তোজোর উপস্থিত বুদ্ধি : অরূপ কর

আজ তোজো সিরিজ পঞ্চম গল্প। প্রথমটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : তোজো-রোনাল্ডো দেখা এবং দ্বিতীয়টি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : ছায়া-দেশে তোজো তৃতীয়টি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : তোজো ও রহস্যে ঘেরা বাড়ির বুড়ো এবং চতুর্থটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে: তোজো-ভুলোর ভূত-আবিষ্কার


ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ার কিছুক্ষণ আগে তোজোর মুখ থেকে বেরনো কথাটা শুনে প্রায় গোটা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। ফার্স্ট বয় বলল, ও লাভলি! আরেক পড়ুয়ার মন্তব্য, হোয়াট আ জোক! আরেকজন বলে উঠল, কী কিউট! কেউ বলল, লে হালুয়া!
সাইলেন্স! সাইলেন্স! জোরে ধমকে সবাইকে চুপ করালেন ইংরেজি মিস। কিন্তু তখনই ঢং, ঢং করে ঘণ্টা বাজতেই ক্লাস শেষ। মিস বেরিয়ে গেলেন। তবে কিছুক্ষণ বাদেই টিচার্স রুমে ডাক পড়ল তোজোর। সেখান থেকে তাকে হেড মিস্ট্রেসের ঘরে নিয়ে গেলেন ইংরেজি মিস। সাদামাঠা চেহারার হেড মিস্ট্রেস কান্তা মুখার্জি।
ইংরেজি মিস করুণাদেবী তোজোকে দেখিয়ে তাঁকে বললেন, এ ছেলে হোমটাস্ক করে নিয়ে আসেনি। কারণ জানতে চাইলে কী বলেছে, জিজ্ঞাসা করুন। দুরু দুরু বুকে তোজো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। কান্তা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, হোমটাস্ক করোনি কেন, ক্লাসে ম্যাম জানতে চাইলে তুমি কী বলেছ? তোজো সত্যিই বলল। বলেছি, পড়ব কী, ঠাম্মি তো আমার বই-খাতা লুকিয়ে রাখে!
কান্তা দেবীকে বাইরে থেকে কঠোর, রুক্ষ মনে হলেও আসলে তিনি এর সম্পূর্ণ উল্টো। তোজোর কথাটা যে অজুহাত, ধরে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু তিনিও যে ওর কথায় মজা পেয়েছেন! হোমটাস্ক না করার নানা ধরনের অজুহাত তিনি দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে শুনেছেন। কিন্তু ছেলেটা যা বলেছে, নিঃসন্দেহে অভিনব। গুছিয়ে এমন মিথ্যে বলতেই বা পারে ক’জন! তিনি জানতে চাইলেন, তা তোমার ঠাম্মি বই-খাতা লুকিয়ে রেখে কী করেন?
তোজো চুপ।
ইংরেজি মিস বললেন, বানিয়ে বানিয়ে আর কত বলবে। এখন তাই রা নেই।
তোজো অবশ্য মুখ খোলে, 'ঠাম্মি আমায় গল্পের বই পড়তে বলে। 'মহাভারত' পড়ে শোনায়। ওটা নাকি সোনার খনি। ভোরে সূর্যপ্রণাম করে দিন শুরু করতে বলে। ছাদে গাছে জল দিতে বলে। বেশি মোবাইল দেখতে বারণ করে। আর রাতে শোওয়ার আগে অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে সারাদিন কী কী করেছি, মনে করতে বলে।'
'সত্যি বলছ?' কান্তা দেবীর প্রশ্নে ঘাড় নাড়ায় তোজো।
কান্তা দেবী ঠিক করলেন, একেবারে ছেড়ে দিলে হবে না, লঘু শাস্তি দেবেন ওকে। তিনি তোজোকে বললেন, 'ঠিক আছে কিংশুক, আজ স্কুল বন্ধ হলে তুমি বাড়ি যেতে পারবে না। আমার ঘরে বসে পড়ে হোমটাস্ক জমা দিয়ে তবে বাড়ি যাবে। তোমার বাবা-মাকে খবর পাঠাচ্ছি।'
তোজো পড়ল মহা ফ্যাসাদে। কেন যে বলতে গেল মিথ্যেটা!
স্কুল ছুটির ঘণ্টা পড়তেই তোজোকে বাই বাই বলে টিকা-টিপ্পনী কাটতে কাটতে বাড়ি চলে গেল বন্ধুরা। মুখে বিরক্তির ছাপ মেখে তোজো ব্যাগ কাঁধে কান্তা দেবীর ঘরে ঢুকল। কিশোর পড়ুয়ার মনের অবস্থাটা তিনি আঁচ করতে পেরে বললেন, 'মন খারাপ করছ?'
তোজো কিছু না বলে বই-খাতা খুলে বসল।
গোধূলি নামছে। ছাই ছাই বিকেল। আকাশে মেঘ জমছে। পরে বৃষ্টি নামতেও পারে।
উল্টো দিকে বসে থাকা কান্তা দেবী তোজোর পাংশু মুখ দেখে ভাবলেন, ছেলেটার কি খিদে পেয়েছে?
তিনি নিজের খাস কর্মচারী শিবুকে ভিতরে গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ আর বিস্কুটের ব্যবস্থা করতে বললেন। নিজের জন্য চা বানাতেও বললেন। এসব আয়োজন তাঁর অফিস ঘরে করাই থাকে। শিবু দুধের গ্লাস, দুটো বিস্কুট তোজোর সামনে রেখে ভিতরে গেল। কান্তা দেবী তোজোকে বললেন, 'দুধটা খেয়ে নাও।'
তবে সে ব্যাজার মুখ করে বলল, 'দুধ! আমি তো দুধ খাই না।'
'তবে কী খাও?' কান্তা দেবীর প্রশ্ন।

তোজোর উপস্থিতি বুদ্ধি : অরূপ কর


তোজো বলল, 'এসময় তো বাড়িতে হয় ম্যাগি বা ইপ্পি বা চাউমিন, এসব খাই।'
কিন্তু তোজোর ওজর টিঁকল না। কেননা চোখ লাল করে সামনে এসে বসল হেড মিস্ট্রেসের প্রিয় পোষ্য অ্যালসিসিয়ান প্রিন্স। একেবারে তোজোর চোখে চোখ রেখে যেন বলছে, ওটা খেয়ে নে, নয়তো.....। কান্তা দেবীকে কিছু বলতেই হোলো না। ঢকঢক করে দুধটুকু খেয়ে নিল তোজো।
তোজোর ভয়টা একটু একটু কাটছে। ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে তোজো দেখল, দেওয়াল জুড়ে ভারত আর গোটা বিশ্বের মানচিত্র। দেওয়াল আলো করে আছেন গান্ধীজি, নেতাজি, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিংয়ের ছবি। তোজো অবশ্য ম্যান্ডেলাদের চেনে না। কোনও ঠাকুর-দেবতার ছবি নেই।
হেড মিস তখন ভিতরে গেছেন কোনও দরকারে। তোজো লিখছে। আচমকা পাশের কোনও বাড়িতে 'জনগণমন অধিনায়ক' বেজে উঠল, হয়তো টিভিতে কোনও অনুষ্ঠানে। তোজোকে বিস্মিত করে উঠে দাঁড়াল প্রিন্স। তোজোর ভুলোও এসব আদব কায়দা জানে না।
এর মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠল। প্রিন্স উঠে গিয়ে হেড মিসকে ডেকে আনল। দরজা খুলতেই দেখা গেল, পাড়ার কিছু উঠতি মস্তান গোছের ছেলে। তাদের দাবি, সামনের রবিবার স্কুলের খেলার মাঠটা ছেড়ে দিতে হবে। আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ফাইনাল। তারা মাঠে বিশাল স্ক্রিন টানিয়ে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করবে। সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকবে।
তারা হেড মিসকে ঔদ্ধত্যের সুরে বলল, 'মাশিমা, আপনি ওপরে চলে গেলে তো ভূতে খাবে বাড়িটা। ও স্কুল-টুল তো থাকবে না। আমাদের বাড়িটা দিয়ে দিন। হাইরাইজ উঠবে। প্রচুর টাকা, ফ্ল্যাট পাবেন। শেষ জীবনটা ঠাকুরের নাম করে কাটাবেন। রোববার খেলা দেখতে আপনিও স্কুলের সবাইকে নিয়ে আশুন না। খানা পিনা, মৌজ-মস্তি হবে। আমরা খুশ, আপনিও খুশ!'
আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রিন্স ফুঁসছে। তোজোরও ছেলেগুলির আচরণ সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু হেড মিস ধৈর্য্য হারালেন না। ওদের মুখের ওপর বলে দিলেন, 'আগেও বলেছি, এ বাড়ি আমি দেব না তোমাদের। দিলে সরকারকে দেব। স্কুল থাকবে কি থাকবে না, তোমরা বলার কে হে!'
'ঠিক আছে, দেখে নেব! এত তেজ!' আঙুল উঁচিয়ে কান্তা দেবীকে শাসানি দিল ওদের একজন।
আর তখনই.....'আ, আ, গেলাম রে, বাঁচাও, বাঁচাও। জ্বলে গেল, জ্বলে গেল।' আর্তনাদ উঠল ওদের ভিড় থেকে। তার ওপর প্রিন্সও একজনের বুকের ওপর সামনের দুটো পা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ছেলেটা ঘামছে, ঠকঠক করে কাঁপছে। পা চুলকোচ্ছে বাকিরা। বাকিরা দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ল তোজোর পোষ্য ভুলোর সামনে। আসলে স্কুল থেকে খবর পেয়ে ততক্ষণে চলে এসেছে তোজোর বাবা-মা, ঠাম্মি। সঙ্গে ভুলোও।
আসল ঘটনা জানা গেল পরে। তোজোদের বন্ধুমহলের সঙ্গে ওঠাবসা আছে স্কুলের প্রহরী রামশরণের ছেলে ভুলুয়ার। তোজোরা তাকে টিফিনের ভাগ দেয়, ফুটবল, ক্রিকেট খেলায়ও সে থাকে। হেড মিসের সঙ্গে ছেলেগুলির ঝামেলার মধ্যেই তোজো হোয়াটসঅ্যাপে ভুলুয়াকে বলে, তোদের ঘরের সামনে থেকে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে কিছু পিঁপড়ে আর কাঠপিঁপড়ে ভরে এনে পিছন থেকে ভিড়ের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে যা! আর সেই কাঠপিঁপড়েদের কামড়েই কাত ওরা।
তোজোর উপস্থিতি বুদ্ধি : অরূপ কর


একটা ঝড় বয়ে গেল যেন। হেড মিস চুপ করে বসে আছেন। তোজোর বাবা-মা, ঠাম্মি এগিয়ে এসে নিজেদের পরিচয় দিল। কান্তা দেবী ঠাম্মিকে বললেন, আপনার নাতি খুব বুদ্ধিমান। রসবোধ ভাল। ঠাম্মি সম্পর্কে বানিয়ে বলা কথাগুলি তিনি বললেন। ঠাম্মি বলল, 'না, আমি তো ঘর পরিষ্কার করার সময় সেদিন বইখাতাগুলো নোংরা যাতে না হয়, সেজন্য আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম। লুকিয়ে রাখিনি তো। পরে বের করেও দিয়েছিলাম। আর ও এরকম বানিয়ে বলে দিল!'
তোজো বলল, 'তোমরা যে মোবাইল দেখতে বারণ করো। আজ মোবাইলটা সঙ্গে ছিল বলেই তো ভুলুয়াকে হোয়াটসঅ্যাপ করে পিঁপড়ে ভরে আনতে বলা সম্ভব হল। নইলে কী করতাম?'
হেড মিস বললেন, 'থাক, আর নিজের উপস্থিত বুদ্ধির কথা ঢাক পিটিয়ে বলতে হবে না। এরপর থেকে রোজ হোম টাস্ক করে আনা চাই। আর সামনের সোমবার তুমি ক্লাসে মহাভারত-এর গল্প বলবে। না পারলে কিন্তু.........'

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন