Perumal Murugan : মা বেচে দেবে ভয়ে বই লুকিয়ে রাখতাম

পেরুমল মুরুগানের উপন্যাস ‘পাইরে’ আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের লং লিস্টে স্থান পাওয়া প্রথম তামিল বই হয়ে উঠেছে। ২৩ মে বিজয়ী ঘোষণা হবে।

Perumal Murugan : মা বেচে দেবে ভয়ে বই লুকিয়ে রাখতাম


২০১৫ সালের জানুয়ারি। ভারতীয় সাহিত‌্য চর্চার জগতে অন‌্যতম একটি ‘কালো দিন’ হিসাবেই থেকে যাবে। বিশিষ্ট তামিল সাহিত‌্যক পেরুমল মুরুগানের একটি ফেসবুক পোস্ট সেদিন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘পেরুমল মুরুগানের লেখক সত্তা মৃত‌্যু হয়েছে। যেহেতু তিনি কোনও ঈশ্বর নন, তাই নিজেকে পুনরুত্থিত করার কোনও ইচ্ছা তাঁর নেই। পুনর্জন্মেও তাঁর বিশ্বাস নেই। একজন সাধারণ শিক্ষক হিসাবেই পেরুমল মুরুগান বেঁচে থাকবেন। তাঁকে একা থাকতে দিন।’
তবে পাঠকদের কাছে অত‌্যন্ত আনন্দের বিষয় হল, লেখক মুরুগানের পুনর্জন্ম ঘটেছে। ২০১৬ সালেই তাঁর ‌‘পিয়রে’ উপন‌্যাসটি প্রকাশিত হয়। সেই উপন‌্যাস ২০২৩ সালের বুকার পুরস্কারের (Booker Prize) জন্য লংলিস্টেড হয়েছে। মোট ১৩টি বই এবার লংলিস্টেড হয়েছে বলে বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশনের তরফে জানানো হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার নানা দেশের লেখকদের বইয়ের মধ্যে রয়েছে মুরুগানের (Perumal Murugan) উপন্যাসটিও। মুরুগানই প্রথম তামিল লেখক যাঁর বই বুকার পুরস্কারের জন্য লংলিস্টেড হল। তাঁর ‘পিয়রে’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অনুরুদ্ধান বাসুদেবন।
২০১০ সালে মরুগানের লেখা উপন‌্যাস ‘মাধোরুবাগান’ বা ‘ওয়ান পার্ট উইমেন’ প্রকাশের পরে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তামিলনাড়ুর পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত একটি সামাজিক প্রথাকে উপজীব‌্য করে একটি মর্মান্তিক গল্প তুলে এনেছিলেন মুরুগান। যেখানে নিঃসন্তান মহিলারা এক রাতে যে কোনও অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। তা-ও বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়, স্থানীয় মন্দির উৎসবের সময়। সেই রাতে যৌনতাকে ঘিরে থাকা নিষেধাজ্ঞাগুলিকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়।
সেই বই আচমকাই পাঁচ বছর পরে বিতর্কিত হয়ে ওঠে। হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ লেখককে নারী ও মন্দিরের ঐতিহ্যের অবমাননা করার দায়ে অভিযুক্ত করে। বইটি নিষিদ্ধ হয়। সারা তামিলনাড়ু জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। মুরুগান এর পরে লেখালেখি ছেড়ে দেন এবং স্ব-আরোপিত নির্বাসনে চলে যান। কিন্তু এক বছর পর আদালত তাকে ক্লিন চিট দিলে তিনি আবার কলম হাতে নেন।
সাত বছর পর তাঁর উপন্যাস ‘পাইরে’ (Pyre) আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের লং লিস্টে স্থান পাওয়া প্রথম তামিল বই হয়ে উঠেছে। ২৩ মে বিজয়ী ঘোষণা হবে।
‘পাইরে’-র গল্প গত শতাব্দীর আশির দশকে একটি তামিল গ্রামের। এটি সেই সহিংসতার কথা বলে যা একটি আন্তঃবর্ণ দম্পতি যখন তাদের গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। বুকার পুরস্কারের জুড়িদের কথায়, "পেরুমাল মুরুগান ক্ষমতার এবং বিশেষ করে, জাতিবিদ্বেষ ও সহিংসতার গভীর, বিকৃত পচনের একজন মহান শারীরতত্ত্ববিদ।” ৫৬ বছর বয়সী মুরুগান তামিল সাহিত্যের একজন বিস্ময়। তিনি দশটি উপন্যাস, পাঁচটি ছোট গল্পের সংকলন এবং চারটি কবিতার সংকলন লিখেছেন। তাঁর কাজ পশ্চিম তামিলনাড়ুর জীবনের অন্বেষণ। তাঁর নিজেরও ভিত্তিভূমি পশ্চিমাঞ্চলের কঙ্গু অঞ্চল। তিনি এই অঞ্চলের প্রথা এবং উপভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। চাঁদের আলোয় নারকেলের পাতার ঝাঁকে খসখস শব্দে নড়াচড়া, শস‌্যগোলায় দম্পত্তির প্রেম, হাওয়ায় দুলতে থাকা বাজরার খেত– এ সব কিছুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে মুরুগানের লেখায়। ‘পাইরে’ উপন‌্যাসে আমরা দেখতে পাই, তিনি কঙ্গুর অঞ্চলের ধুলো ওড়া ছোট শহর এবং সেখানকার মানুষের অদ্ভুত প্রবণতাগুলি বাইরের জগতে নিয়ে এসেছেন। বুকার পুরস্কারের জন‌্য দীর্ঘ তালিকায় তাঁর বই স্থান করে নেওয়ার পর লেখক মুরুগান বলেন, একটি তামিল উপন‌্যাসের এই জায়গায় পৌঁছনো ঐতিহাসিক। আমি আনন্দিত, এটা তামিল সাহিত্যের স্বীকৃতি।
মরুগান কৃষি পরিবারের সন্তান। তাঁর এবং ভাইবোনকে শুধু একটি কারণেই স্কুলে পাঠানো হত, তা হল স্কুলে দেওয়া পুষ্টিকর ‘মিড-ডে মিল’। তাঁর পিতামাতার একটি শর্ত ছিল, যদি তারা একটি ক্লাসে ফেল করে তাদের স্কুল ছেড়ে দিতে হবে এবং তাদের খেতের কাজে সাহায্য করতে হবে। মুরুগান স্কুলে যেতে পছন্দ করতেন, কারণ সেখানে তাঁর পড়ার এবং লেখার ক্ষুধা মিটত। তার পরিবারে একমাত্র তিনিই স্কুলের পাঠ শেষ করতে পেরেছিলেন। যেহেতু তাঁর বাবা-মায়ের খবরের কাগজ বা বই কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না, তাই মুরুগান তাঁর পড়ার বইয়ের মধ্যেই সবসময় ডুবে থাকতেন। এমন দিন ছিল, যখন তিনি মুদির দোকানে পাওয়া খবরের কাগজের ঠোঙা খুলে তার প্রতিটি শব্দ পড়তেন।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে মুরুগান জানান, ১৯৭৮-৭৯ সালে তিনি প্রথম বইটি কিনেছিলেন। ঘটনাটা এরকম, সেই সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে সালেমে চলে গিয়েছিলেন। সেই বন্ধুর পরিবার তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে রাজি করে। বাড়ি ফেরার বাসে চড়ার ঠিক আগে, তিনি বাস টার্মিনাস থেকে একটি বই কিনেছিলেন। সেটি নমাক্কল কবিগনারের কবিতার সংকলন। স্মৃতি রোমন্থন করে মুরুগান বলেন, “বইটা কিনেছিলাম দশ টাকা দিয়ে। আমার কাছে এখনও সেই বই রাখা আছে।” এরপর কিশোর বয়সে গ্রামে বসেই ভিপিপি (মূল্য পরিশোধযোগ্য পোস্ট)-তে অর্ডার করে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার থেকে বই আনাতেন। তবে বইগুলি রক্ষা করাও ছিল আরেক চ‌্যালেঞ্জ। মায়ের হাতে পড়লে তিনি তা খেজুর বা ভাদা কেনার জন‌্য বিক্রি করে দেবেন। তাই সেই সব বই লুকিয়ে রাখতেন মুরুগান।
মুরুগানের প্রথম গল্প ‘নিগাভু’ (একটি ঘটনা) প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালেপ আগস্ট মাসে আধুনিক তামিল সাহিত্যের অগ্রদূত অশোকামিত্রন সম্পাদিত জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা ‘কানাইয়াঝি’-তে। মুরুগান বলেন, “এটা আমার লেখার জন‌্য বড় সম্মানের ছিল। তিনি ২৫ বছর ধরে তামিল সাহিত্য পড়াচ্ছেন। তাঁর বেশিরভাগ ছাত্রই গ্রামীণ পটভূমি থেকে এসেছে। তিনি নিজেই তাদের অনেকের অনুপ্রেরণা। তাদের মধ্যে বত্রিশ জন তাঁর উপর ‘ইয়েঙ্গাল আইয়া’ (আমাদের শিক্ষক) নামে একটি বই লিখেছেন। বিনিময়ে, তিনি তাদের উপর একটি বই লিখেছিলেন যার নাম ছিল মানাথিল নিরক্কুম মানভারগাল (আমার মনের মধ্যে থাকা ছাত্র)।
বিতর্কে প্রচারের পাদপ্রদীপে চলে এলেও, আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন মুরুগান। তিনি কখনওই নিজেকে সেলিব্রিটি হিসাবে তুলে ধরতে চাননি। এমনকী, তাঁর বই নিয়ে যখন বিতর্ক হয়, তিনি তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেননি। বরং, মাথা নিচু করে নিজের দৈনন্দিন রুটিনে আটকে থেকেছিলেন। বিতর্কের পর লেখালেখিতে ফিরলেও শুরুতে তেমন প্রবাহ পাননি। এরপর তিনি ‘পুনাচি আল্লাথু ওরু ভেলাত্তিন কাথাই’ (পুনাচি বা কালো ছাগলের গল্প) লিখতে শুরু করেন এবং সবকিছু যেন আবার হুড়মুড় করে ফিরে আসে। তিনি বলেন, “যখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমি কিছুই হারাইনি, তখন সেটা ছিল চরম সুখের মুহূর্ত।” অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ২০০টি কবিতা লিখেছিলেন, যা কবিতার প্রতি তাঁর ভালবাসাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে সাহিত্যিক সত্তা তাঁর জন্য কতটা অপরিহার্য।







Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন