স্মার্টফোন সর্বস্ব এই যুগে আজকের প্রজন্ম জানেই না ভিস্তিওয়ালাদের কথা। পার্সি শব্দ ‘বেহেস্ত’ শব্দের অপভ্রংশ হয়ে এসেছে ভিস্তি, যার অর্থ হল ‘স্বর্গ’।
৩০০০ বছর পূর্বের ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’-এ মিশরের পিরামিড নির্মাণের দৃশ্যে এক বৃদ্ধা ভিস্তিওয়ালাকে শ্রমিকদের পানীয় জল সরবরাহ করতে দেখা গিয়েছে।
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে পর্যন্ত কলকাতার রাস্তায় ভিস্তিওয়ালাদের দেখা গিয়েছে। তখনও তারা গরমের দিনে রাস্তায় শ্রমিকের কাজ করা মানুষকে জল দিত। সে সময় আজকালকার মতো এমন দোকানে দোকানে বোতলবন্দি সাদা পানীয় জল মিলত না। এমনকী, এখনকার মতো প্লাস্টিকের বোতল, যাকে আমরা পেট বোতল বলি, তা কারও ধারণার মধ্যেই ছিল না। কাজেই বাড়ি থেকে বেরনোর সময় সঙ্গে জলের বোতল নিয়ে বেরনোর কারও কোনও অভ্যাসই ছিল না। ওয়াটার বটল ছিল বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সঙ্গী। তা বাদে রাস্তার ধারে ডাবের জল বা কাচের বোতলে কোল্ডড্রিঙ্কস ছিস তৃষ্ণা মেটানোর একমাত্র উপায়। তা-ও বেশিরভাগ মানুষেরই সেটা কেনার মতো টাকা ছিল না।
তবে সেইসব আমজনতার সহায় ছিল ভিস্তিওয়ালারা। পথে-ঘাটে ঠাণ্ডা জল সরববারহ করত তারাই। ‘ভিস্তি হল এক ধরনের বস্তার মতো দেখতে ব্যাগ। ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি এই বিশেষ থলেকে ‘মশক’ও বলে। এতে ফ্রিজের মতোই ঠান্ডা থাকত জল। আর স্বয়ং জলদাতা এই ভিস্তির জল রাস্তায়-ঘাটে মানুষকে সরবরাহ করত সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে।
অভিবক্ত ভারতবর্ষের ঢাকায় এবং কলকাতায় জল বিলোনোর কাজ করতেন এই ভিস্তিওয়ালারাই। আমাদের দৈনিন্দিন জীবন থেকে একে একে একেকটি পর্ব বিদায় নেয়। হারিয়ে যায়। তেমনই হারিয়ে গিয়েছে সেই ভিস্তিওয়ালারা। কলকাতায় আড়াইশো বছররে পুরানো পেশাটি এখনও জনাকয়েক মানুষ টিমটিম করে বাঁচিয়ে রেখেছে। পার্ক সার্কাস এলাকায় টানা রিকশাওয়ালাদের এখনও ভরসা এই ভিস্তিওয়ালারা। টিউবওয়েল থেকে ভস্তিতে জল ভরে সরবরাহ করা হয়। তবে স্মার্টফোন সর্বস্ব এই যুগে আজকের প্রজন্ম জানেই না ভিস্তিওয়ালাদের কথা। পার্সি শব্দ ‘বেহেস্ত’ শব্দের অপভ্রংশ হয়ে এসেছে ভিস্তি, যার অর্থ হল ‘স্বর্গ’। পৃথিবীর পশ্চিম ও মধ্য প্রান্তে স্বর্গের বেশীরভাগ ছবিতেই মিলেছে নদী ও বাগানের ছবি। কথিত আছে সেই স্বর্গের নদী থেকে জল এনেই ভিস্তিরা তা বিলিয়ে দিতেন মানুষকে। তাই তাদের স্বর্গের-দূতও বলা হত।
শুধু পথে তৃষ্ণার্তকেই নয়, গেরস্থ বাড়িতেও ঠান্ডা পানীয় জল সরবরাহ করত ভিস্তিওয়ালারা। কলকাতা শহরে এককালে এদের একচেটিয়া আনাগোনা ছিল। ভোরবেলা রাস্তায় বেরোলেই দেখা মিলত ভিস্তিওয়ালাদের। কাঁধে জল ভরতি চামড়ার ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন দেহাতি চেহারার মুসলিম সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো। দিল্লিতেও একসময় ছিল ভিস্তির চল। এখনও এখানেই একমাত্র ভিস্তিওয়ালাদের অস্বিত্ব রয়েছে। বহুযুগ ধরে প্রাচীন দিল্লির সাক্কেওয়ালি গলিতেই ভিস্তিওয়ালাদের বাস।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন