‘বিচ্ছিন্ন’ উত্তরবঙ্গের জন-সমাজের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষ তাঁর কলমে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন তাঁর সৃষ্টি।
প্রয়াত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। গত কয়েক দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। চলছিল চিকিৎসা। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সোমবার বিকেলে বিদায় নিলেন ‘কালপুরুষ’। তাঁর প্রয়াণে শিল্প ও সাহিত্য জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর প্রয়াণে বাংলার সাহিত্যে একটি যুগের অবসান হল।
ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রমণ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে ভুগছিলেন সমরেশবাবু। ২৫ এপ্রিল কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। তবু চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন কখনও কখনও। রবিবার পরিবারের সূত্রে জানানো হয়, কিছুটা ভালো আছেন সাহিত্যিক। কিন্তু তার পরেও শেষরক্ষা হল না। গত দশ বছরের বেশি সময় ধরেই ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজের (সিওপিডি) সমস্যা ছিল তাঁর। সেই সমস্যার নিয়মিত চিকিৎসাও চলত। মাঝে-মধ্যে বাড়াবাড়িও হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় সমরেশ মজুমদারের মেয়ে দোয়েল সংবাদমাধ্যমকে জানান, আগের দু’দিন কেবিনে রাখা হয়েছিল তাঁকে। শনিবার বিকেলে আইসিইউতে পাঠানো হয়। চিকিৎসকরা পরের ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখবেন বলেছিলেন।
হাসপাতাল সূত্রে বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি স্ট্রোক হয়েছিল তাঁর। এছাড়াও বালবার পালসিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এর কারণেই ফুসফুস বিকল হয়ে যায় তাঁর। এছাড়া দীর্ঘ দিন সিওপিডি, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার মতো সমস্যাও ছিল তাঁর। সব ক’টি সমস্যা একসঙ্গে এই কঠিন পরিস্থিতি ডেকে আনে। সোমবার বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে তাঁর জীবনাবসান হয়।
সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ ১৯৪২। তাঁর শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে। তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পাড়ার নাট্যদলের জন্য গল্প লিখতেন। একবার একটি গল্প নাট্যদলে বাতিল হয়ে যায়। খামে ভরে ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতায় একটি বিখ্যাত পত্রিকার দফতরে। কয়েকমাস পরে সেই গল্প প্রকাশিত হয় পত্রিকাটিতে। তারপর ইতিহাস। ‘বিচ্ছিন্ন’ উত্তরবঙ্গের জন-সমাজের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষ তাঁর কলমে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন তাঁর সৃষ্টি।
সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’ তাঁকে বাঙালির মনে একেবারে কাছাকাছি নিয়ে চলে এসেছিল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক শোকবার্তায় বলেন, ‘শ্রী সমরেশ মজুমদার বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন । তাঁর লেখনীতে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর পরিবারের প্রতি রইল আমার সমবেদনা। ওঁ শান্তি।’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি শ্রী সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। বাংলার সমাজের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর অমূল্য রচনা বিশ্ববাসীর মনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই কঠিন সময়ে আমি তাঁর শোকার্ত পরিবার ও অনুগামীদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’ প্রবীণ সাহিত্যিকের প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক শোকবার্তায় বলেছেন, 'বিশিষ্ট সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় প্রয়াত হন। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। বাংলা সাহিত্যের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাকার সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত গ্রন্থগুলি হল: দৌড়, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, উত্তরাধিকার, অর্জুন সমগ্র, সাতকাহন ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৮ সালে সমরেশ মজুমদারকে 'বঙ্গবিভূষণ' সম্মান প্রদান করে। এছাড়া তিনি সাহিত্য অকাদেমি অ্যাওয়ার্ড, আনন্দ পুরস্কার, বিএফজেএ পুরস্কারসহ অজস্র সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি সমরেশ মজুমদারের আত্মীয়-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।'
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন