সাক্ষাৎকার : একেবারেই ইন্টেলেকচুয়াল‌ নই, সোজাসাপ্টা অতনু

নিজের কথা বলতে ঘোর অনিহা। আসন্ন কলকাতা বইমেলার প্রকাশিত হচ্ছে নতুন বই 'নদীয়া চলে চলে রে ধারা' । তার আগে অনেক অনুরোধের পর শেষে বইতন্ত্র-র সামনে বসতে রাজি হলেন লেখক অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়

Author Atanu Bannerjee interview


বইতন্ত্র :
ফরাসী লেখিকা অ‌্যানি আর্নক্স এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। কী বলবেন?

অতনু : সত্যি বলতে কী, অ্যানির‌ লেখা বিশেষ পড়িনি। তবে নোবেলপ্রাপ্তির পরে সংবাদসূত্রে জেনেছিলাম, ওঁর ইউএসপি হল বাস্তবকে তীক্ষ্ণ কলমে পরিবেশন, যা কিনা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, দম ফেলতে দেয় না। জেনে অবশ্যই ভাল‌ লেগেছে। 

বইতন্ত্র : নোবেল কমিটি আর্নক্সকে এভাবে পরিচিত করেছেন যে তিনি  ‘সাহস ও ক্লিনিকাল তীক্ষ্ণতার সাহায্যে ব্যক্তিগত স্মৃতির শিখর এবং সংমিলিত সংযম উন্মোচন করেছেন।’

অতনু : সুপ্রযুক্ত পর্যবেক্ষণ, সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগত স্মৃতিতে জারিত লেখার সঙ্গে পাঠক যতটা একাত্ম হতে পারেন, আর কিছুর সঙ্গে নয়। কালকূটের অমৃতকুম্ভের সন্ধানে বা প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতকের কথা ভাবুন।

বইতন্ত্র : এর আগের বছর নোবেল পেলেন তাঞ্জানিয়ার সাহিত্যিক আবুদলরাজাক গুরনাহ। তাঁর লেখাতেও আমরা দেখেছি বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। বিশেষত, উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণা, যা তাঁর নিজেরও ছিল।

অতনু : গুরনাহ শুনেছি আপন অতীত অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে তুলে ধরেন, পাঠক গোগ্রাসে গেলে, কখনও ক্ষতবিক্ষত হয়। এই সব রচনা স্বাভাবিক ভাবেই নজর টানবে, হয়তো দেরি হবে সামান্য।

বইতন্ত্র : এবার বলি, আপনার লেখাগুলিও, এখনও পর্যন্ত, আপনার নিজের জীবনের সঙ্গে অতি-সম্পৃক্ত। নিজের চোখে দেখা অবিকল ছবি এঁকেছেন। লিখতেই যদি হয়, তবে লেখার জন‌্য এই চিন্তাভাবনাটা আপনার মধ্যে কীভাবে এল?

অতনু : অ্যানি বা গুরনাহের সঙ্গে আমার লেখা তুলনাতেই আসে‌ না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলেও ওঁদের সৃষ্টিগুলোয় একটা অনুচ্চারিত জীবনবোধ রয়েছে। শেষ করলে একটা কিছু বার্তা পাঠককে আচ্ছন্ন করবেই‌। সে জন্যই ওঁরা প্রকৃত সাহিত্যিক। লেখক। সে জায়গায় আমার লেখা নিছকই বর্ণনা, তাৎক্ষণিক উত্তেজনা জাগলেও ভিন্নতর কোনও মাত্রা নেই। অন্তত আমার তাই ধারণা। ঘটনাচক্রে খনি অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ও বিশেষ কিছু বন্ধুর সুবাদে ওখানকার অপরাধ ও মাফিয়াজগৎকে কাছ থেকে দেখেছি, বিচিত্র কিছু ডার্ক ক্যারেক্টারকেও। ভাবলাম, গুরুগম্ভীর বিষয় পড়ে পড়ে সবাই বোর, এদের কথা শোনালে লোকজন হয়তো ইন্টারেস্ট পাবে। এই ভেবে আচমকা লিখতে শুরু করা, কোনও সুচিন্তিত প্ল্যানিং ছিল‌ না। উপরন্তু ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম এখন‌ মুঠোয় মজুত। 

বইতন্ত্র : আপনি পেশায় সাংবাদিক। বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাবলি আপনি তীক্ষ্ণ নজরে দেখেছেন, অন‌্যভাবে বিশ্লেষণ করেছেন দীর্ঘসময়। আপনার অজান্তেই কি সেই সাংবাদিক চেতনাটা বিষয় নির্বাচনের জন‌্য কাজ করেছে?

অতনু : অনেকটাই। বিশেষত মেদ ছেঁটে লেখায় ধার আনার জন্য পেশাটা কাজে লেগেছে। প্লাস শিখ দাঙ্গার মতো ঘটনা, বিহারে মণ্ডল কমিশন আন্দোলনের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদির প্রেক্ষাপট বিস্তৃত করতে সাংবাদিকতার ভূমিকা থাকবেই। তবে বিষয়গুলো ঠিক নির্বাচন করতে হয়নি, আপনা থেকেই মগজে খেলে গেছে।

বইতন্ত্র : তার মানে আপনি বলছেন, সাহিত‌্য লিখবেন এবং সেগুলি বই আকারে প্রকাশিত হবে, এমনটা আপনার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আগে আসেনি?

অতনু : একেবারেই না।

বইতন্ত্র : আমি দেখেছি, আপনি প্রথমে নিছক স্মৃতি রোমন্থনের মতোই নিজের অতীত জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা সোশ‌্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছিলেন। তাতে খুব ভাল সাড়া পেয়েছেন আপনি। আমার মনে আছে, তখন বোধহয় একটি ওটিটি প্ল‌্যটফর্মে ‘সেক্রেড গেমস’ আর ‘মীর্জাপুর’ চলছিল– দু’টি থ্রিলার-ধর্মী সিরিজ দর্শকমহলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আপনার পোস্টগুলিকেও অনেকে ওই সিরিজের লাইনে ফেলে পরের পর্বের জন‌্য অধীর অপেক্ষা করত।

অতনু : ব্যাপারটা আমার কাছেও অপ্রত্যাশিত, সুখকরও। আসলে মনে হয়, জটিল-কুটিল, সেক্স, রোমান্স, ফ্যামিলি ড্রামায় কণ্টকিত কিংবা হাই ভোল্টেজ গুগলনির্ভর কল্পনাবিলাসের ভিড়ে হাঁসফাঁস পাঠক কখনও বাস্তবের দুনিয়া নিয়ে সহজ সরল লেখা চান, একটু শ্বাস ফেলার জন্য। 

বইতন্ত্র : প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতাটা কেমন? 

অতনু : অদ্ভুত। তবে খুব একটা আলোড়িত হইনি, কারণ সে বই কোনও সাড়াই ফেলেনি। হাঃ হাঃ।

বইতন্ত্র : এই সময় বইবাজারে দুটো বই চলে– ক্লাসিক আর থ্রিলার। আপনি সেই বাজারে অন‌্য স্বাদের বই লিখবেন ভাল কথা, কিন্তু সে বই ছেপে  তো প্রকাশককেও ঘরে টাকা তুলতে হবে। কোথাও কি একটু ঝুঁকি মনে হয়েছিল?

অতনু : অ্যাকচুয়ালি এগুলো মাথায় আসেইনি। ফেসবুকের গণ্ডি ছাড়িয়ে  দোকানের তাকে ঠাঁই হবে আমার লেখার, স্বপ্নেও ভাবিনি।

বইতন্ত্র : পর পর, খুব কম সময়ের মধ্যে আপনার কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়ে গেল। পাঠক এবং প্রকাশকের প্রতিক্রিয়া কী?

অতনু : খুব ভাল। আমি অভিভূত। তবে এই ধরনের‌ লেখার পাঠক সীমিত। বিশেষ‌ করে প্রেম ও নারীচরিত্রবিহীন কাহিনী, ও তা নিয়ে বই- এটা সিংহভাগের হজম হয় না। যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁরা খুবই আগ্রহী। ওঁদের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা।

বইতন্ত্র : আর সমসাময়িক লেখকদের প্রতিক্রিয়া?

অতনু : জানি না। লেখক ও সাহিত্যবৃত্তে আমার কোনও আনাগোনা নেই, উৎসাহও নেই। কাউকে চিনি না। ইন ফ্যাক্ট, আমি একেবারেই ইন্টেলেকচুয়াল‌ নই, সিরিয়াস কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই না। লাচুয়া টাইপ। বাংলা ক্ল্যাসিক‌ও বিদেশি থ্রিলার ছাড়া বিশেষ কিছু পড়ি না। তাই ওঁদের লেখা আমি পড়ি না, ওঁরাও বোধহয় আমার লেখা পড়েন‌ না।

বইতন্ত্র : আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছা করছে, আগে কবি-সাহিত্যিকরা পাঠক-গুনমুগ্ধদের কাছ থেকে চিঠি পেতেন। তারমধ্যে আবার অনেক প্রেমপত্রও থাকতো। আপনি কি তেমন সব পাচ্ছেন?

অতনু : আরে ধুর। আমার পাঠক বলতে প্রধানত বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতেরা। কে প্রেমপত্র দেবে? হাঃ হাঃ।

বইতন্ত্র : শুনেছি অফিস সামলে আপনি লেখেন। তাই সকালে পুরো সময়টাই লেখার টেবিলে থাকেন। বৌদি বাজার যেতে বললেও কাটিয়ে দেন। সত্যি নাকি?

অতনু : বাজারহাট কোনওকালে করতে হয় না, মানে ভরসা করেন‌ না। সে দিকে ভাগ্যবান। সকালে‌ লেখার ব্যাপার‌ নেই, অফিস থাকলে তো প্রশ্নই ওঠে না। খুবই অলস। ছুটির দিনে রাতে, আর যাতায়াতের পথে টুকটাক। ব্যাস।

বইতন্ত্র : আপনার নতুন বই সম্পর্কে আপনার পাঠকদের কিছু বলুন।

অতনু : 'নদিয়া চলে চলে রে ধারা' এমন এক জগতের এমন এক হিংস্র, রক্তস্নাত কাহিনী, বাঙালি পাঠকেরা যা এ যাবৎ পড়েননি। কারণ, এমন অভিজ্ঞতা কোনও সো কলড লেখকের নেই। এ বৈঠকখানার কল্পনার ফসল‌ নয়। আমার মনে হয়, বাংলায় এই বিষয়বস্তু একেবারে নতুন, সেটা ভাল‌ না খারাপ তা অন্য কথা। এর বেশি কিছু বলার‌ নেই।

Post a Comment

Previous Post Next Post