আমাকে নতুন শিক্ষা নীতি পড়তে হচ্ছে। সত্যি, সত্যদ্রষ্টা এর লেখকেরা। একটা মহাকাব্য যেন। প্রায় পাঁচশ পাতায় বোনা একটা স্বপ্ন, সমুদ্রের মতো গভীর আর আকাশের মতো বিশাল।
![]() |
ছবি: প্রতিকী |
সত্যিই তো, সেই যে পাঁচিল টপকে স্কুলের পিছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে একটা রাবারের বল কিনে এনে এল-আকৃতির উঠোনে খেলতাম, সে কী আর আমার মেয়ে করতে পারত? তার স্কুলের বিরাট বড়ো ক্যাম্পাস; তার আনাচে কানাচে ঘাপটি মেরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নিরাপত্তা রক্ষী। কার সাধ্য ঢোকে কিংবা বের হয়। স্কুল এখন স্থাবর সম্পদ। তাকে রক্ষা করতে হবে না! অতএব, মাঠ থাকবে কিন্তু কেউ খেলবে না। পরিপাটি মাঠ শিল্পীর হাতে আঁকা সবুজ ক্যানভাসের উপর সেজে থাকবে এক তীর্থের মতো। কয়েকটা দিন সেখানে এটা-ওটা হবে। মালিক, অভিভাবক, অতিথিরা দেখবেন। ছবি উঠবে, বিজ্ঞাপন হবে, ব্যাস। মাঠের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। এবার সীমার ওপার থেকে ছাত্রছাত্রীরা তা দেখবে। ধরুন, সাঁতারের একটা আন্তর্জাতিক মানের পুল থাকবে স্কুলে। আধ ঘণ্টা পিরিয়ডের মিনিট কুড়ি চলে যাবে স্কুলের পোশাক পাল্টে স্কুল থেকেই কেনা দামী সাঁতারের পোশাকটা পড়তে আর খুলতে। পাঁচ মিনিট যাবে ওই পুল পর্যন্ত যেতে আর আসতে। এইবার যেটুকু সময় কারও কারও হাতে থাকল, তাতে, জলে পা ভিজিয়ে চলে আসা যাবে। সপ্তাহের মতো সাঁতারের ক্লাস শেষ। কিন্তু এই কি কম নাকি? প্রসপেক্টাসে যে ছবিটা দেওয়া গেল, তার কোনও মূল্য নেই?
গত দু’দিন আমার কী হয়েছে জানি না, প্রসেনজিতের কথায় আমাকে নতুন শিক্ষানীতি পড়তে হচ্ছে। সত্যি, সত্যদ্রষ্টা এর লেখকেরা। একটা মহাকাব্য যেন। প্রায় পাঁচশ পাতায় বোনা একটা স্বপ্ন, সমুদ্রের মতো গভীর আর আকাশের মতো বিশাল। দু'দিনে কী পুরোটা শেষ হয়? ওই তিন থেকে আট বছরের বাচ্চাদের জন্য করা সুপারিশগুলো পড়ছিলাম। বাচ্চাদের জন্য কত খেয়াল পুঞ্জিভূত হয়ে আছে, পংক্তিতে পংক্তিতে। তাদের যাতে কল্পনা শক্তির উন্মেষ হয়, যাতে তাদের পুষ্টি ও শক্তি বৃদ্ধি হয়, তার জন্য হরেক রকম সুপারিশ। প্রথম শ্রেণীতে পড়ার আগের তিন বছর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি হয়, একথা জানিয়ে ওই সময়ে গ্রে ম্যাটারের খাঁজে খাঁজে ছন্দ, বর্ণ, রূপ, গন্ধ গুঁজে দিতে হবে। প্লেটো তার বিখ্যাত ‘রিপাবলিক’ বইতেও এমনটাই জানিয়ে ছিল না! পাছে গ্রামের ছেলে পিছিয়ে পড়ে তার ব্যবস্থাও ভাবা আছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে লাগিয়ে দিতে বলা আছে অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রকে।
তা’ মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। সেকথাও মনে করানো আছে ওই পাঁচশ পাতার প্রথম একশ পাতায়। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। বরং ঢুকে পড়া যাক বিদ্যার এক নামী ভবনে। শিক্ষানীতি এরা শুধু জানে, তা-ই নয়, নিদারুণ ভাবে মানেও বটে। রঙের জন্য রঙ পেন্সিল আছে, গানের জন্য সিডি, পেন ড্রাইভ, কম্পিউটার আছে, ছড়া পড়ার বই আছে, শরীর গঠনের খেলনা আছে, পাজ্ল্ আছে। আর যা কিছুই আছে, দরকারের চেয়ে অনেক বেশি আছে। কিন্তু আরও কিছু আছে, যেগুলো শিক্ষানীতির লোকগুলো ভুলে গিয়েছিল নাকি বুঝতে পারছি না। জানালা বন্ধ আছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আছে, লেখার অনেক খাতা আছে। আর একটা জিনিস আছে – প্রচুর, প্রচুর হোম ওয়ার্ক আছে। ফলে আকাশ, তাল গাছ, পদ্মফুল –এইসবই আছে, কিন্তু কম্পিউটারের পর্দায়। কীরকম একটু গুলিয়ে গেল। টিচারদের আদর থাকতে পারে কিন্তু বকাঝকার ঝক্কি নেই। কী এক পক্সোর প্যাঁচে ছেলে মেয়েদের স্বাভাবিক বকুনি দেওয়া যায় না। তাই বলে রাগ কী ছাড়ে? অভিভাবকের সঙ্গে নিত্য মিটিং আছে। সেইখানে শ্রুতির ছেলের উপর রাগটা পুরো বেরিয়ে আসে শ্রুতির উপরে।
গত দু’দিন আমার কী হয়েছে জানি না, প্রসেনজিতের কথায় আমাকে নতুন শিক্ষানীতি পড়তে হচ্ছে। সত্যি, সত্যদ্রষ্টা এর লেখকেরা। একটা মহাকাব্য যেন। প্রায় পাঁচশ পাতায় বোনা একটা স্বপ্ন, সমুদ্রের মতো গভীর আর আকাশের মতো বিশাল। দু'দিনে কী পুরোটা শেষ হয়? ওই তিন থেকে আট বছরের বাচ্চাদের জন্য করা সুপারিশগুলো পড়ছিলাম। বাচ্চাদের জন্য কত খেয়াল পুঞ্জিভূত হয়ে আছে, পংক্তিতে পংক্তিতে। তাদের যাতে কল্পনা শক্তির উন্মেষ হয়, যাতে তাদের পুষ্টি ও শক্তি বৃদ্ধি হয়, তার জন্য হরেক রকম সুপারিশ। প্রথম শ্রেণীতে পড়ার আগের তিন বছর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি হয়, একথা জানিয়ে ওই সময়ে গ্রে ম্যাটারের খাঁজে খাঁজে ছন্দ, বর্ণ, রূপ, গন্ধ গুঁজে দিতে হবে। প্লেটো তার বিখ্যাত ‘রিপাবলিক’ বইতেও এমনটাই জানিয়ে ছিল না! পাছে গ্রামের ছেলে পিছিয়ে পড়ে তার ব্যবস্থাও ভাবা আছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে লাগিয়ে দিতে বলা আছে অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রকে।
তা’ মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। সেকথাও মনে করানো আছে ওই পাঁচশ পাতার প্রথম একশ পাতায়। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। বরং ঢুকে পড়া যাক বিদ্যার এক নামী ভবনে। শিক্ষানীতি এরা শুধু জানে, তা-ই নয়, নিদারুণ ভাবে মানেও বটে। রঙের জন্য রঙ পেন্সিল আছে, গানের জন্য সিডি, পেন ড্রাইভ, কম্পিউটার আছে, ছড়া পড়ার বই আছে, শরীর গঠনের খেলনা আছে, পাজ্ল্ আছে। আর যা কিছুই আছে, দরকারের চেয়ে অনেক বেশি আছে। কিন্তু আরও কিছু আছে, যেগুলো শিক্ষানীতির লোকগুলো ভুলে গিয়েছিল নাকি বুঝতে পারছি না। জানালা বন্ধ আছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আছে, লেখার অনেক খাতা আছে। আর একটা জিনিস আছে – প্রচুর, প্রচুর হোম ওয়ার্ক আছে। ফলে আকাশ, তাল গাছ, পদ্মফুল –এইসবই আছে, কিন্তু কম্পিউটারের পর্দায়। কীরকম একটু গুলিয়ে গেল। টিচারদের আদর থাকতে পারে কিন্তু বকাঝকার ঝক্কি নেই। কী এক পক্সোর প্যাঁচে ছেলে মেয়েদের স্বাভাবিক বকুনি দেওয়া যায় না। তাই বলে রাগ কী ছাড়ে? অভিভাবকের সঙ্গে নিত্য মিটিং আছে। সেইখানে শ্রুতির ছেলের উপর রাগটা পুরো বেরিয়ে আসে শ্রুতির উপরে।
“আপনার ছেলে যা বদমাইশ হয়ে গেছে না, একটু শাসন করবেন। সব সময় দেওয়ালে ওঠে। আবার দেওয়াল খুঁটে সেটা মুখে ঢোকায়।”
শ্রুতি মন দিয়ে শোনে। তিন বছরের ছেলেটাকে কী বোঝাবে বুঝতে পারার আগেই আবার স্কুলে ডাক।
–“কী করলি আবার?” শ্রুতি ভয় পেয়ে চাকরি ভুলে স্কুলে ছুটে যায়।
–“দেখুন দেওয়ালটার কী অবস্থা করেছে, ছবি এঁকে, রঙ করে দেওয়ালটা পুরো নষ্ট করে দিয়েছে।” রাগ আর কমে না শিক্ষিকার, –“জানেন, অতিমারীর শেষে সবে রঙ হয়েছে দেওয়ালে, এক বছরও হয়নি,” শিক্ষিকা হতাশ।
কে জানে, এই রঙ করার টাকা আবার শিক্ষিকার মাইনে থেকেই কেটে নেবে নাকি? ভাবছিল শ্রুতি। শেষে জিজ্ঞেস করল, “এখন আর দেওয়ালে উঠছে না তো?”
–“না। সেটা এখন আর নেই।” হাঁফ ছাড়ল শ্রুতি। ক্লাসরুমে যে কেন দেওয়াল থাকে! দার্শনিকের মতো ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরল শ্রুতি। ছবিগুলো মোবাইলে তুলতে ভোলেনি শ্রুতি। স্ট্যাটাসে দিয়েও দিয়েছিল। ছবিগুলো কিন্তু দিব্যি ছিল।
“আচ্ছা, ওই দেওয়ালে যদি বাচ্চাদের রঙ করতে দিত, রঙ করার মজুরিটা বেঁচে যেতনা?” মুনমুন জিজ্ঞেস করেছিল।
কার্তিকের ছেলে পড়ে একটা মিশনারি স্কুলে। ওর ছেলেকে নিয়ে ওর কোনও সমস্যা নেই। যাকে বলে ভালো, বাধ্য ছেলে। সেদিন অফিসে নিয়ে এসেছিল। ওর ঘরে ঢুকে দেখি, কার্তিক নেই। ওর ছেলে একমনে কার্টুন দেখছে, কম্পিউটারে। হন্তদন্ত হয়ে কার্তিকের প্রবেশ। –“দেখছেন, কোনও ঝামেলা নেই ওর। শুধু কার্টুন চললেই হল।”
কার্তিকের ছেলে পড়ে একটা মিশনারি স্কুলে। ওর ছেলেকে নিয়ে ওর কোনও সমস্যা নেই। যাকে বলে ভালো, বাধ্য ছেলে। সেদিন অফিসে নিয়ে এসেছিল। ওর ঘরে ঢুকে দেখি, কার্তিক নেই। ওর ছেলে একমনে কার্টুন দেখছে, কম্পিউটারে। হন্তদন্ত হয়ে কার্তিকের প্রবেশ। –“দেখছেন, কোনও ঝামেলা নেই ওর। শুধু কার্টুন চললেই হল।”
আমি চুপ। মানে শিক্ষানীতির বইতে এমন অবিরাম কার্টুন দেখার ফরমান আছে কিনা ভাবার চেষ্টা করছিলাম।
সেই ফাঁকে কার্তিক আরও জাহির করে, “ওকে খাওয়ানরও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে খাওয়াতে হবে। ও কার্টুন দেখবে আর আমি মুখের মধ্যে খাবার পুরে দেব।”
–“বাবু তুমি খেল কখন?” আমি শুধোই। ছেলে তো মগ্ন! তার উত্তর দেবার ফুরসত কোথায়?
বাবাই উত্তর দেয়, “কোথায় খেলবে?”
–“কেন, ওদের স্কুলে একটা বড় উঠোন আছে, সামনে একটা বড় পার্ক আছে,” আমি বলি।
“সে তো সপ্তাহে একদিন নিয়ে যায়। যা ধুলো মেখে আসে না, পুরো নাক বুজে যাচ্ছেতাই কাণ্ড! তার পর থেকে আমি যেতে মানা করে দিয়েছি।”
–“সে কি! তাহলে ও থাকে কোথায়?”
–“কেন কম্পিউটার রুমে! বেশ এসি’তে বসে থাকে!”
এবার আমার স্কুলের ছোটবেলা মনে পড়ে যায়। শহরের একটা বাংলা স্কুলে আমার পড়াশোনা। ক্লাসরুমে সব ফ্যান চলত না। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে, দৌড়ে সবাই নেমে আসতাম উঠোনটায়। এক ধার দিয়ে অবিন্যস্ত গাছের সারি। তেমন যত্ন কোথায়? আর এক ধারে একটা উঁচু রোয়াকের মতো জায়গায় একটা মস্ত বড় দেবদারু গাছ। ওইটুকু উঠোনে রাবারের বল পেটানোর জন্য কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি। ১৯৮৬-র শিক্ষানীতিও আসেনি তখনও। যেমন আসেনি কম্পিউটার, মোবাইল, এমনকি টিভি। আমরা কিন্তু বাংলা ভাষাতেই পড়তাম। যেমনটা দাবি করেছে আধুনিক শিক্ষানীতি। এতো রবি ঠাকুরও বলেছিলেন, “মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম।” আমাদের ইংরেজির হাতেখড়ি ক্লাস টু-তে। পরে অবশ্য আরও নীতিবাগীশেরা ইংরেজি পড়াটা পিছিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়ে তুমুল হট্টগোল হয়েছিল। রবি ঠাকুর অবশ্য ছোটবেলাতেই ম্যাকবেথ ইত্যাদি ইংরেজিতে পড়েছিলেন। ওঁর জন্য কোনও শিক্ষা নীতি লাগেনি। নতুন নীতিতে দেখলাম, ইংরেজি পরে পড়ারই সওয়াল করা হয়েছে খানিকটা। তখন যারা ইংরেজি পড়া পিছিয়েছিল, তারাই অবশ্য এখন শিক্ষানীতির এই অংশটা ঘোরতর স্খলন বলেই গলা ফাটাচ্ছে। এখন আবার সংস্কৃত পড়া ঐচ্ছিক করতে বলা হয়েছে। কালিদাস, ভাস, এদের লেখা একেবারে খাঁটি সংস্কৃতে না পড়লে জীবন বৃথা হয়ে যেতে পারে। আমরা সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীতে সংস্কৃত পড়েছিলাম। তারপরে সরকার সেটা তুলে দিল। সংস্কৃত বোধহয় বুর্জোয়াদের ভাষা ছিল! কিন্তু সংস্কৃত শ্লোক না পড়লে ভূত-ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে বলে যে ইঙ্গিত নতুন শিক্ষানীতি করেছে, তাতে লেখকদের দলের প্রবাসী বিশেষজ্ঞের সম্মতি আছে বলেই ধরে নিতে হবে।
টিনের বাক্সে কিছু খাতা, পেন্সিল থাকত ঠিকই। কিন্তু প্রাচুর্য ছিল না। রবি ঠাকুরের জীবন স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়। কম থাকলে আমের আঁটিটাও সাদা করে খেতে ইচ্ছে করে। জগতের রঙ, রূপ, গন্ধ, বর্ণ – এই সব, সমস্ত ইন্দ্রিয় ভরে পান করার পিপাসা থাকে। নতুন শিক্ষানীতি এই নিয়ে তো কিছু বলল না! স্কুল শেষের পরে মায়ের আসতে দেরি হলে, একটা সরু লম্বা ফ্ল্যাগ পোল ছিল। সেটা বেয়ে উঠে যেতাম। তাতে শরীরের মোটর স্কিলের কী উন্নতি হয়েছিল, তার মাপ অবশ্য করা হয়নি।
এই বার আমাদের গ্রামের একটা স্কুলে ঢুকে পড়ি। বলা যায় এই স্কুলটার সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয়। এর কাছাকাছি একটা স্কুল আছে যেখানে আমি ছোটবেলায় যেতাম মাঝেমধ্যে। আর যে স্কুলটায় যাব, সেটা আমি তৈরি হতে দেখেছি গত বারো বছর ধরে। এই স্কুলে শিশু শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ান হয়। স্কুলে ঘরের অভাব আছে। টিপকলের জল আছে, ঢাকা বাথরুম আছে। সামনে মাঠ আছে, মাঠের পাশে বাঁশবাগান আছে, বাঁশবাগানের পাশে বড় পুকুর আছে। পায়ে চলা মোরামের পথ আছে। খুব প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই, কিন্তু ছবি আঁকার, গানের, নাচের ক্লাস আছে। ছাত্র এবং শিক্ষকের (অভিভাবকের এবং কর্মকর্তাদের) সঙ্গতির অভাব আছে কিন্তু আনন্দের ঘাটতি নেই। স্বাধীনতা দিবসে সকলের উপস্থিতি আছে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে বেসুরো গান গাওয়া আছে, বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে লাফানো, ঝাঁপানো আছে। নতুন শিক্ষানীতি ওরা প্রায় কেউই জানে না, কিন্তু সাধারণ বোধ আর চিরাচরিত প্রজ্ঞায় ভর করে ওদের পথ চলা।
প্রশ্ন হল, এই যে গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর শ্রুতি, কার্তিকের ছেলেদের মতো শহরের ছেলে মেয়ে – এদের কারা জীবন যুদ্ধে লড়ার অস্ত্র বেশি পাবে? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলাম নয়া শিক্ষা নীতি। এই আর্থসামাজিক আলোচনা তেমন পেলাম কই? শুধু একজায়গায় লেখা আছে, বাজেটের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, প্রাচীনকালে রাজস্বের এক ষষ্ঠাংশ (মানে প্রায় ১৬ %) শিক্ষায় ব্যয় হত। যাইহোক, শিক্ষানীতির বইয়ের জন্য শিক্ষায় খরচ বাড়লে ভালোই হয়। কিন্তু তার ভাগাভাগি কেমন হবে, সেকথা লেখা নেই। একটা বইয়ে তো সব লেখা যায় না, লেখা ঠিকও নয়। আর একটা কথা বলা আছে, নতুন জমানায় নতুন শিক্ষক লাগবে। এমন কথা মাও জে দং বলেছিলেন। নতুন মানুষ তৈরি হতে হবে। তো কেমন করে এমন অসাধ্য সাধন হবে তা’ কিন্তু এই নীতিকথায় লেখা নেই। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে শিক্ষার এই ভয়ানক বিস্তারের জন্য। কোভিডের সময় অবশ্য একটা হাতেগরম অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে সামর্থ্যের বিচারে প্রযুক্তির এপারে আর ওপারে থাকা মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে সহস্র লক্ষ কোটির দেশ হলে তবে না এই বিভাজন মুছে যাবে! তার মধ্যে যদি বছরে দু’চারটে করে ঘূর্ণিঝড় আসে আর সব না হওয়া বাঁধগুলো ভেঙে দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। আগে বাঁচা, বাঁচলে তো শেখা!
ছোটবেলার কথা বলতে বসে এক প্যারাগ্রাফ উল্টোপাল্টা অশনি সংকেতের কথা! –তাহলে শ্রুতির ছেলে লেখার জন্য দেওয়াল পাবে না, কার্তিকের ছেলে আর কদিনের মধ্যে কম্পিউটারে দেওয়াল খুঁজে নেবে, আমার মেয়ে ছোটবেলায় নাচ শিখতে পারলনা– এই দুঃখ নিয়ে বড়ো হয়ে যাবে। এদের সবারই চোখে থাকবে হাইপাওয়ারের চশমা। আমার গ্রামের স্কুলের ছেলেরা ছোট বেলায় পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করবে, কিন্তু তাদের বেশির ভাগই খুব অল্প বয়সেই বড়ো হয়ে যাবে আর কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করবে। শিক্ষানীতির মতোই শিশুশ্রমের নীতিও ভীষণ দামি লোকেদের অনেক রোজগারের একটা বন্দোবস্ত বলে মনে হবে তখন। এই সমাজ কারও ছোটবেলা কেড়ে নেবে আর কারও ছোটবেলা ছোট করে দেবে। এই যে দেওয়ালটা ছোটবেলাটাকে অসময়ে আড়াল করে দিল, কোনও শিক্ষানীতি কি একা সেই দেওয়ালটা ভাঙতে পারবে?
এবার আমার স্কুলের ছোটবেলা মনে পড়ে যায়। শহরের একটা বাংলা স্কুলে আমার পড়াশোনা। ক্লাসরুমে সব ফ্যান চলত না। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে, দৌড়ে সবাই নেমে আসতাম উঠোনটায়। এক ধার দিয়ে অবিন্যস্ত গাছের সারি। তেমন যত্ন কোথায়? আর এক ধারে একটা উঁচু রোয়াকের মতো জায়গায় একটা মস্ত বড় দেবদারু গাছ। ওইটুকু উঠোনে রাবারের বল পেটানোর জন্য কাড়াকাড়ি থেকে মারামারি। ১৯৮৬-র শিক্ষানীতিও আসেনি তখনও। যেমন আসেনি কম্পিউটার, মোবাইল, এমনকি টিভি। আমরা কিন্তু বাংলা ভাষাতেই পড়তাম। যেমনটা দাবি করেছে আধুনিক শিক্ষানীতি। এতো রবি ঠাকুরও বলেছিলেন, “মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম।” আমাদের ইংরেজির হাতেখড়ি ক্লাস টু-তে। পরে অবশ্য আরও নীতিবাগীশেরা ইংরেজি পড়াটা পিছিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়ে তুমুল হট্টগোল হয়েছিল। রবি ঠাকুর অবশ্য ছোটবেলাতেই ম্যাকবেথ ইত্যাদি ইংরেজিতে পড়েছিলেন। ওঁর জন্য কোনও শিক্ষা নীতি লাগেনি। নতুন নীতিতে দেখলাম, ইংরেজি পরে পড়ারই সওয়াল করা হয়েছে খানিকটা। তখন যারা ইংরেজি পড়া পিছিয়েছিল, তারাই অবশ্য এখন শিক্ষানীতির এই অংশটা ঘোরতর স্খলন বলেই গলা ফাটাচ্ছে। এখন আবার সংস্কৃত পড়া ঐচ্ছিক করতে বলা হয়েছে। কালিদাস, ভাস, এদের লেখা একেবারে খাঁটি সংস্কৃতে না পড়লে জীবন বৃথা হয়ে যেতে পারে। আমরা সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীতে সংস্কৃত পড়েছিলাম। তারপরে সরকার সেটা তুলে দিল। সংস্কৃত বোধহয় বুর্জোয়াদের ভাষা ছিল! কিন্তু সংস্কৃত শ্লোক না পড়লে ভূত-ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে বলে যে ইঙ্গিত নতুন শিক্ষানীতি করেছে, তাতে লেখকদের দলের প্রবাসী বিশেষজ্ঞের সম্মতি আছে বলেই ধরে নিতে হবে।
টিনের বাক্সে কিছু খাতা, পেন্সিল থাকত ঠিকই। কিন্তু প্রাচুর্য ছিল না। রবি ঠাকুরের জীবন স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়। কম থাকলে আমের আঁটিটাও সাদা করে খেতে ইচ্ছে করে। জগতের রঙ, রূপ, গন্ধ, বর্ণ – এই সব, সমস্ত ইন্দ্রিয় ভরে পান করার পিপাসা থাকে। নতুন শিক্ষানীতি এই নিয়ে তো কিছু বলল না! স্কুল শেষের পরে মায়ের আসতে দেরি হলে, একটা সরু লম্বা ফ্ল্যাগ পোল ছিল। সেটা বেয়ে উঠে যেতাম। তাতে শরীরের মোটর স্কিলের কী উন্নতি হয়েছিল, তার মাপ অবশ্য করা হয়নি।
এই বার আমাদের গ্রামের একটা স্কুলে ঢুকে পড়ি। বলা যায় এই স্কুলটার সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয়। এর কাছাকাছি একটা স্কুল আছে যেখানে আমি ছোটবেলায় যেতাম মাঝেমধ্যে। আর যে স্কুলটায় যাব, সেটা আমি তৈরি হতে দেখেছি গত বারো বছর ধরে। এই স্কুলে শিশু শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ান হয়। স্কুলে ঘরের অভাব আছে। টিপকলের জল আছে, ঢাকা বাথরুম আছে। সামনে মাঠ আছে, মাঠের পাশে বাঁশবাগান আছে, বাঁশবাগানের পাশে বড় পুকুর আছে। পায়ে চলা মোরামের পথ আছে। খুব প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই, কিন্তু ছবি আঁকার, গানের, নাচের ক্লাস আছে। ছাত্র এবং শিক্ষকের (অভিভাবকের এবং কর্মকর্তাদের) সঙ্গতির অভাব আছে কিন্তু আনন্দের ঘাটতি নেই। স্বাধীনতা দিবসে সকলের উপস্থিতি আছে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে বেসুরো গান গাওয়া আছে, বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে লাফানো, ঝাঁপানো আছে। নতুন শিক্ষানীতি ওরা প্রায় কেউই জানে না, কিন্তু সাধারণ বোধ আর চিরাচরিত প্রজ্ঞায় ভর করে ওদের পথ চলা।
প্রশ্ন হল, এই যে গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর শ্রুতি, কার্তিকের ছেলেদের মতো শহরের ছেলে মেয়ে – এদের কারা জীবন যুদ্ধে লড়ার অস্ত্র বেশি পাবে? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলাম নয়া শিক্ষা নীতি। এই আর্থসামাজিক আলোচনা তেমন পেলাম কই? শুধু একজায়গায় লেখা আছে, বাজেটের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, প্রাচীনকালে রাজস্বের এক ষষ্ঠাংশ (মানে প্রায় ১৬ %) শিক্ষায় ব্যয় হত। যাইহোক, শিক্ষানীতির বইয়ের জন্য শিক্ষায় খরচ বাড়লে ভালোই হয়। কিন্তু তার ভাগাভাগি কেমন হবে, সেকথা লেখা নেই। একটা বইয়ে তো সব লেখা যায় না, লেখা ঠিকও নয়। আর একটা কথা বলা আছে, নতুন জমানায় নতুন শিক্ষক লাগবে। এমন কথা মাও জে দং বলেছিলেন। নতুন মানুষ তৈরি হতে হবে। তো কেমন করে এমন অসাধ্য সাধন হবে তা’ কিন্তু এই নীতিকথায় লেখা নেই। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে শিক্ষার এই ভয়ানক বিস্তারের জন্য। কোভিডের সময় অবশ্য একটা হাতেগরম অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে সামর্থ্যের বিচারে প্রযুক্তির এপারে আর ওপারে থাকা মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে সহস্র লক্ষ কোটির দেশ হলে তবে না এই বিভাজন মুছে যাবে! তার মধ্যে যদি বছরে দু’চারটে করে ঘূর্ণিঝড় আসে আর সব না হওয়া বাঁধগুলো ভেঙে দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। আগে বাঁচা, বাঁচলে তো শেখা!
ছোটবেলার কথা বলতে বসে এক প্যারাগ্রাফ উল্টোপাল্টা অশনি সংকেতের কথা! –তাহলে শ্রুতির ছেলে লেখার জন্য দেওয়াল পাবে না, কার্তিকের ছেলে আর কদিনের মধ্যে কম্পিউটারে দেওয়াল খুঁজে নেবে, আমার মেয়ে ছোটবেলায় নাচ শিখতে পারলনা– এই দুঃখ নিয়ে বড়ো হয়ে যাবে। এদের সবারই চোখে থাকবে হাইপাওয়ারের চশমা। আমার গ্রামের স্কুলের ছেলেরা ছোট বেলায় পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করবে, কিন্তু তাদের বেশির ভাগই খুব অল্প বয়সেই বড়ো হয়ে যাবে আর কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করবে। শিক্ষানীতির মতোই শিশুশ্রমের নীতিও ভীষণ দামি লোকেদের অনেক রোজগারের একটা বন্দোবস্ত বলে মনে হবে তখন। এই সমাজ কারও ছোটবেলা কেড়ে নেবে আর কারও ছোটবেলা ছোট করে দেবে। এই যে দেওয়ালটা ছোটবেলাটাকে অসময়ে আড়াল করে দিল, কোনও শিক্ষানীতি কি একা সেই দেওয়ালটা ভাঙতে পারবে?
লেখক প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি
(মতামত নিজস্ব)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন