দেবজিৎ ঘোষ-এর গল্প : আবার বছর কুড়ি পর

অলিগলির হ্যালোজেন বাতির আলোআঁধারিতে সঙ্গীতা হয়ে উঠেছিলেন আরও লাস্যময়ী, আরও রহস্যময়ী। যে ক'জন পুরুষ আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁদের কারওরই নজর এড়াননি সঙ্গীতা। 

দেবজিৎ ঘোষ-এর গল্প : আবার বছর কুড়ি পর
AI Generated Art

সাঙ্গু ভ্যালি রেস্তোরাঁর সামনের ফুটপাথে রেলিঙে হেলান দিয়ে দেবপ্রতিম অপেক্ষা করছেন সঙ্গীতার জন্য। ঘড়িতে সন্ধ্যে ছ’টা, সময় কাটাতে আপাতত তাঁর ভরসা একটা সিল্ককাট। অনেকদিন পর এদিকটাতে আসছেন উনি। ইউনিভার্সিটি লাইফে এসেছেন অনেকবার। কর্মজীবনটার অনেকটা সময় দিল্লি,মুম্বই,ব্যাঙ্গালোর করেই কেটে গেল। শরীরে আর পোষাচ্ছিল না,তাই কলকাতার একটা কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি নিয়ে চলে এসেছেন এখানে।
হঠাৎ করেই পিঠে একটা স্পর্শ পেয়ে ফিরে দেখেন সঙ্গীতা দাঁড়িয়ে।
– “সরি সরি,জ্যাম ছিল। আসতে তাই লেট হয়ে গেল। তোর দেরি হয়ে যায়নি তো ?”
“আরে না না, আমিও এই এলাম।”
দেবপ্রতিম ও সঙ্গীতা, এই দুই মধ্য চল্লিশের মানুষ সাঙ্গু ভ্যালির এক টেবিলে মুখোমুখি চেয়ারে বসে।ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তাঁরা আসতেন এখানে।তারপর মাঝখান দিয়ে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। সে দিনের দুই যুগলের চুলেই ধরেছে সাদা রঙের অল্প অল্প ছাপ। দু’জনের জগৎ আজ আলাদা।
–“দু’টো মটন আফগানি।” ওয়েটারকে অর্ডার দিয়ে দিলেন দেবপ্রতিম। তাঁর মধ্যে আজ আবার সঞ্চারিত হয়েছে কলেজ জীবনের বোহেমিয়ান স্বত্বা।
–“তারপর কেমন আছিস বল। বৌ-ছেলে নিয়ে হেব্বি সংসার করছিস বল ?”
সঙ্গীতার এই প্রশ্নে একটা দেঁতো হাসি হেসে দেবপ্রতিম বললেন, “এই চলে যাচ্ছে। তোর তো মেয়ে আছে, কীসে পড়ে ও ?”
"এইতো টেন হল” ,বলে মোবাইল থেকে মেয়ের অনেকগুলি ছবি দেখালেন সঙ্গীতা।
“বাহ্ ! খুব মিষ্টি। তোর মুখ বসানো একেবারে।”
“তোর ছেলের এখন কোন ক্লাস যেন ?”
“ফাইভ”
“ছেলেকে কী বানানোর ইচ্ছে ? ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার ?”
“ধুর ! ওসব ওর দ্বারা হবেনা। অঙ্ক একদম পারেনা।”
একটু হেসে সঙ্গীতা বললেন, “একদম জোর করবি না ওকে।ওর যেটা ভালো লাগবে সেটাই করতে দিস ওকে।”
খাবার চলে এসেছিল,তাই কথা থামাতে হল ওদের। দোকানটা সত্তর বছরের বেশি পুরান হলেও খাবারের কোয়ালিটিটা ধরে রাখতে পেরেছে এরা। ঝাল ঝাল আর গরমাগরম মটন আফগানি এদের সিগনেচার ডিস। খেতে খেতে সঙ্গীতাকে লক্ষ্য করছিলেন দেবপ্রতিম। চেহারায় বয়সের ছাপ এলেও এখনও যৌবনের সেই উজ্জ্বলতার ছাপ রয়ে গিয়েছে যথেষ্ট। সঙ্গীতা চ্যাটার্জী, দেবপ্রতিমের ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রেমিকা আজ সিঙ্গল মাদার,পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। সেইদিন হঠাৎ ফেসবুকে ফ্রেণ্ড রিক্যুয়েস্ট এলো সঙ্গীতার থেকে। এতগুলো বছর পরেও দেখে ঠিক চিনতে পারলেন দেবপ্রতিম। ঘোর সংসারী মধ্যবয়স্ক দেবপ্রতিমের স্নায়ুতে খেলে গিয়েছিল বিদ্যুৎ,ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছিল যৌবন। কাঁপা কাঁপা হাতে সঙ্গীতার রিক্যুয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছিলেন দেবপ্রতিম। একটু পরেই ওপার থেকে টেক্সট ম্যাসেজ–“চিনতে পারছিস ?”
চিনতে না পারার কোনও কারণই ছিল না দেবপ্রতিম ঘোষের। ইউনিভার্সিটি জীবনের অজস্র স্মৃতি রয়েছে সঙ্গীতার সঙ্গে। সঙ্গীতার বাবা ছিলেন ডাক্তার, তিনি তাঁর একমাত্র কন্যার জন্য পারফেক্ট গ্রুম মনে করেছিলেন তাঁরই ছাত্র ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জি-কে। দেবপ্রতিম তখনও চাকরি খুঁজছেন। তাছাড়া দেবপ্রতিম কায়স্থ আর সঙ্গীতা ব্রাহ্মণ। রক্ষণশীল সমাজ এই সম্পর্কের বৈবাহিক পরিণতি মেনে নিত না। দেবপ্রতিম কখনও ভাবেননি আবার দেখা হবে সঙ্গীতার সঙ্গে এই জীবনে।পৃথিবীটাতো গোল,তাই হয়তো আবার দেখা হয়ে গেল।
খাওয়াদাওয়া সেরে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সামনের চায়ের দোকান থেকে দুটো চা আর একটা সিল্ককাট দিতে বললেন দেবপ্রতিম।
“আমাকে একটা সিল্ককাট ব্লু দিও,”–সঙ্গীতার এই কথায় দেবপ্রতিম হতচকিত হয়ে গেলেন।
–“সে কী ! কবে থেকে এইসব ?”
–“অনেকদিন হয়ে গেল। কেন মেয়েদের স্মোক করতে নেই বুঝি ?”,আধুনিকা সঙ্গীতার দৃপ্ত জবাব। চা শেষ করে স্মোক করতে করতে পুরোন কলকাতার অলিগলি দিয়ে একটু পায়চারি করছিলেন দুই প্রাক্তন যুগল। অলিগলির হ্যালোজেন বাতির আলোআঁধারিতে সঙ্গীতা হয়ে উঠেছিলেন আরও লাস্যময়ী, আরও রহস্যময়ী। যে ক'জন পুরুষ আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁদের কারওরই নজর এড়াননি সঙ্গীতা। নজর এড়াবার কথাও নয়– সদ্য প্রৌঢ়ত্বে পা রাখা নারী যেন ফুলেফেঁপে ওঠা কোনও এক নদী– সেই নদীতে ডুব দিতে চায় সকলে। সঙ্গীতাকে দেখেও মনে হচ্ছিল না তিনি খুব একটা অস্বস্তি বোধ করছেন, বরং তিনি যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলেন, তামাম পুরুষদুনিয়াকে নিজের দেহসৌষ্ঠবের মায়ায় বশ করে রাখার অহংকার। এ এক নতুন সঙ্গীতা, যেন সমস্ত বাধা কাটিয়ে নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো মুক্ত এক পাখি।প্রশ্নটা খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই করে ফেললেন দেবপ্রতিম,–“তোর ডিভোর্স হল কেন ?”
–“সে অনেক ব্যাপার। ইন শর্ট আমি ওর কাছে পুরোন হয়ে গিয়েছিলাম।”
–“বুঝলাম না।”
–“মানে ওর জীবনে নতুন একজন কেউ এসে গিয়েছিল।সেও ডাক্তার। কোনও এক কনফারেন্সে আলাপ হয়েছিল ওদের।”
–“তুই পরে আবার বিয়ে করলে না কেন ?”
–বিশ্বাস করিনা কাউকে। আমি আর আমার মেয়ে এই দু’জনে একসঙ্গে ভাল আছি।”
–“অনেক রাত হল,চল বাড়ি ফেরা যাক।তোকে ড্রপ করে দিয়ে বাড়ি ফিরব।”
–“তোর বাড়ি ফিরতে দেরি হবেনা তো ? বৌ সন্দেহ করবে না ?” শেষের কথাটা একটু দুষ্টুমি ভরা গলায় বলে হাহা করে হেসে উঠলেন মধ্য বয়সের তরুণী সঙ্গীতা।
সঙ্গীতার বাড়ি সেই টালিগঞ্জের দিকে। দেবপ্রতিমের গাড়ি কলকাতার অফিসফেরত জ্যামে বারবার থমকাচ্ছে। পারমিতা,দেবপ্রতিমের স্ত্রী মাঝে একবার ফোন করেছিলেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আজ ফিরতে দেরি হবে।দেরি হোক আজ, মিন্টো পার্কের সিগন্যালটা লাল হয়েই থাক। মধ্য চল্লিশে এসে প্রাণে লাগুক মুক্ত হাওয়া। সেই একঘেয়ে সংসার জীবন,চাকরি,ছেলের পড়াশুনা আর ভালো লাগে না। সংসার জীবনের যাঁতাকলে পড়ে দেবপ্রতিম যেন আর মানুষ নেই, একটা যন্ত্র হয়ে গিয়েছেন। মাঝেমধ্যে দম যেন বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। এ সমাজে পুরুষরা বড় অবহেলিত, নারীদের অভিমান ভাঙার জন্য অনেকে আছেন, পুরুষদের না-বলা কথা ক'জনই বা শুনতে চান? কোনও কিছুতেই তাঁর সঙ্গে পারমিতার যেন মিল নেই, মায়ার টান না থাকলে অ্যাডজাস্ট করে ক'দিনই বা চলা যায়? অনেকবার ভেবেছিলেন মিউচুয়াল ডিভোর্স দেবেন পারমিতা-কে, কিন্তু পিছিয়ে এসেছেন ছেলেটার মুখ চেয়ে। শারীরিক সম্পর্ক যেটুকু টিকে আছে সেটার মধ্যে দাবানলের আগুন নেই, সবটাই কেমন যেন যন্ত্রের মতো। একটা মৃত সম্পর্ককে এভাবে দীর্ঘায়িত করার প্রয়াস আর কতদিন ?
দেবপ্রতিম বাঁচতে চান। সাহস করে সঙ্গীতার হাতটা রাখলেন গিয়ারে রাখা নিজের হাতের ওপর।সঙ্গীতা বাধা দিলেন না। শহরের ভিড়ে আজ না হয় আবার শুরু থেকে শুরু হোক পুরোন হয়ে যাওয়া কোন এক ভালবাসার গল্প , ক্ষতি কী !


লেখক পরিচিতি :
দেবজিৎ ঘোষ । জন্ম হুগলির উত্তরপাড়ায়। বেড়ে ওঠা উত্তরপাড়া ও কলকাতাতে। উত্তরপাড়া রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে আড়াই বছর পড়াশুনা করার পর বদলি নিয়ে ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে । সেখান থেকেই সসম্মানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। এরপর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীকালে ডেটা সায়েন্স ও মেশিন লার্নিং নিয়েও চর্চা করেছেন। কর্মসূত্রে কলকাতার পূর্ব পুটিয়ারী-তে থাকেন। পেশাগত ভাবে প্রযুক্তিবিদ হলেও নেশা গত ভাবে লেখক। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন