ছায়া-দেশে তোজো। অরূপ কর

হঠাৎ তোজো দেখল চারপাশে কতগুলো বেঁটে বেঁটে ছায়া। ক্রমশঃ তার দিকে এগিয়ে আসছে। তোজো অনুভব করল, তাকে ঘিরে ধরছে ওরা। সে আর নড়াচড়া করতে পারছে না। মাকড়শার জালের মতো কিছু তার ওপর চেপে বসছে। তোজো বলে উঠল, কারা তোমরা? ছাড়ো আমায়, ছাড়ো!

আজ তোজো সিরিজ দ্বিতীয় গল্প। প্রথমটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : তোজো-রোনাল্ডো দেখা

chya-deshe-tozo-by-arup-kar

স্কুল থেকে ফিরে বিকেলটা মুড অফ তোজোর। একে তো যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ কানের কাছে 'মোবাইলটা রাখ', 'পড়', 'পড়', শুনতে হয়। তার ওপর আজকে উইকলি টেস্টের রিপোর্ট দিয়েছে। অঙ্কে যথারীতি...। একঘর সহপাঠীর সামনে অঙ্ক মিস বলেছেন, তোমার মাথায় কি গোবর পোরা! হেসে উঠেছে কেউ কেউ। গা জ্বলানো হাসি। বাকি বিষয়গুলিতেও বলার মতো নম্বর নয়। 

ক্লাস টিচার বলেছেন, গার্জিয়ান কল হবে। আর তোজো জানে এ ধরনের মিটিংয়ে কী হয়। 'আপনার ছেলে ক্লাসে ডিসটার্ব করে এত! বাড়িতে কী শেখান আপনারা, নজর দেন না?' সবার সামনে এজাতীয় মন্তব্য। এক বাবা-মায়ের চরম অস্বস্তি। পড়ুয়ারও। কেন আলাদা করে ঘরে ডেকে কথাগুলি বলা যায় না? 

সেদিন বাড়ি ফিরে বাড়ির সবার বকুনি খাওয়ার ভবিষ্যত্ ছবিটা কল্পনা করতে করতে তোজো ছাদে উঠে এল। সন্ধ্যা নেমেছে। হেড স্যর ভাল মানুষ। তিনিই একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, যখন মন খারাপ হবে, সন্ধ্যা-রাতে ছাদে উঠে আকাশ দেখবে। চাঁদ, তারা, ভেসে যাওয়া মেঘের দল দেখবে। বুঝতে পারবে, বিরাট মহাবিশ্বে তুমি কত ক্ষুদ্র একজন। মন ভাল হয়ে যাবে। তোজো এমন পরিস্থিতিতে  সেটাই করে। 

স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। মায়াময় চাঁদ।  দূরে দূরে জ্বলজ্বলে তারারা। অনেক দূরে মেঘের চাদর সরিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা এরোপ্লেন। কোথায় যাবে? দেশেরই কোনও শহরে, নাকি বিদেশে? সেদেশটা কেমন? কারা থাকে সেখানে?  কতক্ষণ লাগবে? এখন সেখানে দিন না রাত? এসব ভাবতে ভাবতে একটা বিন্দুর মতো তোজোর দৃষ্টি থেকে আকাশের বুকে হারিয়ে গেল প্লেনটা। 

এতক্ষণ অনুভব করেনি, তোজোর আচমকা মনে হল, তার চারপাশে কারা যেন ঘোরাফেরা করছে। দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাদের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। চাপা স্বরে অনেকে কথা বললে যেমন শুনতে লাগে, সেরকম। কিন্তু কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না! 

হঠাৎ তোজো দেখল চারপাশে কতগুলো বেঁটে বেঁটে ছায়া। ক্রমশঃ তার দিকে এগিয়ে আসছে। তোজো অনুভব করল, তাকে ঘিরে ধরছে ওরা। সে আর নড়াচড়া করতে পারছে না। মাকড়শার জালের মতো কিছু তার ওপর চেপে বসছে। তোজো বলে উঠল, কারা তোমরা? ছাড়ো আমায়, ছাড়ো! 

একটা ছায়ামূর্তি নাকি সুরে বলে উঠল, ভাঁল কঁরে বাঁধ তো এঁটাকে। আঁজকে যঁখন পেঁয়েছি, তঁখন ছাঁড়াছাড়ি নেই। রাঁজামশাই তোঁ এঁর কঁথাই বঁলছিলেন! তারপর একটা ছায়া হাততালি দিতেই আকাশফুঁড়ে নেমে এল একটা ছোট বাক্সের মতো যান। লাল-নীল-সবুজ-গোলাপি আলো জ্বলছে। তোজোর বাধা দেওয়ার শক্তি নেই। সে 'মা-বাবা-ঠাম্মি বাঁচাও' বলে চিত্কার করতে গেল। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দই বেরল না। ছায়ার  দল  তাকে পাঁজাকোলা করে সেই বাক্স-যানে তুলে নিল। 

দরজা বন্ধ হতেই তা উড়তে শুরু করল। কাকপক্ষীও টের পেল না, অরবিন্দ নগরের এক কিশোরকে একদল অচেনা আগন্তুক কোথায় নিয়ে গেল। তারপর সেই যান চলছে তো চলছেই। অসীম মহাশূন্যের বুকে তারাদের সারি পেরিয়ে কোনও নাম না জানা দেশের ঠিকানায়। সেই যানের ভিতরে কত রকমের যন্ত্র, সুইচ, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ। চালককে দেখা যাচ্ছে না। তবে একটা মিষ্টি অচেনা গন্ধ। জানালার বাইরে তাকিয়ে তোজো অদ্ভূত সব দৃশ্য দেখতে পেল। অনেক নীচ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে প্লেন। আর মহাশূন্যের বুকে চলছে যুদ্ধ। বিদ্যুতের ঝলকানি দেওয়া তির ছুঁড়ছে কারা। তিরে তিরে ধাক্কা লেগে ফসস.....করে শব্দ। তীব্র আলোর ঝলকানি। ঘোড়ায় টানা রথ ছুটে চলেছে তীব্র গতিতে। 

এসব দেখতে দেখতে বাক্স-যান এবার সাঁ সাঁ করে নীচে নামতে লাগল। মনে হচ্ছে বাইরেটা অন্ধকার। তারপর  সেই যান নামল একটা দ্বীপে। চারদিকে অথৈ জল। মানে সমুদ্রে ঘেরা একটা দ্বীপে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। ছায়ারা তাকে জালমুক্ত করে বাইরে বের করল। 

আর অবাক কাণ্ড! তোজো দেখল, ছায়াগুলো বেঁটে, বেঁটে অদ্ভূত দর্শন জীবের চেহারা নিল। চারটে হাত, দুটো পা, মাথাটা পিছন দিকে ঘোরানো। চোখ থেকে নীল আলো ঠিকরে বেরচ্ছে। তাতেই চারদিক আলোচিত। 

ওরা সমস্বরে তাকে নাকি সুরে বলল, নীঁল দ্বীঁপে তোঁমায় স্বাঁগত, তোঁজোবাবু। চঁলো, এঁখন বিঁশ্রাম নেঁবে। কাঁল রাঁজ দঁরবারে নিঁয়ে যাঁব। তোজোর মোবাইলটা ছাদে ওঠার সময় প্যান্টের পকেটেই ছিল। ভাবল, সেটা থেকে বাড়িতে ফোন করবে। 

কিন্তু পকেটে হাত ঢোকাতেই অদ্ভূত দর্শন জীবরা বলল, লাঁভ নেঁই। এঁখানে ওঁটা কাঁজ কঁরবে নাঁ। আঁর ওঁর থেঁকেও হাঁজার গুঁণ শঁক্তিশালী যঁন্ত্র আঁমাদের কাঁছে আঁছে। দেঁখলে তুঁমি চঁমকে যাঁবে। তোঁমায় দেঁখাব কাঁল। 

তোজো বোঝার চেষ্টা করল, সে কোথায় এসেছে? এটা কি পৃথিবীর মধ্যেই না কোনও ভিনগ্রহ? মঙ্গলে জলের অস্তিত্ব মিলেছে, জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে কি মঙ্গলের জীবরাই হানা দিয়ে তাকে অপহরণ করে এনেছে? 

বাবা, মা, ঠাম্মির মুখগুলো ভেসে উঠল তোজোর চোখের সামনে। নিশ্চয়ই বাড়িতে এতক্ষণে কান্নার রোল শুরু হয়েছে। ঠাম্মির প্রাণ সে। বয়স হয়েছে। তোজোর জন্য দুশ্চিন্তায় তাঁর শরীর না খারাপ করে। 

ততক্ষণে তাকে অজানা জীবগুলো একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে এল। একটা মিষ্টি গন্ধ। হালকা আলো। গদি আঁটা রেশমি বিছানা। একটা বড় ক্যামেরার মতো দেখতে যন্ত্র থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে। আর একটা মন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে, গ্যাং, গ্যাং, গ্যাং.....ঢ্যাং, ঢ্যাং, ঢ্যাং। তোজোর তখন খিদেয় পেট চোঁ, চোঁ করছে। সে সবে 'খি' বলেছে, সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্যাডবেরি চকোলেট কোত্থেকে উড়ে এল তার হাতে।

পরদিন। কিন্তু এখানে কি দিন-রাত বলে কিছু নেই? অচেনা জীবগুলো তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। কিন্তু কিচ্ছুটি দেখা গেল না। তোজোর চোখে একটা কালো চশমা পরিয়ে দিল ওরা। 

অবাক কাণ্ড! চশমা পরতেই চারদিক আলোয় ঝলমল করে উঠল। তোজো স্পষ্ট দেখতে গেল দুর্গের মতো বড় বড় বাড়ি, খোলা মাঠ। পুকুর, বিল, গাছপালা সবই আছে। ও তাহলে এখানে খালি চোখে কিছু দেখা যায় না বুঝি! কিন্তু তোজোর বিস্ময় চরম সীমায় পৌঁছল যখন দেখল অজানা জীবগুলোর শরীরের ভিতরটা। অজস্র তার, স্ক্রু, নাটবল্টু, যন্ত্রে ভরা। হার্টের বদলে একটা ছোট্ট জেনারেটর বসানো। রক্তের রং হলুদ‍! 

একটা জীবকে কৌতূহলবশতঃ সে জিজ্ঞাসা  করে বসল, তোমরা কথা বলছ নাকি সুরে, চোখে আলো, ভিতরে তার, যন্ত্রপাতি। তোমরা কারা? সে বলল, তাঁহলে শোঁনো। বহুঁ, বহুঁ বঁছর আঁগে আঁমরা মাঁনুষের মঁতো ছিঁলাম। সুঁখে-শাঁন্তিতে দিঁন কাঁটছিল। এঁকদিন এঁক ভঁণ্ড সাঁধু এঁল। সেঁ বলল, তোঁমরা জাঁন, মাঁটির নীঁচে কত সোঁনাদানা, রঁত্ন আছে! সেঁগুলো খুঁড়ে বেঁর করলে রাঁতারাতি তোমরা কঁত ধন সম্পদের মাঁলিক হতে পাঁরো। আঁমরা লোঁভে পড়ে কোঁদাল নিয়ে মাঁটি খুঁড়তে শুরু করলাম। দিঁন যায়, বঁছর যায়। সোঁনাদানা আর মেঁলে না। সাঁধুবাবা কিন্তু অভয় দিয়ে চলেন, খুঁড়ে যাঁও, মিলবেই। নীচু হয়ে কোঁদাল চালাতে চালাতে আমরা বেঁকে গেঁলাম। এঁকদিন সম্পদের দেঁবী নেঁমে এসে বললেন, তোঁদের এত লোভ! এভাবে সময় নষ্ট করছিস। তোঁদের অঁভিশাপ দিলাম, মঁনুষ্য রূপ হারাবি। যঁন্ত্রে পরিণত  হবি।  ছাঁয়া হয়ে থাকবি। সেঁই থেকে আঁমাদের এই দশা। জন্ম-মৃত্যু নেই। আঁমাদের খিঁদে পায় না। কত সুস্বাদু খাবার আছে দুনিয়ায়, কিন্তু খাবার ইচ্ছেই যে নেই। এই দ্বীঁপে নির্বাসিত হলাম। 

তোজো জানতে চাইল, কিছু না খেয়ে বেঁচে আছ কী করে? জীবটা উত্তর দিল, তোঁমার দাঁদাভাই যেমন প্রায়ই এঁনার্জি ড্রিঙ্ক খায়, তেঁমনই একটা ড্রিঙ্ক এখানে মেলে। একটা গাঁছের আঁঠার রস। তোঁমরা মাঁনুষেরা খেতে পারবে না। 

কথা বলতে বলতে ওরা রাজদরবারে পৌঁছে গেল। রাজা কোথায়? তোজো রাজ সিংহাসনের  দিকে তাকাতেই দেখতে পেল বেঁটে মতো বেঁকে যাওয়া রাজাকে। আসনের সঙ্গে সেঁটে আছেন যেন। 

রাজার সামনে দাঁড়াতে তিনি বললেন, ছাঁয়া দেশে তোঁমায় স্বাগত তোঁজোবাবু। কেন তোঁমায় এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, জাঁনো কি। তোজো মাথা নাড়ল। এবার আরেক বিস্ময়। রাজা বললেন, লেঁ আও উঁনকো। 

বেঁটে-সৈন্য একটা ঘর থেকে যাদের এনে হাজির করল, তাদের দেখে তোজোর চোখ  কপালে উঠল প্রায়। এ তো অঙ্ক মিস, আর দীপ্র! ওরা এখানে কেন? 

রাজা মশাই বললেন, মঁন্ত্রী, ওঁদের তিঁনজনকেই বলো, কী দোঁষ করেছে ওরা। মন্ত্রী একটা বড় জাবদা খাতা বের  করে দেখে দেখে বললেন, মহারাজ, তোজো আর দীপ্রর অপরাধ, ক্লাস চলাকালে মোবাইল দেখছিল। পরীক্ষার সময় দীপ্রর কলমের কালি ফুরিয়ে এলে তোজো তাকে একটা কলম দেয়। অঙ্ক ম্যাডাম এজন্য কথা বলার অপরাধে ওদের ক্লাস থেকে বের করে নিল ডাউন করিয়ে রাখেন, তোমাদের দিয়ে কিস্যু হবে না, এমনও বলেন। 

রাজা মশাই বললেন, সেঁ কী! আঁমাদের আইনে ক্লাসের সময় মোঁবাইল দেখা তো বিরাট বড় অপরাধ। ওঁদের বাঁড়ি থেকে কী করে এটা অ্যালাউ করল? মানছি, লঁকডাউনে ক্লাস শুধু মোঁবাইলেই হোতো,  তাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মোবাইল দেখা। কিন্তু তা বলে স্কুলে কেন মোঁবাইল! না, না এটা হতে পারে না। ওদের মোঁবাইলগুলো নিষ্ক্রিয় করে দাও। 

সঙ্গে সঙ্গে তোজো আর দীপ্রর  মোবাইলে চিঁ চিঁ করে শব্দ হল। একটা সোনালি রে ঢুকে গেল তাতে। ব্যাস, আর কাজ করছে না। 

অঙ্ক মিসকে রাজামশাই বললেন, আঁপনার সঁন্তানসম ওরা। কী করে ওঁদের বলতে পারলেন, তোঁমাদের দ্বারা কিস্যু হবে না! কোথায় ওঁদের ভালবেসে বোঝাবেন, নিল ডাউন করিয়ে রাখলেন!

অঙ্ক ম্যাডাম চুপ। রাজামশাই বললেন, তোঁঅমরা ভাবো মোঁবাইলে গেম খেললেই হবে। তাহলে আমাদের জঁগত-যন্ত্র দেখলে কী বলবে। কই আমাদের যন্ত্রটা চালু কর তো! 

খ্যাঁচ করে একটা শব্দ। তোজোদের সামনে একটা বিরাট স্ক্রিন খুলতে শুরু করল। তাতে কী নেই! পুরো পৃথিবী লাইভ দেখা যায়। কোথায়, কী ঘটছে, সব তাজা দেখা যাচ্ছে। তোজো সাহস  করে বলল, বাড়ির জন্য মনটা কেমন করছে। বাবা-মা-ঠাম্মি কী করছে, একবার দেখান না। একটা বোতাম টিপে একজন বেঁটে-সৈন্য বলল, ৩/৩৯, অরবিন্দ নগর, কলকাতা, দাশগুপ্ত বাড়ি। তোজোর চোখ ছানাবড়া। দেখল, মা রান্না করছে। বাবা স্নানে ঢুকল। ঠাম্মি বসে খবরের কাগজ দেখছে। তোজো একটু অবাকই হল। সে বাড়িতে নেই, ওদের কারও চোখে মুখে তো উদ্বেগের ছাপ নেই একটুও। তাহলে কি ওরা ব্যাপারটা আগে থেকে জানত! 

একটু ধাতস্থ হয়ে সে বলল, আমাদের দেশে কী হচ্ছে, দেখান না! বেঁটে সৈন্যটা বোতাম টিপে ভারত বলতেই স্ক্রিন চলে গেল গুজরাতে। দেখা গেল, মোরবিতে সেতু ভেঙে নদীতে পড়ে মানুষের মৃত্যু মিছিল, হাহাকার, শোকের ছবি। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের খবর একটু আধটু রাখত তোজো। পুতিন নাকি মারা গিয়েছেন, এমনও উড়ো খবরও সে রাখে। তার আর্জি মেনে বেঁটে সৈন্য যে-ই বলল, ইউক্রেন, অমনি স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ধ্বংস হয়ে যাওয়া  ইউক্রেনের নানা শহরের ছবি। রুশ সৈন্যরা যাচ্ছে। রাস্তায় পড়ে আছে শবের সারি। মা কাঁদছে মৃত সন্তানের দেহ আঁকড়ে। রাজামশাইয়ের গলায়ও বেদনার সুর। 'মাঁনুষ যে কত বোঁকা, লোভী। এঁভাবে যুদ্ধ করে নিজেদেরই শেঁষ করছে! যাক গে! আঁমরা আর কী করতে পারি? মাঁনুষের শুভবুদ্ধি হোক, প্রার্থনা করি। 

ঠিঁক আছে, তোঁজোবাবু, দীঁপ্রবাবু আর ম্যাঁডাম! এবার তোঁমরা বাড়ি ফিরে যাও, বললেন রাজামশাই। 

বেঁটে সৈন্য বলল, চলো, তোমাদের গাড়ি রেডি। গাড়ি বলতে সেই বাক্স-যান। তবে তিনজনের জন্য আলাদা, আলাদা যান।

তোজো আগের মতোই বাক্স-যানে উঠল। সঙ্গে ছায়ারা। আবার আকাশে সেই যুদ্ধ দেখতে দেখতে চলল তোজো। 

একটা ছায়াকে সে বলল, আমরা এই যুদ্ধ মর্ত্য থেকে দেখতে পাই না কেন? 

ছায়া-মূর্তি বলল,  আমরা ভারত-চিন-রাশিয়া-আমেরিকা-ব্রিটেনের স্যাটেলাইটের নজরদারি এড়াতে এত উঁচু দিয়ে যাতায়াত করি। মহাশূন্যের যে স্তরে আমাদের চলাচল, সেখানে এসব যুদ্ধ হয়েই থাকে।  তোমরা রক্ত-মাংসের শরীরের চোখ দিয়ে দেখতে পাও না। এইসব কথা বলতে বলতে বাক্স-যান কখন যেন তোজোদের বাড়ির ছাদে নামল। রাত অনেক। পাড়াটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু জেগে ভুলো কুকুরটা। বাক্স-যান থেকে একটা গোলাপী রে ঠিকরে ওর গায়ে পড়তেই ভুলো ঘুমিয়ে পড়ল। তোজোকে নামিয়ে দিয়ে ছায়ারা হাত নেড়ে বাই বাই করে চলে  গেল। 

তোজোর তর সইল না। ঠাম্মি, মা-বাবা বলে চেঁচিয়ে লাফাতে লাফাতে সে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। দরজায় কড়া নাড়তে ঘুম জড়ানো চোখে বেরিয়ে এল ঠাম্মি। শব্দে জেগে উঠে এল বাবা-মা। কিন্তু আশ্চর্য, কেউ তো অবাক হল না! ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে তোজো বলল, আমি এসেছি। তোজোকে চমকে দিয়ে তিনজনই বলল, কোথায় আবার যাবি, তুই তো ঘরেই ছিলি? এই একটু আগেই তো খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লি! 

বলে কী!  তোজো ঠিক শুনছে তো? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তখনই তার নজরে পড়ল মেঝেতে একটা ভাঁজ করা কাগজ পড়ে। একটা চিঠি। তোজো পড়তে শুরু করল।

প্রিয় তোজোভাই,

আমি সেই ছায়া-রাজ্যের একজন। পাছে তোমার বাবা-মা, ঠাম্মি দুশ্চিন্তা করেন, সেজন্য তুমি ছিলে না যখন, তোমার রূপ ধরে আমিই এখানে ছিলাম। তোজো সেজে অভিনয় করেছি। আমরা প্রয়োজনে মানুষের রূপ নিতে পারি। তুমি ফিরেছ। আমি চললাম। তোমার হোমটাস্ক সব করে দিয়েছি। আর একটা কথা। তোমার মোবাইলটা চেক কোরো। ওটা আর  মোবাইল নেই, হাই ফ্রিকোয়েন্সি, শক্তিশালী দৃশ্যযন্ত্রে বদলে গেছে যাতে তুমি যখন মন চাইবে, পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, লাইভ দেখতে পাবে। দরকারে রেকর্ড করেও রাখতে পারো। শুধু জায়গার নামটা বলতে হবে মোবাইলকে। আর এতে গেম, হোয়াটসঅ্যাপ পাবে না। কেউ ইনস্টল করেও দিতে পারবে না। ভাল থেকো। বিদায়। 

তোজো স্তব্ধ হয়ে চিঠিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন