অমরবাবু তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে কু-সাহিত্য চালু হয়েছে। এসব লেখা বন্ধ করুন। দেশ ক্রমশ ভরে যাচ্ছে কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে।’
অমরবাবু তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে কু- সাহিত্য চালু হয়েছে। এসব লেখা বন্ধ করুন। তিলজলার ঘটনা ঘটবে না। দেশ ক্রমশ ভরে যাচ্ছে কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে। এর জন্য আমরা কম দায়ী নই। এই সব বই তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। রাষ্ট্র চায় আমরা এইসবে ডুবে থাকি, যত অজ্ঞানতা, তত তন্ত্র-মন্ত্র। বালিকা খুন।’ এরপর তাঁকে সমর্থন করেছেন বেশ কিছু মানুষ। পোস্টের কমেন্ট বক্সে লেখিকা-সমাজকর্মী কাবেরী রায়চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় যদি লিখতেও হয় তাহলে পরিশেষে লেখক এর বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখেন যেন! যাতে এই অন্ধকারের দিকে মানুষ প্রভাবিত না হয়। লেখক যেন পাঠককে যুক্তি র সামনে দাঁড় করিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেন। কিন্তু বর্তমানে যে নীম্নমানের ভূতপ্রেত চর্চা হচ্ছে লেখায় তা না তো পাঠ যোগ্য না সাহিত্য...অথচ এইসব আবার বেস্ট সেলার! কয়েকশো সংস্করণ হয়!!!’ জনৈক সুজিত দে লিখেছেন, ‘যত দিন যাচ্ছে তত তন্ত্র মন্ত্র ভূত-প্রেত ডাকিনী পিশাচ কালা জাদু এইসব বইয়ের চাহিদা বাড়ছে, বই পাড়ায় এক ঘন্টা দাঁড়ালেই দেখা যায় এই সব বই ঝুড়িঝুড়ি বিক্রি হচ্ছে।’
অবশ্য, বিরুদ্ধ মতও দেখা গিয়েছে। পেশায় কার্ডিওলজিস্ট সুভেন্দু বিকাশ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘ওই খুনের ঘটনায় তান্ত্রিক এর ঘটনা কষ্টকল্পিত। আজকের সংবাদপত্র তাই বলছে। কিন্তু এগুলো সাহিত্যের এক একটি ধারা। অপরাধের জন্য লেখা বন্ধ কেন হবে? তাহলে তো স্বপনকুমার পড়ে মানুষের খুন করতে ইচ্ছে হবে।’ লেখক উপমনু্য রায়ের মতে, তন্ত্র, মন্ত্র, মানে অতিপ্রাকৃত বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাস মানেই কু-সাহিত্য বলে দেগে দেওয়া উচিত নয়। তিনি নিজের ফেসবুক পোস্টে (অমরবাবুকে জবাব দিয়ে) লিখেছেন, ‘রহস্য, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার, ভৌতিক গল্প-উপন্যাস যে সব সুদূর অতীত থেকে লেখা হয়ে আসছে, এখনও হচ্ছে, পাঠকরা এক নিশ্বাসে গেলেন যে সব কাহিনি, সেগুলি সবই কু-সাহিত্য!’ তিনি আরও লিখেছেন, মনে হয়, ওঁর (অমরবাবু) লেখা সু-সাহিত্যগুলি বিভিন্ন মাধ্যমে যে ব্যাপক প্রচার পায়, বোধ হয় সেই তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য হয় না। তাদের কাছে একেবারেই পৌঁছয় না। পৌঁছয় শুধু রহস্য-রোমাঞ্চের মতো কু-সাহিত্যগুলিই। তাই মানুষ ওইসব কু-সাহিত্য পড়েই উৎসাহিত হয়। আর তাই তাঁর লেখা সেই মহান সাহিত্যগুলি কাউকে প্রভাবিত করে না। ভাল কাজে উৎসাহিতও করে না।’
এখানে বলে রাখি অমর মিত্র সাহিত্য অকাদেমি পেয়েছেন (ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য)। তিনি বঙ্কিম পেয়েছেন (অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য)। তিনি শরৎ পুরস্কার (ভাগলপুর), গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো উপমনু্য তরুণ লেখন। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রেত রহস্য’, ‘গভীর রাতের আতঙ্ক’, ‘অশরীরী আতঙ্ক’ পাঠকমহলে সাড়া ফেলেছে।
অন্যদিকে, কবি ও সাংবাদিক অনিমেষ বৈশ্য তাঁর নিজের ফেসবুক পেজে অমর মিত্রর মন্তব্যই পোস্ট করেছেন। সেটি আবার ৩৪ বার শেয়ার হয়েছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাঁরা সবাই অমরবাবুর সঙ্গে একমত। অনিমেষবাবুর পোস্টে। সেখানে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পাঁচশোর বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছে। প্রায় ৫০ জন কমেন্ট বক্সে নিজের নিজের মতামত জানিয়েছেন। সেখানে আশুতোষ ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তি তীব্র কটাক্ষ হেনে লিখেছেন, ‘এই তন্ত্র মন্ত্র কালা জাদু সাহিত্য করে কত ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট গুরু লেখক হয়ে গেল। সাত মাসে চোদ্দ সংস্করণ হল সেই বইয়ের, প্রগতিশীল সব প্রকাশক সেই বই ছেপে হাসি হাসি মুখে ছবি দিলেন। আর আপনি সেই ইস্টিশন, শিউলি ফুল, রবিঠাকুর, তালপাতার বাঁশি আর শীতলপাটি নিয়ে পড়ে রইলেন।’ আবার মৌ শুভশ্রী রায় নামে একজন লিখেছেন, ‘রাষ্ট্র জানে তন্ত্র মন্ত্র ভিত্তিক সাহিত্য জনপ্রিয়। তাই এগুলো যত ছড়িয়ে পড়ে তত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাড়ে। মানুষ এ সব নিয়ে মেতে থাকবে , সেই সুযোগে রাষ্ট্র দিব্যি শোষণ চালিয়ে যাবে আর সামান্য ক' জন প্রতিবাদ করে অসম্মানিত হ'বে।’
বস্তুত, সমাজে সাহিত্যর প্রভাব অনস্বীকার্য। একটা মানসিকতা, মূল্যবোধ, আবেগ তৈরিতে সাহিত্যর ভূমিকা অপরিসীম। সাহিত্য ব্যক্তিকে মার্জিত করে। মোট কথা, সাহিত্যচর্চায় মানুষের জৈবিক ও আত্মিক– এ দুই সত্তারই উৎকর্ষ সাধন হয়। ইতিহাস সাক্ষী, অতীতে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন, সামাজিক আন্দোলন, সিস্টেম বদলের বিপ্লবের সূতিকাগৃহ ছিল কোনও একটি বই– অর্থাৎ সাহিত্য। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক দেবাশিস কর্মকার বলেন, “গত কয়েক বছর যাবৎ একটি বেসরকারি এফএম চ্যানেলে সাসপেন্স অডিও স্টোরির নামে তন্ত্র-মন্ত্র সাধনার গল্প সম্প্রচার ও তা জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে এই ধারার লেখার উপর অনেকের উৎসাহ বেড়েছে। এফএম-এর গল্প বা গল্পের বইয়ে ‘খোলামনে গ্রহণের’ একটি আইনমাফিক ডিসক্লেমার দিয়ে তো সমাজের প্রতি দায় সারা যায় না। এ ব্যাপারে লেখক-প্রকাশকদের যেমন সতর্ক হতে হবে, তেমনই পাঠকদেরও রুচি বদলাতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “আমি ইদানিংকালে এমন কয়েকজন লেখককে দেখলাম যাঁরা সেই নবীন বয়েস থেকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প, সামাজিক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, এখন তাঁরাই তন্ত্র-মন্ত্র সাধনার গল্প লিখতে কলম ধরেছেন। হয়তো এই ধারার বইয়ের বাজারে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই তাঁরা এটা করছেন। তিলজলার ঘটনায় নিশ্চিতভাবে কোনও বাংলা সাসপেন্স থ্রিলারের সরাসরি যোগ নেই। তবে সামাজিক মননে যে ওই ধরনের সাহিস্য প্রভাব ফেলছে, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।”
জনৈক পাঠিকা শেলী ভট্টাচার্য বলেন, বই বেশি বিক্রি হবে বলে যা হোক লিখে ফেললেই হল? পাঠক কেন লেখক তৈরি করবে, বরং লেখকেরই তো উচিৎ রুচিশীল পাঠক তৈরি করা। জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে, সাসপেন্স থ্রিলারের নামে কুসংস্কারকে প্রোমট করা হলে সমাজে তাঁরা লেখক-সাহিত্যিক হিসাবে কোন দায়িত্ব পালন করলেন? তাছাড়া, এভাবে তো ভাল সাহিত্য আর লেখাই হবে না। তাতে পুরো সাহিত্যচর্চাই থেমে যাবে।”
উপমন্যু একটি সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, “কু-সাহিত্য সব লেখা বন্ধ হয়ে গেল! অমর মিত্ররা দলে দলে মহান সাহিত্যই লিখে যেতে শুরু করলেন! তাঁদের বই যে ভাল বিক্রি হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকাশনা জগৎ বাঁচবে তো? প্রকাশনার বাজারে কতখানি অক্সিজেন দিতে পারবেন তাঁরা? পৃথিবীর কোথায় কারা দিতে পেরেছেন?” এ ক্ষেত্রে দেবাশিস কর্মকার বলেন, “অবশ্যই বই বাজারের ব্যবসা সবচেয়ে বড় বিষয়। আমি বরাবরই এর পক্ষ নিয়েই কথা বলেছি। এ ক্ষেত্রে বলতে পারি পাঠককেও রুচি বদলাতে হবে। সাসপেন্স ছাড়াও অনেক তরুণ লেখক ভাল সামাজিক, ঐতিহাসিক পটভূমিতে গল্প-উপন্যাস লিখছেন। সেগুলিও হাতে তুলে নিতে হবে পাঠককে।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন