১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই।
বৈশাখ যেমন রবিঠাকুরের মাস, তেমনই নজরুরের জৈষ্ঠ। তাঁকে বলা হয় ‘জৈষ্ঠের ঝড়’। কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ‘বিপ্লবী কবি’। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে বিপ্লবী-সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁর কবিতা। তাই বারবরা তাঁকে ব্রিটিশ শাসকে রক্তচক্ষুর সামনে পড়তে হয়েছে। বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাঁর লেখা কবিতা।
আজ, ১১ জৈষ্ঠ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ হয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল উনিশ শতকের অন্তিমলগ্নে যে কবির, সে ঝড় চিরতরে থেমে গিয়েছিল ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালের কেবিনে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্রে। তাঁর কলম অবশ্য থেমে গিয়েছিল ১৯৪০ সালেই। তবু, আজ আট দশক পরেও তাঁর কবিতা বিপ্লব, আন্দোলন আর প্রতিবাদে ঢেউ তোলে। নবযৌবনকে মুক্তির পথে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করে। আজ তাঁকে স্মরণে রেখে এখানে উল্লেখ করা হল, কীভাবে বারবার তাঁকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ শাসক। কিন্তু তাঁকে পরাস্ত করা যায়নি।
১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই। কবি নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারায় বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা রিপোর্টে ‘যুগবাণী’কে একটি ‘ভয়ংকর’ বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন। ‘ক্রীতদাস মানসিকতার’ ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাসনভার দখলের মন্ত্রণা জোগাচ্ছেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি নিবন্ধে সংকলন ‘যুগবাণী’।
ঠিক দুই বছর পর ১৯২৪ সালে নজরুলের দুটি কবিতার বই পরপর নিষিদ্ধ হয়। প্রথমটি ‘বিষের বাঁশি’। তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘লেখক বিষের বাঁশির মাধ্যমে তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন…।’ অপরাধ তদন্ত বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে প্রকাশনাটির দিকে দৃষ্টি দিতে সুপারিশ করেন তিনি। এরপর ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবরের গেজেট ঘোষণায় ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়।
একটুও অবশ্য বাড়িয়ে বলেননি দত্তগুপ্ত। ‘বিষের বাঁশি’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। এরপর ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর। যদিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও বই দুটির প্রচার বন্ধ করা যায়নি। কবিতার বই দুটি সংগ্রহে যুবকদের আগ্রহের অন্ত ছিল না।
‘প্রবাসী’র মতো অভিজাত পত্রিকা বিষের বাঁশির প্রশংসা করে লিখেছিল, “কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মুত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।”
এরপর সরকারি রোষের কোপে পড়ে কাজী নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’। কবির মনোজগতে তখন তোলপাড় চলছে। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা গিয়েছে সদ্য। বিদ্রোহ-বিপ্লবের পুরোধা কবি কেঁদে কেঁদে আকুল। চোখে জল কিন্তু বুকে আগুন। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল ‘প্রলয় শিখা’র প্রতিটি শব্দে। বিদ্যুৎ গতিতে ‘প্রলয় শিখা’ ছুটলো সমগ্র বাংলায়। পুলিশ গোয়েন্দাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয় শিখা’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে তৎকালীন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান, বইটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩এ ও ১২৪এ ধারা ভঙ্গ করেছে। তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার সুপারিশ করেন তিনি। এর ভিত্তিতে সেই সময়কার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বইটকে অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ১৯৩০ সালের ১৫ সেপ্টম্বর মুখ্য সচিবকে জরুরি চিঠি দেন। ‘প্রলয় শিখা’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে।
এর রেশ কাটতে না কাটতে বাজেয়াপ্তের খড়্গ নেমে আসে ‘চন্দ্রবিন্দু’র ওপর। এটি মূলত ব্যঙ্গ বিদ্রূপের কবিতার বই। তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে এর প্রতি ছত্রে। এর দুটি কবিতা…
“মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিলো চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’’
“কাফ্রি চেহারা ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।”
চন্দ্রবিন্দু নিষিদ্ধ হয় ‘প্রলয় শিখা’ নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাস পর ১৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে। নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ বইয়ের মতো এটিও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৯৯এ ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত হয়। এই
পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও ‘অগ্নিবীণা’, ‘ফণিমনসা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সর্বহারা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’ প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের নজরে পড়েছিল। তবে সেগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
তথ্যসূত্র: নিষিদ্ধ নজরুল, শিশির কর
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন