তোজো-রোনাল্ডো দেখা । অরূপ কর

বিশ্বকাপে রোনাল্ডোর বিদায়ে ভেঙে পড়েছে তোজো। তবে ভাবেইনি আচমকা দেখা হয়ে যাবে কলকাতার ময়দানে। তারপর কী হল?

tojor kache ronaldo. story by arup kar

বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চ থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বিদায় নিতেই তোজো মনমরা। মেসি, এমবাপেরা কাতারের সবুজ গালিচায় ফুল ফোটালেও তোজোর মন ভরেনি। সি আর সেভেন নেই যে! রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছে সে।

মহাতারকার এই কিশোর ভক্তের অন্ধ আবেগের ঘরে মেসি, ডি মারিয়া, এমবাপেরা নন, আসন পাতা শুধুই রোনাল্ডোর। অমন টানটান, বারুদঠাসা উত্তেজনা মাখা আর্জেন্তিনা-ফ্রান্স মহারণের সন্ধ্যায় তোজোর চোখদুটো টিভির পর্দায় থাকলেও মনটা পড়ে ছিল রোনাল্ডোর কাছে। বারবার তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল পর্তুগালের বিদায়ী ম্যাচে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখা মহাতারকার অসহায় চাহনি, যুদ্ধ শেষে কান্নাভেজা চোখে টানেল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ছবি।  নিষ্পাপ কিশোরের এহেন নিখাদ ভক্তির কথা রোনাল্ডো কি কোনওদিন জানতে পারবেন?

রোনাল্ডো-প্রীতির জন্য বারবার বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তোজোকে। বিব্রত বাবা-মা-ঠাম্মিও। স্কুলে অঙ্ক খাতায় সে একদিন রোনাল্ডোর ছবি এঁকে বসল। গার্জিয়ান কল। বাবা-মা-ঠাম্মি গেল। ভুলোও পিছন পিছন গিয়ে স্কুলের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। অঙ্ক মিস যা নয়, তাই বললেন। 'যত্তো সব আদিখ্যেতা, সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান', তাঁর পরামর্শ। ঠাম্মি বললেন, 'মাথা থিকা পা পর্যন্ত ব্যাতের বাড়ি মারেন, তাইলেই ঘাড় থিকা ভূত নামব!'

তবে হেড মিস্ট্রেস কান্তা দেবী ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি বললেন, 'না, না। ওকে এসব বলবেন না। ও তো তাও একজনকে আইডল বানিয়েছে যাঁকে অবিচল ভক্তি, বিশ্বাস করে। আজকাল চারদিকে আইডল ভাবার মতো কাউকে পান? এখন তো হাওয়া বুঝে গিরগিটির মতো রং পাল্টানো দলবদলুদের যুগ। ওকে বোঝাতে হবে, আইডল মানেই সে সর্বশক্তিমান, ভগবান নয়। তাঁকেও কখনও হারতে হয়। সাফল্য, ব্যর্থতা নিয়েই জীবন। একই মুদ্রার এপিঠ, ওপিঠ।'

সময় সব সইয়ে দেয় আমাদের। তোজোও একসময় মহাতারকার মহাপতন মেনে নিল। তবে অন্তর্যামী হয়তো আড়াল থেকে মুচকি হাসছিলেন সব দেখে, নইলে কেন তোজোর সঙ্গে রোনাল্ডো এভাবে জড়িয়ে যাবেন?

তোজো একদিন গাড়ি চেপে বিয়েবাড়ি যাচ্ছিল। শ্যামবাজারে। চালকের আসনে দাদাভাই। বাবা, মা, ঠাম্মি, পিপি, পিপি-ঠাম্মি সবাই যাচ্ছে। যাদবপুর থানার একটু দূরে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। সন্ধ্যাবেলা। আলো-আবছায়ায় তোজো দেখল, আশপাশের গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পয়সা নিচ্ছে বৃহন্নলা, রূপান্তরকামীরা। আর তাদের থেকে একটু দূরে গেরুয়া পাগড়ি পরা এক সাধু। কাঁধে ঝোলা। বিরাট লম্বা, বেতের মতো টানটান চেহারা। পরনে রংচঙে জোব্বা জাতীয় পোশাক। মুখ ঢাকা শিবের মুখোশে। তবে  মুখোশে মুখভর্তি দাড়ি ঢাকা যাচ্ছে না। হাত বাড়িয়ে তিনিও গাড়ির সওয়ারীদের থেকে সাহায্য নিচ্ছেন। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, তিনি ঝোলায়  না ভরে সেই পয়সা বিলিয়ে দিচ্ছেন তাঁকে ঘিরে থাকা পথশিশুদের। ভালো করে তোজোর ব্যাপারটা বোঝা হল না। সিগন্যাল সবুজ হতেই ছেড়ে দিল গাড়ি।

তোজো পরদিন পুলিশ মামাকে ফোনে সব জানাল। তিনি থানার বড়বাবুকে  নির্দেশ দিলেন, সাধুটি কে, সাদা পোশাকের পুলিশ লাগিয়ে খবর নিয়ে আমায় জানান। কিন্তু অত্যুত্সাহী সেই পুলিশকর্মী নাকি সাধুর গা ঘেঁষে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে চোখ রাঙিয়ে সাধু তাঁকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। পুলিশকর্মীর বয়ান অনুসারে, ধাক্কা খেয়ে মনে হল, আমফান ঝড়ে ছিটকে ফুটপাথে গিয়ে পড়লাম! 

সেখান থেকে ছুটতে ছুটতে তিনি থানায় ঢুকে বড়বাবুকে সব জানান। ব্যস, তারপর থেকে আর সেই সাধুকে ওই তল্লাটে দেখাই যায় না।

এর কয়েকদিন বাদে তোজোরা ৪-৫ বন্ধু মিলে ময়দানে ফুটবল খেলছে। পাশের পাড়ার সঙ্গে ম্যাচ। ভুলো বায়না ধরায় দাদাভাইয়ের গাড়িতে এসেছে ওরা। জায়গাটা বেশ নির্জন। ঝোপঝাড় আছে। বিকেল শেষ হয় হয়। সন্ধ্যা নামছে। আচমকা তোজো দেখল ঝোপের গা ঘেঁষে চোখ বুজে ধ্যানস্থ একজন। আরে ওই তো সেই সাধুবাবা! আজও গেরুয়া পাগড়ি। শিবের মুখোশ। পাকা দাড়ি নেমে এসেছে গলা পর্যন্ত। গোটা শরীর ঢাকা সাদা জোব্বায়। পাশে রাখা ঝোলা। ভুলো যে কখন তার কোলে উঠে বসেছে, বোঝাই গেল না। 

তারপরই সেই অভাবনীয় কাণ্ড! তোজোদের জার্সির রং লাল, উল্টোদিকের জার্সি সবুজ। তোজো বল নিয়ে ছু়টছে। আচমকা পিছন থেকে তার কানে এল, বয়, মুভ, মুভ ফাস্ট। টার্ন রাইট। পাস দ্য বল। তোজো পাস দিল শুভ্রকে। চলন্ত বলে শট শুভ্রর। জালে জড়াল বলটা। গোওল........। পিছন ঘুরে তোজোরা দেখল, সাধু লাফিয়ে চিত্কার করে উঠল। লাফিয়ে উঠল ভুলোও। 

তোজোরা বিস্মিত, হতভম্ব। সাধুও যেন নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়ে চুপ করে গেল। কে ও? ততক্ষণে ম্যাচও খতম। বিপক্ষের ছেলেরা চলে গেল। সাধু আরেকটু দূরে সরে বসেছে। তোজোদের দলের কারও হাত থেকে পড়ে বলটা গড়িয়ে সেদিকেই গেল। হঠাত্ সাধু উঠে দাঁড়িয়ে জোব্বাটা গুটিয়ে 'রান' বলেই ফুটবলে শট মারল। যেন একটা আগুনের গোলা বেরল পা থেকে।

সেই বল আনতে অনেকদূর ছুটতে হল শুভ্র, দীপ্রকে। তোজোর বুঝতে বাকি রইল না, ছদ্মবেশের আড়ালে আসল পরিচয় লুকিয়ে রেখেছে লোকটা? জানতেই হবে কে? 

কিন্তু সে ধরা দিলে তো!  সাধু কেটে পড়ার তাল করছিল।কিন্তু  পথ আটকে রেখেছে ভুলো। তোজোরা ঘিরে ধরল তাকে। বাধ্য হয়ে বসে পড়ল সে। 

আপনি কে? তোজোর প্রশ্নটা বুঝল না সাধু। বলল, 'কান্ত আন্দারস্ত্যান্দ!' তোজো নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, হু আর ইউ? সাধুর উত্তর, অ্যা ম্যান, হারমিত! তোজোর পাল্টা প্রশ্ন, য়ু প্লে ফুটবল? সাধুর জবাব, লাভ ফুতবল। তোজো সোজাসুজি বলল, নো, স্পিক দি ট্রুথ। হু আর য়ু? নট এ হারমিট। হোয়াই ইউজ মাস্ক? সাধুর সাফাই, লাভ শিবা।  সো...। 

তোজোর কিচ্ছু বিশ্বাস হচ্ছে না। সে পুলিশ মামাকে ফোনে ডেকে বলল, আয়েম কলিং পুলিশ। য়ু আর অ্যাক্টিং। পুলিশ শুনে সাধু বোধহয় একটু ঘাবড়ে গেল। বলল, ওকে ওকে। ততক্ষণে চলে এসেছেন তোজোর মামা। তিনি  বোঝানোর পর সাধু কিছুক্ষণ চুপ করে  রইল। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারারা। দূরে দেখা যাচ্ছে টাটা স্টিলের বাড়ি, চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল। ব্যস্ত সন্ধ্যায় ছুটে যাচ্ছে গাড়ি-ঘোড়া।

সাধু তোজোকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, 'ইওর হিরো?'

তোজো বলল, 'ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো।' সাধু মুখোশটা খুলে ফেলে বলল, লুক, লুক অ্যাত মি! তোজোর মনে হল, তার সামনে বসে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। রক্তমাংসের রোনাল্ডো ধরা দিলেন তার কাছে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল দীপ্ররা, পুলিশ মামা। 

কিন্তু কেন এই ছদ্মবেশ? ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে রোনাল্ডো বললেন, 'বিশ্বকাপের ব্যর্থতা ভিতরে ভিতরে তাঁকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। নিজের ক্ষমতা নিয়েই সংশয়ে ভুগছিলেন। তাঁর মা তাঁকে পরামর্শ দেন, বাবা, একবার ভারতে যা। শান্তি, অহিংসার দেশ। মহাত্মা গান্ধীর সবরমতী আশ্রম, পন্ডিচেরীর ঋষি অরবিন্দ আশ্রম, বেলুড় মঠ ঘুরে আয়। নিজেকে খুঁজে পাবি। মনে শান্তি পাবি।' 

তাই শুধু বাড়িতে জানিয়ে একদিন গোপনে প্রাইভেট জেটে চেপে ভারতে আসেন। মুখোশে মুখ ঢেকে সব জায়গা ঘুরে কলকাতায় এসেছেন। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে কিছু  লোকজনের ফুটবল চর্চায় তাঁকে নিয়ে কটাক্ষ, বিদ্রূপ ভেসে এসেছে কানে। হয়তো ওরা ব্রাজিল, আর্জেন্তিনার কট্টর সমর্থক। তাঁকে খেয়াল করেনি। এগুলো তাঁর ভাল লাগেনি। কষ্ট পেয়েছেন। তাঁকে সামনাসামনি কেউ দেখে ফেললে যদি কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যায়, তাই জনবহুল রাস্তা এড়িয়ে চলেন। 

বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটি ধর্মীয় সংগঠনের গেস্ট হাউসে উঠেছেন। পাড়াটা নির্জন। ভোরে বেরিয়ে পড়েন, সারাদিন ছদ্মবেশে ঘুরে ফিরে রাতে সেখানে ফেরেন। 

তোজো বলল, আপনি আমার আইডল। আপনি বিশ্বকাপ থেকে এভাবে চলে গেলেন। জানেন, আমি কত রাত ঘুমোইনি!রোনাল্ডো বললেন, মেসি, এমবাপে, গ্রেট ফুটবলার, আর্টিস্ট। তোজো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, নো, আই ডোন্ট লাইক দেম,  ওনলি ইউ। 

রোনাল্ডো তোজোর মাথায় হাত রেখে বললেন, নো বয়, নট রাইত। সি দিস।

এরপর তিনি যা করলেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না তোজোরা। রোনাল্ডো সাদা জোব্বাটা খুলে ফেললেন। সম্পূর্ণ অনাবৃত শরীর। যেন পাথরের গায়ে ভাস্কর্য্য। সেখানে বুকের ওপর মেসির ছবি ট্যাটু করা, পিঠে মারাদোনার! 

তোজোর মুখে কথা সরছে না।  মেসি, মারাদোনাকে এত শ্রদ্ধা করেন সি আর সেভেন? তোজোর মনের ভাব বুঝতে পেরে রোনাল্ডো বললেন, দেয়ার ইজ নো লিমিত তু ক্লাস। মেসি বিরাট বড় ফুটবলার। মারাদোনো তো সর্বকালের সেরা বলে মনে করি। যারা বিরাট, তাদের তো শ্রদ্ধা করতেই হয়। মি রোনাল্দো, রেসপেক্ত মেসি। সো দিজ ত্যাতু। সাফল্য, ব্যর্থতা মিলিয়েই তো জীবন, তাই না?

তোজোর কাছে পরিষ্কার হল, কেন সেদিন হেড মিস কথাগুলি বলেছিলেন। 

রাত বাড়ছে। তোজোদের ঘরে ফিরতে হবে। গেস্ট হাউসে ফিরতে হবে রোনাল্ডোকেও।

তোজোরা হাত মেলাল রোনাল্ডোর সঙ্গে। তোজোদের জড়িয়ে ধরে আদর করলেন রোনাল্ডো। সেলফিও তোলা হল। ভুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ও বোধহয় আমায় চিনে ফেলেছিল। তাই রাস্তা আটকে দাঁড়ায়।

তোজো বলল, স্যার, ইউ মিট এগেন? 

সি আর  সেভেন বললেন, ইউ গ্রো আপ। কাম তু পর্তুগাল। তুমি একদিন বড়  হবে, আমিও বু়ড়ো হব। ঈশ্বর প্রসন্ন থাকলে হয়তো তুমি একদিন আমার দেশে আসবে, লিসবনের রাস্তায় হঠাত্ আমাদের দেখা হয়ে যেতেও তো পারে।

মুখোশটা চাপিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ময়দান ধরে এগিয়ে চললেন রোনাল্ডো। যত দূর চোখ যায়, হাত নাড়তে থাকল তোজোরা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন