দেশভাগের পর, পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দিশাহারা অবস্থার মধ্যে পড়েন। তাঁরা সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগের সম্মুখীন হন। মূলত, কৃষিনির্ভর জীবিকায় আটকে থাকা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অনুশীলন গতি হারায়।
‘বাঙালি এবং মুসলিম’– জটিল সম্পর্ক এমন একটি বিষয় যা প্রায়ই আলোচিত এবং সদা বিতর্কিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সহাবস্থান সত্ত্বেও ভুল ধারণা, সীমিত আদান-প্রদান ও অগভীর পারস্পরিক পরিচিতির অভাবই কি এর জন্য দায়ী? প্রশ্নটি যাঁরা করেন, উত্তরও তাঁদের আলবৎ জানা।
বস্তুত, ছোটবেলা থেকেই, সচেতন বাঙালি মুসলিম কিশোর-কিশোরীরা এক অনন্য চ্যালেঞ্জ এবং আঘাতের সম্মুখীন হন। তাঁরা তাদের সমাজ, ধর্মীয় উৎসব এবং সংস্কৃতিতে অহঙ্কার বহন করে, যা তাদের পরিচয়কে আকার দেয়। এই অহংকার নিয়ত সামাজিক প্রত্যাশার অবিরাম ধারার সঙ্গে আসে। এমন একটি সমাজে তাদের সতন্ত্র জায়গা খুঁজে পাওয়ার লড়াই অভসম্ভাবি যেখানে এখনও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন হয়। বঙ্গভঙ্গ এবং তৎপরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, বাঙালি পরিচয়ের জটিলতাকে আরও জটিল করে তোলে। বাঙালি (বাংলাভাষী) মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের জন্যই অন্তহীন ও বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করে।
দেশভাগের পর, পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দিশাহারা অবস্থার মধ্যে পড়েন। তাঁরা সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগের সম্মুখীন হন। মূলত, কৃষিনির্ভর জীবিকায় আটকে থাকা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অনুশীলন গতি হারায়। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও একসময় অগ্রগতির ভিত্তি প্রোথিত হয়। বহু বাঙালি মুসলিম মনিষী তাঁদের সৃজনশীল প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্প্রদায়ের মধ্যে জীবনের আনন্দ সঞ্চারিত করেন।
মইনুল হাসানের ‘বাঙালি ও মুসলমান’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি বাঙালি-মুসলিম পরিচয়ের গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে। লেখক বিভিন্ন অধ্যায় উপস্থাপন করেছেন যা এই পরিচয়ের জটিলতাগুলিকে অন্বেষণ করে, যেমন মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আশা ও হতাশার দ্বন্দ্ব, হিন্দু মুসলমানদের সমস্যা, সংকটের সময় চ্যালেঞ্জ এবং একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন। বইটি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় সংখ্যালঘুদের বিকাশের একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও তুলে ধরেছে। ছয়টি অধ্যায়ে বিস্তৃত গ্রন্থটির অধ্যায়গুলি এভাবে বিস্তৃত– (১) বাঙালি ও মুসলমান (২) মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান : আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব (৩) নামে-সম্বোধনে হিন্দু মুসলমান (৪) সংকট কাল (৫) আমার দেশ- আমার স্বপ্ন (৬) স্বাধীনোত্তর বাংলার সংখ্যালঘু উন্নয়ন: একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।
বাংলায় বাঙালি এবং মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক বহুমুখী এবং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক গতিশীলতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তবু মাঝে অনেক ‘অচেনা’, ‘অপরিচিতি’। এখানেই মইনুল হাসানের উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গতে বাঁধা ধারণা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন। এই সাম্প্রদায়িকতা যে সবসময় মন্দির-মসজিদ ভাঙা বা হানাহানি বা রক্তারক্তি, এমনটা কিন্তু নয়। এ ভেদাভেদ অন্তরের।মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রান্তিককরণে বামপন্থী ভূমিকার কথা বলার সময়, হাসান রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব এবং উচ্চপদের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শুধু সংখ্যালঘু মুসলিম নয়, ভারতের প্রান্তিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলি তুলে ধরে, যেমন বিহারের বেলাচিতে স্থানীয়দের পুড়িয়ে মারা, হাসান এই গভীর-মূল সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য প্রতিফলন এবং পদক্ষেপকে উত্সাহিত করেছেন।
রাজনীতিক, তার্কিক, প্রাবন্ধিক মইনুল হাসানের ‘বাঙালি ও মুসলমান’ প্রবন্ধ সংকলনটি পড়ার সময় বারবারই শুরুর পাতায় ফিরে গিয়েছি। সেখানে দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসে দু’দিন সফরে কাটানো সহযাত্রী তাঁর নাম শুনে আবাক হন, ‘অ্যা! মুসলমান! আমি তো ভেবেছিলাম বাঙালি!’ লেখক একে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভব বললেও, এটাই সামাজিক বাস্তব। বাঙালিও বাঙালিকে চিনতে ভুল করে! হবে না-ই বা কেন? ছুঁচলো তার দাড়ি, গোঁফ তার কামানো, মাথা তার নেড়া– মুসলিম সম্প্রদায়কে তো এভাবেই চিনিয়ে দেওয়া হয় সেই শৈশবে। মস্তিষ্কে লালিত সেই চেহারার বাইরে কাউকে মুসলমান জানলে মুখ দিয়ে ‘অ্যা’ বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক।
যদিও বাংলা দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় তুলনামূলকভাবে উদার হতে পেরেছে, তবু সমাজের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজনগুলিকে স্বীকার করা এবং সমাধান করা অপরিহার্য। তাঁর মতে বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করা এবং বাঙালী ও মুসলিমাদের মধ্যে বৃহত্তর বোঝাপড়া গড়ে তোলা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সেকেলে ধারণা ত্যাগ করে গভীর মেলামেশা এবং সমস্ত সম্প্রদায়ের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে, আমরা ব্যবধান পূরণ করতে পারি এবং একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারি যেখানে তার সত্যকার বহুত্ববাদ মর্যাদা পাবে।
বাঙালি ও মুসলমান
মইনুল হাসানপ্রকাশক: উদার আকাশ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন