সর্বনাশ! ব্রাসেলসে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেললেন টুটু বোস। তারপর যা ঘটল

সদ‌্য প্রকাশিত হয়েছে বাঙালি উদ‌্যোগপতি টুটু বোসের আত্মজীবনী ‘শূন্য থেকে শুরু’। তাতেই এমন অসংখ‌্য অ-জানা কাহিনী উঠে এসেছে। তাঁর ব‌্যবসায় উত্থান, পরিবার, বিবাহ, মোহনবাগান, সংসদে যাওয়া– সবই চরম নাটকীয়। 

autobiography-by-swapan-sadhan-bose-sunyao-thake-suru

ব্রাসেলসের আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে তখন ভিড়, ব‌্যস্ততা, অ‌্যানাউন্সমেন্ট মিলিয়ে তুঙ্গ মেজাজে। ব‌্যবসার কাজকর্ম শেষে বাড়ি ফেরার বিমান ধরতে সেই এয়ারপোর্টে হাজির বাঙালি উদ‌্যোগপতি টুটু বোস। ট্রলির উপর যতযাবতীয় দরকারি কাগজপত্র সহ হ‌্যান্ডব‌্যাগটিকে চড়িয়ে সেটি টানতে টানতে কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছেন তিনি। আশপাশে এটাসেটা দেখছেন। আচমকা কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে থামতে হল তাঁকে। বোঝা গেল না, তবে হ‌্যান্ডব‌্যাগটি ধাক্কায় নীচে পড়ে গিয়েছে। টুটুবাবু নিচু হয়ে সেটি কুড়িয়ে নিলেন। এরপর কাউন্টারে পৌঁছে তো তিনি হতবাক। ব্রহ্মতালু শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এখন কী হবে! 

চটজলদি গাড়ি ডেকে সোজা ভারতীয় দূতাবাস। তবে সেখানে জানানো হল নতুন পাসপোর্ট পেতে একমাস লাগবে। তা শুনে আরও শঙ্কা তখন চেপে ধরেছে ডাকাবুকো, হাঁকডাক করনেওয়ালা টুটুবাবুকে। তবে কি শেষপর্যন্ত অবৈধ অভিবাসী হয়ে ফাটকে যেতে হবে?

না, যেতে হয়নি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেদিন নতুন পাসপোর্ট পেয়ে পরের দিনই কলকাতায় ফেরার বিমানে উঠেছিলেন টুটুবাবু। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে শুরু হওয়া একটি গল্প শেষ হয়েছিল ৭,৬৬৬ কিমি দূরে কলকাতার ময়দানে মোহনবাগান টেন্টে এসে। একবার নয়, দু’বার বিদেশে পাসপোর্ট হারিয়েছেন টুটুবাবু। দ্বিতীয়বার স্পেনে। সেবার সঙ্গে স্ত্রী শম্পা বোসও ছিলেন।

তিনি স্বপনসাধন বোস। ২৩ জানুয়ারি জন্মানোয় মামবাড়িতে নাম রাখা হয়েছিল সুভাষসাধন বসু। স্কুলে ভর্তির সময় নাম বদলে হল স্বপনসাধন বসু। অগ্রগণ‌্য বাঙালি উদ্যোগপতি। সদ‌্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী ‘‘শূন্য থেকে শুরু’। তাতেই এমন অসংখ‌্য অ-জানা কাহিনী উঠে এসেছে। তাঁর ব‌্যবসায় উত্থান, পরিবার, বিবাহ, মোহনবাগান, সংসদে যাওয়া– সবই চরম নাটকীয়। আত্মজীবনী, তবে এক বাঙালির শুন‌্য থেকে বিশাল ব‌্যবসা সাম্রাজ‌্য গড়ে তোলার কাহিনীর পরতে পরতে রোমাঞ্চ রয়েছে, যা যে কোনও থ্রিলারকে হার মানায়। টানটান চিত্রনাট‌্য, যা কোনও বিধাতাপুরুষের লেখা নয়, টুটুবাবুর নিজের হাতে গড়া। তিনি লিখেছেন, ‘যারা বলে– স্বপ্ন দেখো না, কারণ স্বপ্ন কখনও সত‌্যি হয় না, আমি তাদের দলে পড়ি না। আমি নাম লিখিয়েছি সেই দলে বরং–যারা অকাতরে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের সাধানায় মজে থাকে, আর স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে পরিশ্রম করে অক্লান্ত।’ স্বপনসাধন– এখানেই তাঁর নামের সার্থকতা। 

ভাল মেজাজে থাকুন, বা মেজাজ খারাপ, একটি কমন সংলাপ তাঁর মুখে লেগে আছে– ‘আমার নাম টুট বোস, যে চেনে না তার কপালের দোষ।’ তাহলে, নিজেকে চেনাতে কেন একটি আত্মজীবনী লিখতে হল তাঁকে? তিনি নিজেই এই জরুরী প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন বইটিতে। বলেছেন, প্রথমত, নিজের জন‌্য উত্তর খুঁজতে। দ্বিতীয়ত, অন‌্যদের জন‌্য ঠোঁটের ডগায় জুতসই জবাবটি মজুত রাখতে। ৭৫টি বসন্ত পেরিয়ে লিখলেন এই আত্মজীবনী। আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়েছে জন্মদিনের ২৪ ঘণ্টা আগে। ইতিমধ্যেই বইটি নিয়ে সবমহলে আলোচনা তুঙ্গে। টুটুবাবু– কতটা পারিবারিক, কতটা শিল্পপতি, কতটা মোহনবাগানের বা কতটা রাজনীতির– হিসাব কষতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন অনেকেই।

২০০৫ সাল। ব‌্যবসার কাজে ব‌্যাংককে গিয়েছেন টুটুবাবু। সঙ্গে গিয়েছেন স্ত্রী-ও। কাজকর্ম মিটতে পরিকল্পনা করেছেন আরও দু’দিন থেকে বিবাহবার্ষিকীটাও সেখানে কাটিয়েই ফিরবেন। মাঝরাতে কলকাতা থেকে পুত্র সৃঞ্জয় বোসের ফোন। মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায় তাঁকে রাজ‌্যসভায় মনোনীত করতে চান। ব‌্যবসা-ই ধ‌্যানজ্ঞান, যিনি কখনও প্রত‌্যক্ষ রাজনীতিতে আসার কথা ভাবেননি, সেই টুটুবাবুই...। অগত‌্যা, তড়িঘড়ি কলকাতায় ফেরা। তাঁর রাজ‌্যসভার দিনগুলি কেমন ছিল, বইতে লিখেছেন টুটুবাবু। তেমনই লিখেছেন রাজ‌্যসভায় যাওয়ার নেপথ‌্য কাহিনী। টুটুবাবু অকপটে স্বীকার করেছেন, একটা সময় ঘুড়ি বা কলম বিক্রি করে হাতখরচের টাকা জোগাড় করতে হয়েছে। বাসে চেপে স্কুলে গিয়েছেন। অথচ, তিনি বোসবাড়ির ছেলে, অবস্থাপন্ন বনেদি বড়লোক। অনেকেই বলেন, হয়তো, তরুণবয়সে সাইকেলে চেপে চক্কর আর রকের আড্ডাতেই ‘বড়মানুষ’, ‘বড় মনের মানুষ’ হয়ে উঠেছেন টুটুবাবু।

‘সংবাদ প্রতিদিন’ কাগজ আর মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে টুটু বোসের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। রকমারি ব‌্যবসা করেছেন। সফল হয়েছেন, কখনও ব‌্যর্থতাও এসেছে। ভেঙে পড়েননি। স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। তাঁর কাছে ব‌্যবসার আসল ‘মূলধন’– মানুষকে ভালবাসা, এবং নিরবিচ্ছিন্ন ভালবাসা পাওয়া। 

অনেকেই বলে থাকেন, মোহনবাগান আর টুটুবাবু সমার্থক। আত্মজীবনীর প্রারম্ভে তাঁর বন্ধু অশোক দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘টুটুবাবুর দুর্বলতা একটাই। মোহনবাগান। সমর্থকরা ওঁকে ভালবাসে। শুধু আর্থিক নয়, অনেক দিক দিয়েই ক্লাবের সঙ্গে থেকেছে বটগাছের মতো।’ আর টুটুবাবু নিজে লিখেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি ডাকাবুকো। ঠিক করে নিয়েছিলাম, যদি কখনও দায়িত্ব পাই, মোহনবাগানের জন‌্য স-অ-ব করব। ইস্টবেঙ্গল ৫ গোল গিয়েছে, আমরাও ৫ গোল শোধ দেব।’ এমনই অনেক ঘটনা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে– যা ‘রামধনুর’ মতো বর্ণিল’, তবে সংযত বিতর্ক উস্কে দেওয়ার জন‌্য রসদে ভরা।

Post a Comment

Previous Post Next Post