ওওওও, নদিয়া চলে, চলে রে ধারা, চান্দা চলে, চলে রে
তাআআরা আআআ.... তুঝকো চলনা হোগা, তুঝকো চলনা হোওওগাআআ..
‘কালোয় আলোয়’, ‘এবং বদলাপুর’
ও ‘আগুনের পরশমণি’র পরে এ বার প্রকাশিত হল ‘নদিয়া চলে চলে রে ধারা।’
আমার চতুর্থ এই ক্রাইম থ্রিলারটি আগেরগুলোর চেয়ে আলাদা চরিত্রগত কারণে। গত তিনটে বই-ই একাধিক কাহিনির সংকলন। কিন্তু ‘নদিয়া..’ একটাই আখ্যান, উপন্যাস বলতে পারেন (যদিও বড় গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাস ইত্যাদির ‘সাহিত্যধর্মী’ সংজ্ঞা সম্পর্কে আমি সম্যক অবহিত নই)। নেপাল হিমালয়ের উৎস থেকে খরবেগে বয়ে আসা এক নদীর নিরন্তর প্রবাহের প্রেক্ষাপটে, প্রায় তেত্রিশ বছর আগের রক্তে রাঙা ঘটনাবিন্যাস আবর্তিত হয়েছে প্রত্যন্ত উত্তর বিহারের অপরাধ জগতের একটি বিচিত্র ক্ষেত্র (Sector) ঘিরে, যে সম্পর্কে অন্তত ছাপোষা বাঙালি গেরস্তের তেমন ধারণা নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
আমারও ছিল না। পরে হয়েছে, বাল্যসুহৃদ লায়লা ওরফে লখবিন্দর সিংয়ের সৌজন্যে।
হ্যাঁ, লায়লা। আগের তিনটে বইয়ের মতো ‘নদিয়া..’রও কেন্দ্রীয় চরিত্র লায়লা বস, এককালের বিহার-বাংলা কোলবেল্টের ত্রাস, দুর্দম কোল-স্ক্র্যাপ মাফিয়া, আমাদের আত্মার আত্মীয়। নিজের ডান হাত মনোহর ঠাকুরের সঙ্গে লায়লা ঠিক কখন, কী ভাবে উত্তর বিহারের ডার্ক ওয়র্ল্ডে খুঁটি গাড়ার দুরন্ত টক্করে জড়াল, আমরা জানতাম না। কয়েক মাস বাদে এক প্রাক পুজো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়, আসানসোলের গ্যাঁজলাঘরে জম্পেশ আড্ডায় বসে লায়লার মুখে সে সংবাদ পেয়ে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
তবে সেদিন পুরোটা জানা হয়নি, কারণ কিসসা তখনও পুরোপুরি পেকে ওঠেনি, স্রেফ ভূমিকা চলছে।
তখনও আমি সাংবাদিকের পেশায় ঢুকিনি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের শেষ পর্যায়ে। লায়লার মুখে শোনা ‘নদিয়া...’ বৃত্তান্ত কোনও দিন কাহিনির আকারে লিখব, স্বপ্নেও ভাবিনি। বছর চারেক আগে, সর্দারের স্মৃতি রোমন্থনের সূত্রে আকস্মিক ভাবে নিজস্ব লেখালিখি শুরু করা ইস্তক একটা ইচ্ছে মনের ভিতর সব সময় লালন করে গিয়েছি। ‘নদিয়া...’কে বাঙালির পাঠকদের দরবারে পেশ করার স্বপ্ন।
যা ইনপুট এল, নেহাত কম নয়। আমার স্মৃতিশৃঙ্খলের বিভিন্ন ফাঁকফোকর ভরাট করতে সেগুলো যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সঙ্গে কাজে লেগেছে নিজের পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা। নর্থ বিহারের সংশ্লিষ্ট তল্লাটের তদানীন্তন পরিবেশ, লোকজন, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি-জাতপাতের বিবিধ সমীকরণ, ও সর্বোপরি সেখানকার অপরাধ জগৎ সম্পর্কে নিজস্ব পর্যবেক্ষণের আলোয় বৃত্তান্তকে যতটা সম্ভব আলোকিত করার চেষ্টা করেছি। অপরাধের যে উর্বর ক্ষেত্রটিকে ঘিরে ‘নদিয়া...’র বিস্তার, তার প্রতিটি ঘাঁতঘোঁত সবিস্তারে লায়লাই জানিয়েছিল। আমরা উন্মুখ হয়ে শুনেছিলাম, এমনই ইন্টারেস্টিং। বন্ধুদের জবানিতে প্রমাণ, ওরাও কেউ ভোলেনি।
সেক্স খুঁজলেও তা-ই। একে কালো দুনিয়ার কিসসা, তায় কুশীলবেরা নর্থ বিহারের ক্রুড অপরাধী। উদ্দাম, বন্য যৌনতার বিস্তর রগরগে মালমশলা হাতের মুঠোয় মজুত ছিল, লায়লার মুখে বিস্তারিত শোনা। সযত্নে পরিহার করেছি। কারণ, ক্রাইম থ্রিলারের মোড়কে পর্নোগ্রাফি পেশ করার স্রোতে গা ভাসানোর ইচ্ছে রাখি না।
এ বৃত্তান্ত
কতটা 'সাহিত্য' হয়ে উঠল, তা নিয়ে
বিন্দুমাত্র ভাবিত নই, এককণা সাহিত্যগুণ না থাকলেও
আমার কিছু যায়-আসে না। তবে হলফ করে বলা যায়, বাংলা
বইপত্রের অলিন্দে এমন বিষয় নিয়ে এ যাবৎ লেখা হয়নি।
বাকিটা পাঠকদের হাতে।
ধন্যবাদ।
নর্থ বিহারের
‘কারোবারে’ নিজের তরফে কমান্ডিং জেনারেল হিসেবে মনোহরকে ডেপুট করেছিল সর্দার। ওই
সান্ধ্য ঠেকের আমোদ-আসরে ‘হাসমুখ খুনিয়া’ মনোহরও স্বভাবসিদ্ধ হাল্কাচালে দু’-চারটে
ফোড়ন কাটে, যার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়াল
হিংসার অগ্নিসঙ্কেত কারও মস্তিষ্কের রেডারে ধরা পড়েনি। হয়তো লায়লা-মনোহরও আঁচ
পায়নি, কোন ছারখেরে রক্তজোয়ার ওদের
ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় অলক্ষ্যে ফুঁসছে।
এর পরে দীর্ঘ
সময় আমাদের আড্ডায় মনোহরের অনুপস্থিতি কারও কারও ষষ্ঠেন্দ্রিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক
ঠেকলেও তেমন গুরুত্ব পায়নি। ওদের জীবনযাত্রা তো আমআদমির মতো নয়!
কেউ জানতাম
না, সেই দিনগুলোয় নেপালঘেঁষা উত্তর
বিহারের বুনো জমিতে মনোহর-সহ লায়লার তামাম মোতিহারি গ্যাং জীবণ পণ করে লড়ছে এক
জান্তব ও পাশবিক লড়াই, যার শুধু দু’টো প্রান্ত-- জীবন
ও মৃত্যু। মাঝামাঝি কোনও জায়গা নেই। এবং মৃত্যু মানে নারকীয় মৃত্যু, দেখলে খোদ
মরণও ত্রাসে কেঁপে ওঠে।
প্রায় বছর ঘোরার
মুখে বাদে ফের গ্যাঁজলাঘরে জমাটি আসর। তখনই লায়লার বিবরণে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল
পুরো ইতিহাস, সচল দৃশ্যপটের মতো। শুনতে শুনতে
শিউরে ওঠা ছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না। আন্ডার ওয়র্ল্ড, মাফিয়া
জাগতের টানাপড়েন, তার রাহান সাহান সম্পর্কে আমরা
একেবারে অজ্ঞ নই, জন্মাবধি কোলবেল্টের হরেক
চেহারা দেখে ও কালো দুনিয়ার শরিক সঙ্গীসাথী থাকার সুবাদে একটা লেভেলের আন্দাজ
ছিলই। কারবারের লাভ-লোকসান বাদ দিলেও, স্রেফ বদলা
চুকানো, মানে ‘ভেনডেটা’র খাতিরে গ্যাংস্টারেরা
কী রকম ক্রুর, নিষ্ঠুর হতে পারে, তাও বিলক্ষণ
জানতাম।
কিন্তু সুদূর
নর্থ বিহারে লায়লার মোতিহারি গ্যাং ‘এপিসোড’ সেই ‘পোড় খাওয়া’ আমাদেরও দুর্দম
ঝাঁকুনি দিয়ে শেষে বরফজলে স্নান করা এক-একটা পাথরমূর্তি বানিয়ে দেয়।
এত নৃশংসতা? এ যে কল্পনাতীত! জিঘাংসার শেষ সীমাও পার!
কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন। কাহিনির মুখ্য যে দুই চরিত্র, যাদের মারফত নর্থ বিহারের রক্তস্নাত অধ্যায়টি আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল, সেই লায়লা ও মনোহর তো ইহজগতে নেই! তেত্রিশ বছর আগে দু’দিনের আড্ডায় যেটুকু শুনেছিলাম, তার স্মৃতিই সম্বল, কোথাও কোথাও যা বেশ ধূসর। রুনু, ছ’ফুটির মতো সে দিনের আড্ডাধারীদের কেউ কেউও চিরতরে বিদায় নিয়েছে (‘নদিয়া,,... ’লেখার সময় পর্যন্ত লোডু জীবিত ছিল)।
হাল ছাড়িনি।
বাকি বন্ধুদের সঙ্গে নিরন্তর ফোনালাপ। কার কতটা মনে আছে?
এ কি ভোলার
জিনিস! পরবর্তীকালে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের কথাবার্তায় মালুম হয়েছে, সর্দার দুশো
শতাংশ ঠিক বলেছিল।তাই অত পুঙ্খনুপুঙ্খ ভাবে ‘কারোবার’ পরিচালনা-প্রক্রিয়ার স্টেপ
বাই স্টেপ বিবরণ দেওয়া সম্ভব হল। মনে রাখবেন, এ আখ্যান
তিন দশকেরও বেশি পুরনো। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে এখন নিশ্চয় তা আমূল বদলে
গিয়েছে।
মাফ করবেন, কী ভাবে, কতটা বদলেছে, সে সম্পর্কে
কোনও আইডিয়া নেই, আইডিয়া করারও ইচ্ছে নেই।
আর একটা কথা।
লায়লা-মনোহর ব্যতীত ‘নদিয়া...’র অন্য কোনও চরিত্রের সঙ্গে আমাদের চাক্ষুষ পরিচয়
হয়নি। পরমানন্দ, চাচু, রঞ্জুমাল্লা, ভীমা কুর্মি, মুন্সিজি, শিবা, বিপিন, জুড়ুয়া
পণ্ডিত বা নওলাখা শর্মার মতো প্রকৃতির বিচিত্র সব সৃষ্টি আমাদের অন্তরালে রয়ে গেল, এ অবশ্যই
মস্ত আক্ষেপ। লায়লার বিবরণের স্মৃতিভাণ্ড হাতড়ে তাদের ছবি এঁকেছে আমাদের ঠেকের অন্যতম
সদস্য মিতলা (মিতুল, ওরফে সুব্রত সিনহা)।
‘নদিয়া...’র ভিতরের ইলাস্ট্রেশনগুলো ওরই হাতের সৃষ্টি। পাশাপাশি জগ্গু, জাম্বো তিনু, মিতলা, বাপি, সমু, বেলচাট, পিঙ্কু, সমু, আক্কু, ভুপিরা স্রেফ
আমার বইয়ের খাতিরে মগজ তোলপাড় করে বহু মণিমুক্তো খুঁড়ে এনেছে, একবারের জন্যও
বিরক্তি প্রকাশ করেনি। ওদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। তখনও জীবিত লোডু আপন ব্যবসা, নেটওয়র্ক ও
বিহারি আন্ডারওয়র্ল্ডের বেশ কিছু মাথার সঙ্গে পরিচিতির দৌলতে এমন কিছু তথ্য
জুগিয়েছে, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল
না।
চিরতরে
আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া বাল্যবন্ধুদের প্রতি রইল বুকভরা ভালবাসা, সঙ্গে কয়েক
ফোঁটা অশ্রু।
‘নদিয়া...’কে
বই আকারে বার করার জন্য রূপম প্রকাশনীর অতনু সোম যে ভাবে তাড়া মেরেছেন, না বললে
অন্যায় হবে। কাহিনির হিংসারক্তিম স্পিরিটের সঙ্গে খাপে খাপ, অসামান্য
প্রচ্ছদ এঁকেছেন ভ্রাতৃপ্রতিম চিত্রকর ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য, নিঃসন্দেহে
বইটির যা অন্যতম আকর্ষণ। প্রয়াত কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী মান্না দে’র উদ্দেশে সবিশেষ
কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও প্রণাম। অসিত সেনের
‘সফর’ ফিল্মে ওঁর জাদুকণ্ঠে গাওয়া ‘নদিয়া চলে, চলে রে ধারা’
গানটির ছন্দে তাল মিলিয়ে আমার কাহিনী প্রবাহিত, এতে এক
মৎসজীবীর গলায় ওই চিরনবীন সঙ্গীতের অনুরণনই যেন বেঁধে দিয়েছে পুরো মেজাজটা। গানের
কথাকার ইন্দিবর ও সুরকার কল্যাণজি-আনন্দজির প্রতিও সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
পরিশেষে বলি, এ কোনও মহান
সাহিত্যসৃষ্টির তাগিদের ফসল নয়। আমজনতার চোখের আড়ালে থাকা এক আঁধার দুনিয়ার
হাড়হিম কিছু ঘটনাবলি তালেগোলে জানতে পেরেছিলাম, প্রত্যক্ষ
অংশীদারদের জবানিতে। সেটাই তুলে ধরলাম পাঠকের দরবারে। এতে দার্শনিকতা, সমাজবোধ বা
মননশীলতার পরশ নেই, কাব্যচেতনার ছিঁটেফোঁটাও
গরহাজির। প্রেম-বিরহ, রোমান্টিসিজমের নামগন্ধ পাবেন
না, এমনকী কোনও নারীচরিত্রও
অনুপস্থিত। জেমস বন্ড সদৃশ কোনও অতিমানবিক সুপার এজেন্ট নেই, লাস্যময়ী
সহচরীর সঙ্গে ইজরায়েলি উজি বা জার্মান এইচকে সিক্সটিন কিংবা আমেরিকান এম সিক্সটিন
ইত্যাদি (গুগলঝাড়া জ্ঞান) অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অলৌকিক কার্যকলাপ মিলবে
না, ইউরোপিয়ান আল্পসের তুষারাবৃত
পাইনবন থেকে একলাফে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের চেম্বার হয়ে হাওড়া ব্রিজে অবতরণ ও
শীর্ষ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীকে নিকেশ করে ভয়ঙ্কর নাশকতা প্রতিরোধের ওর মতো
নানাবিধ রূপকথার মায়াপ্রলেপ নেই। দুর্বোধ্য ও জটিল বাক্যবিন্যাসে বৈদগ্ধের
বিচ্ছুরণ, মনোবিশ্লেষণ বা ইন্টেলেকচুয়াল
পাণ্ডিত্যের ঝলকানি খুঁজলে হতাশ হতে হবে।
এই সব ঘাটতির
জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এতে যা আছে, তা হল এক কঠোর বাস্তবের
ধারাবিবরণী, মাফিয়া জগতের ক্রুড ভায়োলেন্সে
ম্যারিনেট করা অতি নির্মম যাত্রাপথ, কিছু কিছু
জায়গা হয়তো দুর্বলহৃদয়দের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।
প্রকাশিত
হয়েছে
মাফিয়া জগতের শঠতা, বেইমানি, চক্রান্ত, অকল্পনীয়
জিঘাংসা ও অদম্য সাহসিকতার এক রক্তস্নাত যাত্রাপথ
'নদিয়া চলে চলে রে ধারা'
লেখক: অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
অলঙ্করণ: সুব্রত সিনহা (মিতলা)
প্রকাশক: রূপম প্রকাশনী
দাম: ৩২০ টাকা
প্রাপ্তির বিষয়ে যোগাযোগ 8910807126 (রূপম প্রকাশনী)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন