রাস্তার কুকুর ভুলোর সঙ্গে তোজোর দোস্তি স্কুলে ভর্তির দিনটি থেকেই। বাড়ির কাছেই ছিল তোজোর স্কুল। হাঁটতে হাঁটতে মা-র হাত ধরে তোজো স্কুলে যেত, পিছন পিছন ভুলো।
আজ তোজো সিরিজ চতুর্থ গল্প। প্রথমটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : তোজো-রোনাল্ডো দেখা এবং দ্বিতীয়টি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : ছায়া-দেশে তোজো তৃতীয়টি পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে : তোজো ও রহস্যে ঘেরা বাড়ির বুড়ো
তোজোর বাড়িতে সেদিন বিরাট হইচই। বাড়ি সাজানো হয়েছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ বেলুন, রকমারি ছবি-পোস্টারে। সকালেই তোজোর স্কুলের বন্ধু তিন্নি, রুবি, দীপ্র, শুভরা এসেছে। উপলক্ষ্য, তোজোদের অ্যানিম্যাল লাভার্স ক্লাবের অনুষ্ঠান। ওরা সবাই ক্লাবের সদস্য। একেকজনের বাড়িতে একদিন তার পোষ্যের জন্য কেক কাটা, খাওয়া দাওয়া হয়। আজ তোজোর বাড়ি। তোজোর দুই পোষ্য ভুলো আর কিটির জন্য গিফট নিয়ে এসেছে ওরা। শীতের পোশাক, রং-বেরংয়ের টুপি, কেক।
রাস্তার কুকুর ভুলোর সঙ্গে তোজোর দোস্তি স্কুলে ভর্তির দিনটি থেকেই। বাড়ির কাছেই ছিল তোজোর স্কুল। হাঁটতে হাঁটতে মা-র হাত ধরে তোজো স্কুলে যেত, পিছন পিছন ভুলো। স্কুলের দরজা পর্যন্ত। আবার ফেরার সময়ও আগে আগে ভুলো।
কিটির আগমন ঝড়-বৃষ্টির পর এক শুনশান রাতে। বন্ধ দরজার বাইরে মিঁয়াও, মিঁয়াও ডাক আর দুর্বল পায়ের থাবার বাড়ির শব্দ শুনে তোজোই তাকে ভিতরে এনেছিল। রুগণ, হাড় জিরজিরে শরীর। ঠাম্মিকে আবদার করে একটু দুধের ব্যবস্থা করেছিল তোজো। সেই থেকে কিটি দাশগুপ্ত বাড়ির অঘোষিত মেম্বার। কিটির কাজ সারাদিন এ বাড়ি, সে বাড়ি ঘুরে রাতে তোজোদের বাড়ির সিঁড়ির তলায় নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফেরা। তবে ভুলো, কিটি-দুজনেই নিজেদের অধিকারের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন। কেউই চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢোকে না। ভুলো তোজোদের গলিতেই থাকে।
তিন্নিরা ভুলো, কিটির গায়ে হাত বোলাচ্ছিল। তোজো বলছিল ভুলোর দাদা কেলোর কথা। একদিন তোজো দেখেছিল, পাড়ার মুদি দোকানে বড়রা রাজনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা করছে। আলোচনা গড়াল তর্ক, ঝগড়ায়। সেই ভিড়ে কেলোও সামিল। একবার এপক্ষের দিকে, আরেকবার ওপক্ষের দিকে তাকাচ্ছে। এক সময় ঝগড়া থামার লক্ষণ নেই দেখে বেরিয়ে সোজা হাঁটা দিল। সারাদিন এ গলি, ও গলি ঘুরে বেড়ায়। ভুলোর সঙ্গে ওঠাবসা নেই।
তোজোর ঠাম্মি সকালের রোদ মাখছিলেন চেয়ারে বসে। পুজো হয়ে গেছে। খবরের কাগজ পড়াও শেষ। তিনি রেডিওতে শ্যামাসঙ্গীত শুনছিলেন। 'দোষ কারও নয় গো মা'.... চোখ বুজে থাকা ভুলো, কিটিও সেই গানের মর্মবাণী উপলব্ধি করছিল বোধহয়। আচমকা দুজন চমকে উঠল 'ভূত' শব্দে।
তিন্নি বলছিল, ওদের পাশের বাড়িতে নাকি ভূতেদের আড্ডা। 'ভূত মানে ভূত, ভূতের মেলা যেন!' প্রতিবাদ করে তোজো-- 'দূর, ভূত বলে কিছু আছে নাকি!' তিন্নি বলে, 'কেন গুপী, বাঘার ছবিতে দেখিসনি, জঙ্গলে ভূতের রাজা ওদের বর দিল। লাল ভূত, সাদা ভূত, সোজা ভূত, বাঁকা ভূত, দেশি ভূত, সাহেব ভূতের নাচ!'
তোজো বলল, 'ওসব স্বপ্নেই সম্ভব।' তিন্নি বলল, 'ঠিক আছে, ভূত আছে কি নেই, সেটা সময় হলেই বুঝবি।' 'তুমিই ঠিক বলেছ', শেষে ঠাম্মির হস্তক্ষেপে ওদের ঝগড়া মিটল। ঘাড় নাড়ল ভুলো, কিটি। দিনভর ভুলো, কিটিদের কোলে তুলে সেলফি তোলা, খাওয়া দাওয়া, নাচ-গান চলল। ভুলো, কিটির গুণ হল, চেনা-অচেনা নেই, সবার আদর গ্রহণ করে।
সেই কিটি আচমকা একদিন নিখোঁজ হয়ে গেল। তোজো কান্নাকাটি করল খুব। আশপাশের বাড়ি ঢুঁ মারল। সঙ্গী ভুলো। কিন্তু কেউই নাকি কিটিকে দেখেনি। কী হতে পারে? কোনও দুর্ঘটনা, না কেউ জোর করে আটকে রেখেছে কিটিকে? তোজোর ঘুম নেই। ঠাম্মি, বাবা-মা অনেক করে বোঝানোর পর ধীরে ধীরে ব্যাপারটা মেনে নিল সে। তবে মনে থেকে গেল কিটির মুখটা। ওকে ভোলা গেল না।
এর বেশ কিছুদিন পর। তোজোর মা একদিন অফিস ফেরতা বাস থেকে নেমে গলির মুখেই প্রথম তিনতলা বাড়িটার গেটের বাইরে কিটিকে দেখে চমকে উঠলেন। তখন সন্ধ্যা। ও এখানে? 'কীরে কিটি, তুই এখানে কী করছিস, চল বাড়ি চল!' কিন্তু কাকে বললেন? কিটি তাকালই না তাঁর দিকে। মুখ ঘুরিয়ে ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর। তাহলে এ বাড়িতেই থাকে কিটি!
বাড়ি ফিরেই তিনি ঠাম্মিকে ব্যাপারটা জানালেন। তোজো ওপরে মেজো দাদুর ঘরে ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই মায়ের কথাগুলো শুনে ফেলল সে। তখনই তোজো যেতে চায় সেখানে। ঠাম্মি বোঝালেন। কালই তিনি তাকে ও বাড়িতে নিয়ে যাবেন। ও বাড়ির শৈলদি তো তাঁর অনেকদিনের চেনা। দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে কলোনিতে ঠাঁই হয়েছিল। তখনই আলাপ, যোগাযোগ। এককালে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল, এখন বয়সের কারণে বাইরে বেরনো হয় না বলে যোগাযোগ নেই।
পরদিন সকালেই তোজো টানাটানি করে ঠাম্মিকে বের করল। সঙ্গে ভুলো। 'শৈলদি, ও শৈলদি আছ?' বাড়িতে ঢুকে ডাকলেন ঠাম্মি। 'কে ডাকে এই সাতসকালে?' ভিতর থেকে বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন শৈলদেবী। 'আরে আভাদি যে, এতদিন পর, কী মনে করিয়া?' ঠাম্মি কিটির অন্তর্ধান থেকে শুরু করে ও বাড়িতে তাকে তোজোর মায়ের দেখতে পাওয়া, সবিস্তারে সব বললেন। শৈলদি বললেন, 'হ্যাঁ, ওপরের ভাড়াইট্টা গো ঘরে একটা বিড়াল আশে বটে। তবে ওইটারে তো ওরা ম্যাক্স বলিয়া ডাকে।'
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই ওপর থেকে একটা বিড়ালকে মুখ বাড়াতে দেখল তোজোরা। ওই তো কিটি! তোজোর চিনতে ভুল হয়নি। ঠাম্মিও দেখলেন। কিন্তু কিটি নির্বিকার। পাত্তাই দিল না, কার্নিসে মুখ গুঁজে বসে রইল। ভিতর থেকে এক পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, 'ম্যাক্স, ম্যাক্স, কাম হিয়ার, ডার্লিং।' ও মা, সুড়সুড় করে লাফ মেরে তিনতলায় ঢুকে গেল কিটি। ভুলো তোজোর মুখের দিকে তাকাল।
কিছুক্ষণ বাদে এক মেমসাহেব দেখা দিলেন তিনতলার বারান্দায়। চোখে কালো গগলস। বুকে জড়ানো কিটির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলছেন, 'ও ম্যাক্স, মাই ডার্লিং, ডোন্ট বি সো নটি!' দিব্যি তার বুকে মুখ গুঁজে আদর খাচ্ছে কিটি। তোজোর দৃশ্যটা সহ্য হল না। কান্না পেয়ে গেল। মেমসাহেবের পর বারান্দায় দেখা গেল সাহেবকেও। মাথায় টুপি। চোখ ঢাকা কালো গগলসে। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। ঠাম্মির মনে সন্দেহ হল। রোদ লাগছে না। কিন্তু দুজনে সক্কাল সক্কাল ঘরে সানগ্লাস পরে আছে! সাহেবের মাথায় কেন টুপি!
তোজোর হঠাত্ মনে পড়ল, প্যান্টের পকেটে ছায়াদের দেশ থেকে পাওয়া সেই কালো চশমাটা আছে যেটা দিয়ে কারও শরীরের ভিতরটা দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে তোজো সেটা চোখে পরে ওপরে তাকাতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল তার। এ কী দেখছে সে। সাহেব, মেমের শরীরটা আসলে খোলস। ভিতরটা কঙ্কাল! চোখের কোটরে গর্ত। সেখান থেকে আলো বেরচ্ছে। তোজোর চোখে চশমা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সাহেব, মেম-দুজনেই ভিতরে ঢুকে গেল।
তোজোর কাছে এবার পরিষ্কার হল, কিটি ভূতের পাল্লায় পড়েছে। ঠাম্মিকে সে বলল, বাড়ি চল। এখানে কিচ্ছু হবে না। 'শৈলদি আসি, আরেকদিন আসুম', বলে বেরিয়ে আসছিল ঠাম্মি। শৈলদি চাপা স্বরে বললেন, 'একটু শুনিয়া যান আভাদি। রাতের দিকে ওপর থিকা অনেকের গলা শুনিতে পাই। মনে হয়, কারা যেন ওদের ঘরে আসিয়া গল্পগুজব করে। কোনওদিন অবশ্য আমাগো অসুবিধা হয় না বলিয়া আপত্তি করি নাই। মাসের ভাড়াও ঠিকঠাক পাই। তবে আমারও কখনও কখনও রহস্যময় লাগে ওগো চলাফেরা।' 'ঠিক আছে, পরে আসুম' বলে বেরিয়ে এল ঠাম্মি। তোজো টানাটানি করছে হাত ধরে।
তোজো ফোন করে পুলিশ মামাকে সব বলল। তিনি তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন ভাগ্নের আবদার। ভূত ধরতে পুলিশি অভিযান! হয় নাকি?
তোজো আলোচনা করল লাদেনদার সঙ্গে। লাদেনদার পরামর্শ, তক্কে তক্কে থাকতে হবে। বাইরে দেখা গেলেই কিটিকে জালে জড়িয়ে আটকে ফেলার প্ল্যান দিল সে। লাদেনদা পাড়ার নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত বন্ধুদের থেকে একটা শক্তপোক্ত জাল ভাড়া করে আনল।
কিন্তু কিটির নাগাল মিলবে কীভাবে? লাদেনদা, তোজো, দীপ্র, শুভরা একদিন ভিখারি সেজে ঢুকল শৈলদেবীর বাড়িতে। ভুলো রইল দরজার বাইরে। 'একটু ভিক্ষে দাও মা, তিনদিন না খেয়ে আছি।' অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর শৈলদেবী একবার বাইরে এসে ওদের দেখে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদেই এক বাটি চাল, ডাল, আলু এনে দীপ্রর ঝোলায় ঢেলে দিলেন।
এর মধ্যেই ওদের নজরে এল, নীচের উঠোনের এক কোণে চোখ বুজে পড়ে আছে কিটি। সুযোগ হাতছাড়া করলে হবে না। লাদেনদা ঝোলায় থাকা জালটা ছুঁড়ে দিল কিটির গায়ে। আটকে পড়ে জাল ছিঁড়ে বেরনোর আপ্রাণ চেষ্টায় চিত্কার জুড়ে দিল কিটি। ভুলো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে কামড়ে টেনে নিয়ে এল জালটা। ওপরের সাহেব-মেম বেরিয়ে আসার আগেই সবাই মিলে দে দৌড়।
তোজোদের বাড়িতে শোরগোল উঠল। জালে আটকানো কিটি অবশ্য কাউকেই চিনতে পারছে না। তখনই ভুলো তোজোর নজর ঘোরাল সেই জালে। কিটির গলার নীচের কিছুটা অংশ ছোপ ছোপ কালো। সেখানে বসানো চালের দানার সমান একটা বোতাম! লাদেনটা চিমটে দিয়ে জোরে টেনে সেটা খুলে নিল। অবাক কাণ্ড। সঙ্গে সঙ্গে শান্ত বিড়ালটা। 'কিটি' বলে তোজো ডাকতেই সাড়া দিল এবার। ঠাম্মির কোলে উঠে বসল আগের মতো। ম্যাক্স থেকে ফের কিটি। তার মানে ওই বোতাম পরিয়ে কিটির স্মৃতি লুপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল! এতদিনে তোজোর শান্তি।
কিন্তু বোতামটা তাহলে কী? তোজো পুলিশ-মামাকে সব জানাল। মামার বন্ধু সায়েনটিস্ট। পশুপাখী, জানোয়ার নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁকে বোতামটা দেখাল তোজোরা। তিনি নাকি মেমারসন নামে লন্ডনের এমন এক বিজ্ঞানীর কথা শুনেছেন যিনি স্মৃতি লোপ করার ওষুধ আবিষ্কারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে কি কিটির স্মৃতি বিলোপের কোনও সম্পর্ক আছে?
তোজোরা এরপর দলবেঁধে ভুলোকে সঙ্গে নিয়ে শৈলদেবীর বাড়ি ঢুকল। তোজোর চোখে সেই কালো চশমা। তিনতলায় উঠে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সেই সাহেব আর মেম রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ভুলো প্রবল গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনের ওপর। ভুলোর সঙ্গে পেরে উঠল না ওরা। এক সময় ওপরের মানুষের খোলস খসে পড়ে ওদের কঙ্কালগুলো বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে কঙ্কালগুলো বাতাসে মিশে গেল। তোজোরা গোটা ঘরটা খুঁজে বাক্সভর্তি বোতাম উদ্ধার করল। মিলল বেশ কয়েকটা ডায়েরি, গবেষণার যন্ত্রপাতি, আলমারির জারের মধ্যে ওষুধ মাখানো বিড়ালছানা। দেওয়ালে লেখা, We will establish ghost empire in this world. Not mankind, world will be ruled by ghosts.
ডায়েরি ঘেঁটে ওরা জানতে পারল, একটু আগে হাওয়ায় মিশে যাওয়া সেই সাহেব আর মেম লন্ডনের সেই বিজ্ঞানীর অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিটির গলায় বসানো সেই বোতাম মানুষের ওপর কাজ করবে কিনা, সেই গবেষণা করছিল দুই ভূত মিলে।
এরপর পুলিশ এসে সেই ঘর সিল করে দিল। শৈলদেবী বাড়ি শুদ্ধ করার জন্য নারায়ণ পুজো দিলেন।
খবরটা সংবাদপত্রের পাতায় বেরল। ভুলোর সাহসিকতার খবর পড়ে লোকাল থানার ওসি এলেন তোজোদের বাড়ি। তাঁর ইচ্ছে ভুলো, কিটির সঙ্গে সেলফি তুলবেন। কিন্তু তাঁকে দেখেই ভুলো এমন চিত্কার জুড়ে দিল যে, তিনি পালাতে পারলে বাঁচেন।
কয়েকদিন পর তিন্নির সঙ্গে তোজোর দেখা। তিন্নি বলল, এখনও বলবি ভূত নেই?
তোজো বলল, না রে, এখন মানছি আছে। পাশ থেকে ঘাড় নাড়ল ভুলো, কিটি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন