বিশ্বের সমস্ত লেখক-পাঠক-প্রকাশকের জীবনের সাধ থাকে, একবার অন্তত ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় যাওয়ার।
সারা পৃথিবীজুড়ে উদযাপিত হয় হাজারো উৎসব। কিন্তু বইয়ের উৎসব ঘিরে মানুষের উন্মাদনা অসীম। মনের ভাব প্রকাশে বা ইতিহাস লিখে রাখতে বহু যুগ আগে বইয়ের উদ্ভাবন। আজ ডিজিট্যাল যুগেও সেই বইয়ের গরিমা বিন্দুমাত্র কমেনি। আর সেই বইয়ের উৎসব বইমেলা। নতুন বইয়ের গন্ধে আমোদিত হয় বইমেলা। ঘ্রান নিতে ছুটে আসেন বইপ্রেমীরা।
বিশ্বে প্রথম বইমেলা শুরু হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। সেই পঞ্চদশ শতকে। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে মেঞ্জ শহরে। তাঁর আবিষ্কার বইয়ের জগতে এক বিপ্লব এনেছিল। গুটেনবার্গ নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন। তাঁকে দেখে শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাঁদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে সেখানে। আর সেই বই কিনতে বইপ্রেমীরাও ভীড় জমাতে থাকে। এরফলে সেই জায়গা এক মেলার চেহারা নেয়। তবে ইতিহাসের নানা ওঠাপড়ায় ক্রমে ক্ষীনজীবী হয়ে পড়ে বিশ্বের প্রথম বইমেলা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা আবার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে বইমেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল ‘জার্মান প্রকাশক সমিতি’। ১৯৬৪ সালে মেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অক্টোবরের মাঝামাঝি পাঁচদিনের বইমেলা এ কালের সাহিত্যবিশ্বের সবচেয়ে বড় তীর্থক্ষেত্র। বিশ্বের সমস্ত লেখক-পাঠক-প্রকাশকের জীবনের সাধ থাকে, একবার অন্তত ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় যাওয়ার। এখন মেলার আয়োজক জার্মান পাবলিশার অ্যান্ড বুকসেলার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি বছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিক সহ বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে এই মেলা প্রাঙ্গণ। এই বইমেলা মূলত বইয়ের স্বত্ত্ব কেনাবেচার। শেষদিন মেলা খুলে দেওয়া হয় সাধারণ পাঠকদের জন্য।
বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপের বাণিজ্য ও ব্যাঙ্কিংয়ের কেন্দ্রে ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট। সেই সুবাদে ফ্রাঙ্কফুর্টাস মেসের কথা শোনা যায় দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে । ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৪৭৮ সাল থেকে এখানে বইমেলা হত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার গুরুত্ব ছিল।
১৯৭৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আয়োজকদের একজন ছিলেন পিটার ওয়েডহাস। তাঁর ‘আ হিস্টি অব দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ার’ নামে বইয়ে তিনি লিখেছেন, রাজা অষ্টম হেনরি নাকি স্যার টমাস বোডলিকে এই বইমেলায় পাঠিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন লাইব্রেরির জন্য বই কিনতে। পরবর্তীকালে, সম্ভবত রানি মেরির রাজত্বকালে (এথনিক ক্লিনজিংয়ের নামে নির্বিচার গণহত্যার জন্য যাকে ব্লাডি মেরি নামেও ডাকা হয়েছে) নিষিদ্ধ বইয়ের এক তালিকা বানানো হয়। মেলার বহু বই ছিল সেই তালিকায়। এ কারণে ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রকাশনা ব্যবসা সে সময় প্রভূত ক্ষতির মুখে পড়ে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রটেসন্ট্যান্ট শাসনাকালে ফ্রাঙ্কফুর্টকে ম্লান করে দিয়ে লেইপজিগ শহর প্রকাশনা বাণিজ্যের কেন্দ্রে চলে আসে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৪৯ সালে ২০৫টি জার্মান প্রকাশনীকে নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলা। সেই মেলাই এখন আন্তর্জাতিকভাবে বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার প্রকাশনী সংস্থা এতে অংশগ্রহণ করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন