কান্নুর সদর থেকে প্রায় ৪৬ কিমি দূরে পারভান্থত্তা গ্রাম থেকে ভারতীয় সাহিত্য জগতে নিজেকে পরিচিত করার যাত্রাপথটি অবশ্য মোটেই সাদামাটা নয়।
![]() |
ছবি : লেখক অখিল কে-র ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া |
পাঠকের কাছে পরিচিত নাম নয়। সে কারণে প্রকাশকরা যাঁদের লেখার গুনমান থাকা সত্বেও ফিরিয়ে দেন, কেরলের কান্নুর জেলার বাসিন্দা ২৮ বছর বয়সী অখিল কে তাঁদের কাছে অনুপ্রেরণা। ২০২২-এর কেরালা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপক হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণা হতেই লেখক-পাঠক জগতে হইচই পড়ে গিয়েছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘নীলাচাদয়ন’-এর জন্য তিনি এই পুরস্কার পাচ্ছেন। তিনবছর আগে প্রকাশের পর এ পর্যন্ত বইটির আটটি সংস্করণ হয়েছে। গতমাসে যখন কেরালা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (গীতা হিরণ্য এনডাউমেন্ট পুরস্কার) প্রাপকদের নাম ঘোষণা করে, তাতে ‘ডার্ক হর্স’ হয়ে আবির্ভূত হন অখিল।
অখিলের নিজের জীবনই বোধহয় গল্প-উপন্যাসের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাকে পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছিল। তিনি রাতে একজন জেসিবি অপারেটর। ভোরবেলা বাড়ি-বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করেন। জেসিবি অপারেটার হিসাবে টানা আটঘণ্টার শিফট শেষ হওয়ার পর, পরের চারঘণ্টা লেখার মধ্যে ঢুবে যান অখিল। মাত্র কিছু সময় আগে তাঁর পেশীবহুল হাতগুলো যখন নদীর বালি তোলার জন্য ভারী লোডার অপারেট করে, সেই সময়ই তার মস্তিষ্কে গল্পের প্লট তৈরি হতে থাকে। গল্প সংকলন ‘নীলাচাদয়ন’ ছাড়াও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে দু’টি উপন্যাসও। এখন তৃতীয়টি লিখছেন।
কান্নুর সদর থেকে প্রায় ৪৬ কিমি দূরে পারভান্থত্তা গ্রাম থেকে ভারতীয় সাহিত্য জগতে নিজেকে পরিচিত করার যাত্রাপথটি অবশ্য মোটেই সাদামাটা নয়। অখিল বলছেন, “আমি যে স্বীকৃতি পেয়েছি তার জন্য আমি খুশি। এটা প্রত্যাশিত ছিল না। আমার দাদি, মা-ও দিনমজুর শ্রমিক। আমি ছোটবেলা থেকেই বাড়ি-বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করি। আমার পরিবারের অন্নসংস্থানের জন্য আমাকে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়েছে এবং হয়। এমনকী গভীর রাতে নদী থেকে বালি তুলতেও যেতে হয় আমাকে নিঃসঙ্গ রাতের ভয় দূর করতে তাঁর কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে গল্প বলার মধ্যে সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “আমি আমার দৈনন্দিন জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি। আমি তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা শুনি। রাতের ভয় এবং একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠার জন্য, আমি দিনের বেলায় শুনেছি বা দেখেছি এমন অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে গল্পগুলি কল্পনা করতে শুরু করি।
‘নীলাচাদয়ন’, কেরালার ইদুক্কি জেলায় পাওয়া গাঁজার স্ট্রেন থেকে নেওয়া শিরোনাম। বইয়ের গল্পগুলি উত্তর কেরালার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা তুলে ধরেছে। যেমন– সেই সব থেইয়াম শিল্পীদের দুঃখ-কষ্ট, যাঁরা হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও নাচ, মূকাভিনয় এবং সঙ্গীত সমন্বিত একটি প্রাচীন লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছেন। অখিল গর্বের সঙ্গে বলেন, তাঁর এই জয় তাঁর রাজ্যের জন্য একটি উপযুক্ত প্রাপ্য, যে রাজ্য দেশে সাক্ষরতার শীর্ষে।
অন্যান্য অনেক উদীয়মান লেখকের মতো, অখিলের ক্ষেত্রেও একজন প্রকাশক খুঁজে পাওয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি বলেন, “প্রায় চার বছর ধরে, আমি আমার লেখাগুলো প্রকাশ করার জন্য অসংখ্য প্রকাশক এবং পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কয়েকজন প্রকাশকের গল্পগুলি পছন্দ হয়েছে, কিন্তু তাঁরা বই প্রকাশ করতে রাজি হননি। জানিয়েছেন, আমি যেহেতু পরিচিত নাম নই, তাই বাজারে বই বিক্রি করা কঠিন হতে পারে।” এরপর অখিল ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখে। যেখানে কোনও এক প্রকাশনী সংস্থা ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বই প্রকাশের প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি বলেন, “আমার কাছে তখন জমানো ১০ হাজার টাকা ছিল। আমার মা, যিনি নিজেও একজন দিনমজুর আমাকে আরও ১০ হাজার টাকা জোগাড় করে দেন। আমরা টাকা নিয়ে সেই প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তবে বইটি শুধু অনলাইনে বিক্রির জন্যই প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি রাজ্যের কোনও বইয়ের দোকানে বিক্রি হয়নি এবং কোনও প্রভাব তৈরি করেনি। চিত্রনাট্যকার বিপিন চন্দ্রন ফেসবুকে এর প্রশংসা করার পর মোড় আসে। এরপর পাঠকরা বইয়ের দোকানে এটি চাইতে শুরু করে এবং প্রকাশনা শুরু হয়। এখন অষ্টম সংস্করণ ছাপা হচ্ছে।” পাশাপাশি তিনি বলেন, গীতা হিরণ্য এনডাউমেন্ট অ্যাওয়ার্ডও তাঁর মতো অন্যদের কাছেও একটি অনুপ্রেরণা হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন