শহর, প্রেয়সী!
অনির্বাণ চৌধুরী
গতকাল সন্ধ্যায় এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়েছিলে –
আমার ডান হাত
তখনই শরীর থেকে আমি মুছে দিয়েছিলাম
এতদিন হাতে পায়ে জামায় সব জায়গায় লেগে ছিল যত জন্মদাগ!
যাবার সময় শুধু আলতো গলায় বলেছিলে – “গুড বাই”!
ভেবেছিলাম,
সেই মুহূর্তেই কেন না তবে বাড়ি ফিরে যাই?
এক ফোঁটা এপ্রিলের গরম হয়ে যদি
আমার সেই হাত ছুঁয়ে দিতে –
তবে মাইরি বলছি,
কে সি পালের ছাতা দিয়ে ঢেকে দিতে পাপারতাম
কালকের সন্ধ্যের সেই বিচ্ছিরি ঝকঝকে কালো আকাশ’কে,
শুক্ল পক্ষের ওই নিটোল ভরাট চাঁদ'কেও
শহরের সমস্ত ভীড়কে এক জায়গায় জড়ো করে ফেলতাম
ওই নতুন বাহারি ছাতার তলায়, একসাথে।
দু’জনেরই স্বপ্নে দেখা প্রতিদিনের বালির শহর
প্রতিদিন জন্মায়, আবার মরেও যায় ঘুম ভাঙতেই!
সেইখানে এক ফোঁটা ধুলো হয়ে যদি জন্মাতে,
তবে মাইরি বলছি –
কেটে যেত আমার সমস্ত ভয়, শুধরে নিতাম এতদিনের ভুলচুকগুলো!
চা এর সাথে তবে রক্ত মিশে যেত ফুসফুসে,
স্বস্তির নিঃশ্বাসে শুধু জমতো কিছু শব্দ, নেশা হত প্রতিটি চুমুকে,
এমনকি প্রতিটি রেশনের চালের কণায়!
হয়তো তুমিই সেই, যাকে –
এতদিন ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি কোন্নগর থেকে কিয়েভ অবধি,
কলকাতা ছাড়িয়ে কাঁকুরগাছির মাঝরাতের খালপাড়ে;
রেললাইন থেকে নিউজপেপার,
এমন কি স্বপ্নে দেখা সেই বালির শহর, সর্বত্র!
সমান তালে পাল্লা দিয়ে যাদের সাথে প্রতিদিন ছুটে চলেছি
এই অদ্ভুত রিলে রেসে
হয়তো তুমি তাদেরই কারুর প্রেমিকা,
নয়তো প্রেয়সী!
হয়তো আমার সেই সব বন্ধুদেরই কোন একজনের,
যাদের সাথে এতদিন ধরে গোগ্রাসে গিলেছিলাম সময়কে
স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলাম নিজের সকল বিপন্নতাকে;
বাবরের সাথে রাম, ভীমসেন যোশী থেকে আমলাশোল গ্রাম,
তর্কে বিতর্কে –
যাদের সাথে এতদিন ধরে একসাথে ঝরিয়েছিলাম
কপালের ঘাম,
হয়তো তাদেরই কোন একজনের প্রেমিকা তুমি!
যে হয়তো গ্রাস করেছে তোমার সব নিজস্বতাকে,
যেন সেই অন্তর্যামী
আমার পরম বন্ধু, নয়তো বন্ধুবেশী ঘোর শত্রু! নয়তো, আবার –
আয়নার সামনে দাঁড়ানো খোদ এই আস্ত ‘আমিটা’ই!
আমাদের জন্মদশা বিচারে শুক্রকে এখন দেখি ঢেকেছে শনি,
কলঙ্কে তাই মুখ লুকিয়েছে কারুর কারুর অপবিত্র যোনি,
পিছন ফিরে তবুও দেখেছি তোমার পিঠের ওপর সাদা সালোয়ারে
কালো চুলের বেণী!
কী ভয়ানক সভ্যতার সেই অভিগমন!
রাস্তা পেড়িয়ে এখন কেমন সুন্দর ভাবে শুয়ে আছে দ্যাখো ফুটপাথে;
তোমার-আমার দু’জনেরই বাড়ির সানশেডে
স্বপ্নে দু’জনের পাশেই, বালির শহর নয়
যেন ক্লান্ত কোন বইয়ের পাতার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে
সে শত শত বছর ধরে এমনই জেগে আছে!
নিজেকে তাই মাঝে মাঝে বড় ক্লান্ত লাগে, আবার মনে হয়
আমিই হয়তো দুনিয়ার সব থেকে বড় ভাগ্যবান!
সম্মুখে দেখেছি তোমাকে নিয়ে শহর জুড়ে এতদিন ধরে চলেছে
কত কত যুযুধান!
এ যেন তোমার কাছে আমার এতদিনের বকেয়া ঋণ,
নাকি আমিই সেই ভাগ্যহীন?
সজারুর গা থেকে যেদিন সমস্ত কাঁটা খুলে যাবে –
সেদিন যদি আড্ডা হয় ফাঁকা?
মদের গ্লাসে ঝুলবে কী তবে পবিত্র সাদা শাঁখা?
হয়তো সেদিনই আমাকে তুমি আবার ছুঁতে আসবে নিজে থেকে!
যাকে তুমি একদিন ভালবেসেছিলে, বা যে তোমাকে এতদিন ভালোবাসেনি
যাদের আমি একদিন ভোগ করেছিলাম নিশ্চিন্তে, শুনিয়েছিলাম সব আত্মগ্লানি
তবুও জানি,
তোমার সব পবিত্রতা এখন আমার নিজস্ব হাতের মুঠোয়,
এই যেন হয়ে ওঠেছে আমার নিজস্ব শক্তি; আমার নিজস্ব বিষ
পরজন্মে যেন তাই হতে পারি আরও বড় সক্রেটিস
তবুও জেনে রেখো, সক্রেটিস আর নতুন করে জন্মাবেন না,
প্লেটোর বদলে হয়তো অন্য কেউ এসে নতুন করে লিখে যাবেন তাঁর মৃত্যুগাথা
পরিবর্তন হয়তো একদিন সত্যিই আসবে!
রাম আর বাবর নিয়ে কেউই তখন আর মাথা ঘামাব না আড্ডায় বসে,
জিরো ভ্যালুর কারেন্সি হয়তো সেদিনই এসে যাবে সব মহাদেশে,
হয়তো সেদিনই তোমার সব স্বপ্ন, আমার সব শক্তি –
পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষয়ে, প্রতিটি চুর্ণতায়, প্রতিটি দুর্যোগে
খুঁজে নিতে পারবে অজানা কোন ঝর্ণার জল!
সলমন রুশদির খুবলে নেওয়া চোখ দিয়ে সেদিনই হয়তো,
স্বপ্ন দেখতে শিখবে পৃথিবীর সব মধ্যরাতের শিশুরা!
ফুটপাথের পাগল চড়বে বিলাসবহুল মার্সিডিজ,
আর থ্রি পিস স্যুটেড কর্পোরেট ফুটপাথ দিয়ে পাগলের মত দৌড়বে
সাইকেলের পরিত্যক্ত টায়ার আর লাঠি হাতে নিয়ে;
সেদিনই,
সেদিনই হয়তো পৃথিবীর সব ভাষার সব কবিরাই –
মঞ্চের বদলে খুঁজে নিতে পারবেন সেই নির্জন জানলার ঠিকানা,
যার পাশে বসে একান্ত সাহসে ভর করে (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
নিভৃতে কবিতা লেখা সম্ভব!
মঞ্চ তখন ভরে যাবে দর্শকে আর দর্শক আসন ভরে যাবে মঞ্চে
পৃথিবীর ঠিক মাঝামাঝি,
ডান আর বাম থেকে বিষুবরেখা ধরে ঠিক মধ্যিখানে
(হয়তো গভীর সমুদ্রের তলায় কোন অজানা সাবমেরিনে)
নতুন বিদেশনীতি নিয়ে বসবে তামাম ডেলিগেটসদের গোল টেবিল বৈঠক!
পতাকার বদলে সীমান্ত; পৃথিবীর প্রতিটি কাঁটাতার পেড়িয়ে
খুলে যাবে সেদিন সমস্ত দিগন্ত!
সেদিনই তবে আমি সত্যি করে খুলে ফেলব –
আমার গা থেকে এই ভণ্ড ভালোবাসার ছদ্মবেশ,
তখন পারবে কী তুমি এক ফোঁটা সত্যি হয়ে
ফিরে এসে,
ঠিক সেরকমই,
আগামীর কোন এক শুক্ল পক্ষের এপ্রিলের সন্ধ্যায় –
আমার ওই অপবিত্র ডান হাতটা আবার ছুঁয়ে দিতে?
কবি পরিচিতি
অনির্বাণ চৌধুরী
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক।
প্রথম প্রকাশ: আনন্দবাজার গ্রুপের 'আরও আনন্দ' অ্যাপের 'আরও সাহিত্য' কলামে কবিতা : 'বাকিটা ব্যক্তিগত'।
প্রকাশিত কবিতার বই : 'এখন হেমন্ত' (প্রকাশক 'এবং অধ্যায়', কলকাতা) ডিসেম্বর ২০২২।
কবিতা, প্রবন্ধ, গ্রন্থ-সমালোচনা নিয়মিত প্রকাশ।
আন্তর্জাতিক প্রকাশ: 'ঘুংঘুর' আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্যপত্রের অমর একুশে বইমেলা ২০২২ এবং নিউইয়র্ক বইমেলা ২০২২ সংখ্যায় গুচ্ছ কবিতা প্রকাশ। 'প্রথম আলো' উত্তর আমেরিকা সংস্করণে সম্প্রতি কবিতা প্রকাশ।
কবিতা পাক্ষিক, কবিতা বুলেটিন, কবিসম্মেলনের মতো মাসিক পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন