঙায় বাঘ
জঙ্গলের বাঘ আর জলের কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করেই সুন্দরবনের মানুষকে আজও জীবনধারণ করতে হয়৷ অসমর্থিত হিসাবে, বাঁচার সংগ্রামে প্রতিবছর প্রায় চার হাজার মত্স্যজীবী, পাঁচশো মউলে এবং পঁাচশো কাঠুরে জঙ্গলে যায়৷ এদের কারও কারও আর বাড়ি ফেরা হয় না৷ অন্যদিকে লোকালয়েও মাঝেমাঝেই বাঘ চলে আসে৷ নদী-নালা পার করে লোকালয়ে বাঘের হামলার ঘটনা বছরে দু-চারটে ঘটেই থাকে৷
একাধিক গবেষণা হয়েছে সুুন্দরবনের বাঘের চিত্ত-চরিত্তির নিয়ে৷ সুন্দরবনের বাঘ সঁাতারে বেশ দক্ষ৷ তারা স্রোতের সঙ্গে সমকোণে সঁাতার কাটে৷ সেজন্য স্রোত যতই তীব্র হোক, তাতে বাঘের কোনও অসুবিধা হয় না৷ বন বিভাগের নথিতে দেখা গিয়েছে, একবার একটি বাঘ নাকি একেবারে আট কিলোমিটার সঁাতরে মাতলা নদীর মধ্যস্থলে হ্যালিডে দ্বীপে পৌঁছে গিয়েছিল৷
কেন লোকালয়ে
সুন্দরবনে বাঘের লোকালয়ে হানার কারণ অনুসন্ধানেও বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে৷ অনুমান করা হয়, বাঘের লোকালয়ে আগমনের জন্য বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। জঙ্গলে খাদ্যভাণ্ডারে সংকট এর অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞদের মত৷ দ্বিতীয়টি হল, জঙ্গল আর জনবসতির নৈকট্য।
এছাড়াও আরও একটি কারণের কথাও বলা হয়ে থাকে। ভারতে বাঘের প্রজননকাল সাধারণত বর্ষার পর৷ এই সময়ে পুরুষ বাঘ যখন বাঘিনীর পিছু পিছু ঘোরে, তখন পুরুষ বাঘকে বোকা বানানোর জন্য বাঘিনি ‘লুকোচুরি’ খেলে৷ সেই সময় পথ ভুলে লোকালয়েও চলে আসতে পারে বাঘ—বাঘিনি৷ বাঘিনি সন্তান প্রসব করে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে৷ প্রসবের পর বাঘিনী তার ছানাদের নিয়ে বাঘের আওতা থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন থাকে৷ তখন বাঘিনি দূরে সরতে সরতে জঙ্গল-লোকালয়ের সীমান্তে পৌঁছে যেতে পারে৷ বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাঘের কোনও নির্দিষ্ট এলাকা নেই৷ বাঘ ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে৷ সেই সফরে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসা কোনও অসাধারণ ঘটনা নয়৷
বাঘের থাবা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু৷ বাঘের আঁচড়ে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হয়। থাবার ওজনে হাড়ও ভেঙে যেতে পারে৷ সময়মতো চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অবধারিত৷ দ্রুত রক্ত না দেওয়া গেলে জখমকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে৷ মাথার যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে বলে মনে হয় ছায়াদেবীর৷ তেমনই দীর্ঘ সময় পরেও সেই পড়ন্ত বিকেলের আতঙ্কটা এখনও কাটেনি৷ বোন আর ভাইয়ের সঙ্গে মীন ধরতে গিয়েছিলেন৷ সকাল থেকে ঠায় জলে দাঁড়িয়েও তেমন মীন উঠছিল না৷ খাটনির খরচ উঠবে না৷ একটু বেশি মীনের আশায় এগোতে এগোতে কখন কোর এলাকায় ঢুকে পড়েছেন খেয়াল নেই৷
সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে৷ আরেকটু পর সন্ধ্যা নামবে৷ এখনই বাড়ি ফিরতে হবে৷ খেয়াল হতেই গা ছমছম করে উঠল৷ তখনই নাকে এল একটা বোটকা গন্ধ৷ খচরমচর শব্দে জঙ্গলের দিকে ফিরতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ছায়াদেবীর৷ হেঁতালবনের আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়েছে জন্ত্তটা৷ তারই দিকে অপলকে চেয়ে আছে৷ বাঁচতে হবে৷ নদীর দিকেই দে ছুট৷ কিন্ত্ত চড়ার পাঁকে পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন৷ সুযোগ বুঝে জন্ত্তটা ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ চুলসুদ্ধু ঘাড় কামড়ে টেনে নিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে৷ আর কিছু মনে নেই৷
তিনমাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল৷ সেখানেই জ্ঞান ফিরতে শুনেছিলেন, বোন আর ভাই তঁাকে খুঁজতে এসে দেখতে পায়, বাঘ টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ দু’জন আপ্রাণ চিত্কার করে হেঁতালের ডাল নিয়ে তাড়া করলে বাঘ পালিয়ে যায়৷ সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও সম্পূর্ণ সুস্হ হতে পারেননি ছায়াদেবী৷ মাথায় গভীর ক্ষত ছিল৷ এখন প্রায়ই পুরনো ঘটনা কিছু মনে করতে পারেন না৷ চিনতে পারেন না কাউকে৷
সুন্দরবনের বাঘ কি মানুষখেকো?
কয়েকটি আধুনিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মানুষ বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য নয়৷ জিম করবেটের মতে, বাঘ মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে কিংবা মানুষ বা অন্য জীবের দ্বারা আহত হলে নরখাদক হয়ে ওঠে৷ বেশির ভাগ ঘটনায় দেখা গিয়েছে, আক্রান্ত ব্যক্তি বাঘের সীমানার মধ্যে ছিল৷ এমনও ঘটেছে, গোয়ালে গবাদি পশু বাঁধা রয়েছে৷ শোয়ার ঘরে দম্পতি ঘুমাচ্ছেন৷ দরজা খোলা পেয়ে নিঃশব্দে বাঘ সেই ঘর পেরিয়ে গোয়ালে গিয়ে আহার সেরে নিঃশব্দেই কেটে পড়েছে৷
বাঘের লোকালয়ে চলে আসাটা নিশ্চিতভাবে বড় ঘটনা৷ কারণ এতে বেশি বিপদ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিটিরই৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘকে জঙ্গলে আটকে রাখতে যেমন উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন, তেমনই মানুষকে জঙ্গল থেকে দূরে রাখতে না পারলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়৷বাঘ—মানুষের সংঘাত আটকাতে এটাই একমাত্র পথ। বাঘের লোকালয়ে চলে আসার বিষয়টি প্রাকৃতিক হলেও, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার জন্য দায়ী মানুষই৷
সুন্দরবনে বাঘ-মানুষে সংঘাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানাবিধ গবেষণা চলেছে৷ বিশিষ্ট গবেষক মলয় চৌধুরি এবং প্রণবেশ সান্যাল ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মানুষের ওপর বাঘের আক্রমণের ঘটনাগুলি নিয়ে দীর্ঘ সমীক্ষা চালান৷ সেখান থেকে সিদ্ধান্তে তঁারা উপনীত হন। এক, খাঁড়ির জলে লবণের পরিমাণ৷ দুই, বাঘের বাসায় মানুষের অনধিকার প্রবেশ৷ তিন, জঙ্গলে বাঘের শিকারের অভাব৷ এর উপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞরা লোকালয়ে বাঘের হানা কমাতে কতগুলি সুপারিশ করেন৷ প্রথমত, জঙ্গলে হেঁতালের পাতা কাটার অনুমতি বন্ধ করা উচিত৷ দ্বিতীয়ত, পাকাপোক্ত মানুষখেকো চিহ্নিত করতে যে কোনও মানুষ খাওয়ার ঘটনায় বাঘের পায়ের ছাপ চিহ্নি ত করা দরকার৷ কারণ, একই বাঘ বার-বার মানুষ খাওয়ার ঘটনায় যুক্ত থাকলে তাকে পাকাপোক্ত মানুষখেকো বাঘ বলে ধরে নিতে হবে৷ তৃতীয়ত, জঙ্গলে বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মানুষের ঘাড় সমেত মাথা রক্ষায় ফাইবার গ্লাসের শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করা উচিত৷ কারণ বাঘ পিছন থেকে ঘাড়ে থাবা বসায়। চতুর্থ, বাঘের শিকারের ঘাটতি মেটাতে বাফার এলাকায় বন্য শূকর ছাড়া দরকার৷ পঞ্চম, লোকালয়ে বাঘ এলে গ্রামবাসীদের আস্থা ফেরানোর জন্য বাঘকে অজ্ঞান করে সরিয়ে নেওয়া উচিত৷ জঙ্গলে আরও বেশি স্বাদু জলের পুকুর কাটা দরকার। তাহলে বাঘ বাফার এলাকা ছেড়ে কোর এলাকায় চলে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মেনে আটের দশকেই বেশ কিছু পদক্ষেপ করে সুফল মেলে। আসলে জঙ্গলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটা, মানুষের অবাধ যাতায়াত, হরিণের চোরাশিকার বন্ধ করা গেলে এবং জঙ্গলে বাঘের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও স্বাদু জলের সুবন্দোবস্ত হলে লোকালয়ে বাঘের হানাদারি বন্ধ করা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা রায় দিয়েছেন৷ সেই সঙ্গে অবশ্য বাফার এলাকায় বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্হাও করা জরুরি।
গত শতকের প্রথম দিকে (১৯১২-৩২) এফ ট্রাফোর্ড সুন্দরবনের এক বৃত্তান্তে লিখেছিলেন, “এ বছর সুন্দরবনের বাঘ অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি ভয়াবহ৷ সবচেয়ে বিপদের কথা, দু’টি গাছ কাটার কুপেতে বাঘ রাত্রে বনকর্মীদের ঘুমানোর জন্য তৈরি মাচার ওপর উঠে একজন করে বনকর্মীকে নিয়ে গিয়েছে৷” সেবার বাঘের ওই মানুষ শিকারের প্রবণতা কিছুটা প্রতিহত করা গিয়েছিল দু’টি বাঘকেই খাঁচায় বন্দি করে এবং গুলি করে মেরে৷ সে বছর বাঘের ওই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ট্রাফোর্ড আগের বছরের ঘূর্ণিঝড়কেই দায়ী করেছিলেন৷ সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সুন্দরবনের প্রচুর হরিণ ও শূকর মারা গিয়েছিল৷ কাজেই জঙ্গলে বাঘের স্বাভাবিক খাদ্যের অভাব হয়েছিল৷
এমন ঘটনাও ঘটেছে, জঙ্গলে বারোজনের একটি দল চলেছে কাঠ কাটতে৷ সরকারি অনুমতি আছে৷ তাই সুরক্ষা ও নিরাপত্তার সমস্ত ব্যবস্থাই রয়েছে৷ হঠাৎ হুড়মুড় করে শব্দ৷ বাঘ কিছু একটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ মাথা গুনে দেখা গেল একজন নেই৷ দলের মধ্যে থেকে বাঘ তাকেই তুলে নিয়ে যায়, যে অন্যমনস্ক থাকে৷ সেবার যে লোকটিকে বাঘ তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে যথেষ্ট ভারী চেহারার ছিল৷
সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের মনে মনুষ্য-ভীতি তৈরি করার জন্য একাধিক গবেষণা হয়েছে৷ কিন্ত্ত কোনওটিই সেভাবে সফল হয়নি৷ সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ সংঘাত নিয়ে আধুনিক গবেষকরা দেখেছেন, সুন্দরবনের বাঘের চরিত্র বিশ্বের অন্যান্য এলাকার বাঘের থেকে আলাদা৷ বলা হয়ে থাকে, যেহেতু সুন্দরবন সমুদ্রের উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্হিত, তাই তূলনামূলকভাবে এখাকার জল লোনা৷ কারও কারও মতে, লবণাক্ত জলের কারণে বাঘ সর্বক্ষণ অস্বস্তিতে থাকে, যা তাকে আগ্রাসী করে তোলে৷
সুন্দরবনের বাঘের হিংস্রতার অন্য একটি সম্ভাবনা হিসাবে দাবি করা হয়, আবহাওয়ার কারণেই সুন্দরবনের বাঘ নরমাংসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ, দুই দিকের সুন্দরবনে প্রায়ই ভয়ংকর উপকূলবর্তী ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়৷ স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া মানুষের পচা শবদেহ খেলে নরমাংসের স্বাদ পেয়ে যায় বাঘ৷ তাছাড়া, সুন্দরবনের উঁচু-নিচু স্রোতের কারণে পিচ্ছিল মাটিতে বাঘের পক্ষে শিকার ধরা কঠিন হয়ে যায় যখন, সহজ শিকার হিসাবে জঙ্গলে ঢোকা মানুষকেই শিকার হিসেবে বেছে নেয় তারা৷ অন্যমনস্ক বা ঘুমন্ত বা চুপ-চাপ বসে থাকা মানুষকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাঘের শিকার হতে দেখা গিয়েছে৷
আগেই বলা হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে সুন্দরবনে প্রায় একশো বছর ধরে জঙ্গল কেটে আবাদ করা হয়েছে৷ গবেষকদের মতে, স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে সুন্দরবনের বাঘও শিকারের পদ্ধতি বদলে ফেলেছে৷ এশিয়ার বাকি অংশের বাঘের মানুষ-ভীতি বাড়লেও সুন্দরবনের বাঘ মানুষকে শিকার বানানো হয়তো কোনওদিনই বন্ধ করবে না৷ তাই মানুষ জঙ্গলে না গেলেও লোকালয়ে বাঘের আনাগোনা চলছেই৷
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন