হাংরি যুগ : বইটি পড়ার আগে যা জেনে রাখা প্রয়োজন

১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইস্তেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। আর যেসব কবিরা এই বিপ্লব ঘটালেন তাঁরা নিজেদের দাবি করতেন ‘হাংরি জেনারেশন’ হিসেবে।

হাংরি যুগ : বইটি পড়ার আগে যা জেনে রাখা প্রয়োজন

কোনও সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সে কারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজন ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।

–মলয় রায়চৌধুরী। (প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি)

প্রায় ছয় দশক পর সেই মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন ‘হাংরি যুগ’। প্রায় বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া উত্তাল একটি সময় আবার মনে করিয়ে দিলেন তিনি। ষাটের দশকের সেই হাংরি আন্দোলন নিয়ে তাঁর লেখা বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘এবং অধ‌্যায়’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে। বইটি পড়ার আগে এই আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা পাঠকের জেনে রাখা দরকার।   

ষাটের দশকে দুই পর্বে এক সাহিত‌্য আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল বাংলা।  প্রথম পর্বটি (১৯৬১-১৯৬৫) বাংলা সাহিত্যের প্রথম আন্দোলন। বাঁধ ভাঙার আওয়াজ তুলে ইস্তেহার প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি মুভমেন্ট বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন।  ‘আর্তি’ বা ‘কাতরতা’ শব্দগুলি মতাদশর্টিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা অবশেষে  ‘হাংরি’ শব্দটি গ্রহণ করেন। ঔপনিবেশিকোত্তর ভারতে ঔপনিবেশিক সাহিত্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বত্ত্বার বহিঃপ্রকাশই ছিল এই আন্দোলনের আপাত উদ্দেশ‌্য। ১৯৬৯ সালে আরেকবার এই আন্দোলন জিইয়ে উঠেছিল। অথচ, এই ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে বাংলার নব প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই  বাংলার সাহিত‌্য আন্দোলনের এই পর্বটির সম্পর্কে অবগত নয়। অথচ জানা উচিত ছিল। তারপর যার যার নিজস্ব রায় থাকতেই পারে।

হাংরি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত কবি সমীর রায়চৌধুরী ও তাঁর ছোট ভাই মলয় রায়চৌধুরী। মলয় রায়চৌধুরী ১৯৫৯-৬০ সালে ইতিহাসের দর্শন এবং মার্ক্সবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে দু’টি লেখার উপর কাজ করার সময় হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা প্রথম অনুভব করেন। ‘হাংরি’ শব্দটি তিনি পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসারের ‘In Swore Hungry Time’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলেন অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West’ বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী ‘প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি’ নামে একটি প্রবন্ধে শুরুতে উল্লেখ করা লাইনগুলি লিখেছিলেন। 

১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইস্তেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। আর যেসব কবিরা এই বিপ্লব ঘটালেন তাঁরা নিজেদের দাবি করতেন ‘হাংরি জেনারেশন’ হিসেবে। শুরুর দিকে সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের মতো কবি সাহিত্যিকরা ছিলেন এই আন্দোলনের দিকনির্দেশক হিসেবে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২১ বছরের তরুণ তুর্কি- মলয় রায়চৌধুরী নিজেকে পরিচয় দিলেন, ‘একজন কালচারাল বাস্টার্ড’ হিসেবে। আর তাঁর সঙ্গ দিয়ে ছিলেন কবির দাদা সমীর রায়চৌধুরী, ইস্তাহারের সম্পাদনায়। বিতরণে ছিলেন কবি দেবী রায় এবং নেতৃত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়।

১৯৬১ সালের নভেম্বরে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত হয় পাটনা থেকে। সেখানে বাংলা মুদ্রনের প্রেস না পাওয়ায় বুলেটিনটি প্রকাশিত হয় ইংরেজীতে। অল্প সময়ের মধ্যেই হিন্দী ও নেপালী ভাষাতেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে আন্দোলনে যুক্ত হন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফাল্গুনী রায়, আলো মিত্র, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল করঞ্জাই এবং করুণানিধান নামের দুজন চিত্রকরও ছিলেন এই আন্দোলনে। ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার সহ আরও অনেকে।

বাংলা সাহিত্যকে সেই প্রথম বুদ্ধিজীবীদের সভা থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল রাস্তায়, সাধারণ মানুষের মাঝে। হাংরি আন্দোলনের সাহিত্যিকরা তাঁদের আন্দোলনকে ‘কাউন্টার কালচারাল মুভমেন্ট’ এবং তাঁদের সাহিত্যকর্মকে ‘কাউন্টার ডিসকোর্স’ হিসাবে প্রচার করতেন। কবিতার ইস্তেহারে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন– ‘শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত’, ‘এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।’

অবশ‌্য, শুধু কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি এই কবিরা। সে সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বিধায়ক, সচিব, লেখক এবং সাংবাদিকরা হাংরিবাদীদের থেকে পেতেন বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। সেগুলি জন্তু-জানোয়ার, দানব, জোকার, মিকি মাউস, এমনকী দেবতাও। প্রতিটি মুখোশের সঙ্গে লেখা থাকতো, “দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন”। কবি-সাহিত্যিকদের পাঠানো হত বিয়ের কার্ড। তাতে লেখা থাকতো– “Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry”। মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে ছোটগল্পের নামে পৌছে যেত সাদা কাগজ, আর গ্রন্থ সমালোচনার জন্য পাঠানো হতো জুতোর বাক্স। 

হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয়। তবে দেশীয় পত্রিকাগুলো আন্দোলনকারীদের কখনও সমর্থন করেনি। বরং আন্দোলন হেয় হয়, এমনই শিরোনাম থাকতো খবরের। তযেমন–: ‘হা-ঘরে সম্প্রদায়’, ‘কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা’, ‘সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?’, ‘Erotic Lives & Loves of Hungry Generation’। কলকাতা, বেনারস আর নেপাল গিয়ে হিপীনীদের সঙ্গে তাঁদের অবাধ যৌনচর্চার বর্ণনা ছাপাল কিছু সংবাদপত্র। হাংরিয়ানদের বিরুদ্ধে বহু অপপ্রচারও শুরু হল। বলা হলো, তারা বিটনিকদের মতো মাদকাসক্ত। বাস্তবে, মূল আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনও যোগ ছিল না।

১৯৬৪ সালে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকল কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ৬-৭ জনকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না পাওাতে আবার ছেড়ে দিতে হয়েছে অনেককে। এরপর ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে এই আন্দোলন পুরোপুরি থেমে যায়। তারপরেও কয়েকজন আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা আর পেরে ওঠেননি। ১৯৬৬ সালের গোঁড়ার দিকে এই আন্দোলন ইতিহাস হয়ে যায়।

ঋষিকেশ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন