সমাজের প্রান্তিক এলাকায় বসবাসকারী কিছু মানুষের গপ্পো শুনিয়ে 'ছোটলোক' মন জিতল নেটদুনিয়ার। সে প্রান্তিক এলাকা হোক বা পরিবারের মধ্যে, কিংবা সমাজে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা সার্বিকভাবে গোটা দুনিয়াতেই।
অনামিকা মিত্র
হিন্দি আর দক্ষিণী নানা ভাষার সিরিজের সাবালকত্ব প্রাপ্তি হলেও মুঠোফোনে বন্দি বাংলার সিরিজগুলো সাধারণভাবে এখনও কিছুটা পিছিয়ে। দু’চামচ সাসপেন্স, দেড় চামচ যৌনতা, তিন চামচ মতো রগরগে শব্দ আর আধচামচ মতো গল্প নিয়ে ঝাঁ চকচকে পট-বয়লার করে ফেলতে পারলেই সহজে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় বাংলার ওয়েবসিরিজ। তাই বাংলা সিরিজগুলো অনেক সময়েই বাংলা সিরিয়ালের এক্সটেন্ডেড ভার্সন হয়ে থেকে যায়। আসলে সিরিয়ালে যে সমস্ত জিনিস মিসিং থাকে, তা সেক্স হোক বা ভায়োলেন্স, সেগুলো খুঁজতেই সিরিজগুলোতে চোখ বোলানো। তবে সেই ধারণার ভিতটা ধরেই একটু নাড়া দিলেন ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। প্রথম তৈরি ওয়েব সিরিজেই সমাজের প্রান্তিক এলাকায় বসবাসকারী কিছু মানুষের গপ্পো শুনিয়ে মন জিতলেন নেটদুনিয়ার। সে প্রান্তিক এলাকা হোক না পরিবারের মধ্যে কিংবা সমাজে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা সার্বিকভাবে গোটা দুনিয়াতেই।![]() |
ছোটোলোক ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্য |
গল্পের মূল প্রোটাগনিস্ট সাব ইনস্পেক্টর সাবিত্রী মণ্ডল। কোটায় চাকরি পাওয়ার জন্য বারবার কটাক্ষ শুনতে হয় সহকর্মীদের কাছ থেকে। তেল চকচকে চুলে, সিঁথিতে ধেবড়ে থাকা সিঁদুরের দাগে, নাক কুঁচকে চশমা ঠিক করার অভ্যাসে কিংবা চুরমুর খেয়ে অম্বলে ভুগে সে যতটা ঘরের মানুষ, ততটাই থানার দাপুটে অফিসার। বড়বাবুর ফোনটা ধরার আগে, সকালের বরাদ্দ ঠাকুরের পটের সামনে মাটিতে ঢিপ করে কপাল ঠুকে নেয়। আবার লুচি ভাজার মাঝেই ফোন এলে তেলের কড়াই রেখেই উঠে পড়েন জিপে। রাজনৈতিক উচ্চমহল ঘনিষ্ঠ কস্তুরি গুহকে সপাটে একের পর এক চড় মারতে মারতে তার বুক ঢিপ ঢিপ করে বটে তবে তার পরেও রিস্কটা নিয়েই কাজটা পকেটে পুড়ে ফেলে। ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই গুলি ছোটানোর কোনও বাহাদুরি নেই। নেই চমকদার গ্ল্যামশ্যাম মেকআপ। এসব ছাড়াই সাবিত্রী মণ্ডল নিজের উচ্চতাকে কীভাবে যেন বড় করে ফেলেছে গল্পের নানা ধাপে।
বাংলায় থ্রিলার ছবি কিংবা সিরিজের অভাব রয়েছে নিশ্চিতভাবেই। কারণ বাঙালি দিনের শেষে পছন্দ করে সেই ফ্যামিলি ড্রামা। ছোটলোক-ও কিন্তু থ্রিলার নয় মোটেই। সাদামাটা মোড়কে গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা জীবনের নানা রহস্য সমাধানই এই ছবির ইউএসপি। একজন খুচরো মডেল আর পার্টটাইম এসকর্টের হঠাৎ খুন হয়ে যাওয়ার গল্পই ‘ছোটলোক’। কারা ছোটলোক আর কারাই বড়লোক সেই হিসাবও যেমন যাবে গুলিয়ে, তেমনই একটা প্রশ্ন মনে উঠতে বাধ্য– ‘ছোটলোক’ শব্দটির বিপরীত শব্দ কি আদৌ বড়লোক? সেই পাকেই ঘুরেছে গল্প। সাবিত্রীর চরিত্রে দামিনী বেণী বসুর কথা আলাদা করেই বলার দাবি রাখে। অভিনয় শেখানোটা যাঁর অন্যতম পেশা অথচ যিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে মনেই পড়ছে না, শুধুমাত্র সেই দামিনী বেণী বসুর জন্যই ‘ছোটলোক’ সিরিজটা বার কয়েক দেখে ফেলা যায়। নিশ্চিতভাবেই এমন বৈশিষ্ট্যহীন ছাপোষা অথচ অসীম কেজো পুলিশ অফিসার আর কোথায় দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছেন প্রতীক ‘জামিল’ দত্ত। সরকারি চাকুরে প্রতীক শুধু ভালোবাসার টানেই অভিনয়টা করেন। প্রিয়াঙ্কা সরকার কিংবা গৌরব চক্রবর্তী, ইন্দ্রানী হালদার কিংবা উষসী রায়, লোকনাথ দে কিংবা শুভ্রজিত দত্ত, তালিকা বাড়বে শুধু। ছোট থেকে ছোট চরিত্রে পাল্লা দিয়েছেন সকলেই।
![]() |
ছোটোলোক ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্য |
গল্পের শেষটায় একটা ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ মার্কা টুইস্ট রয়েছে, যা থেকে পরের সিজন আসার একটা আশা জাগে। আবার এমনও মনে হতে পারে, গল্পের শেষটুকু দর্শকের কল্পনার উপরেই ন্যস্ত করেছেন কবি। ইন্দ্রনীল ‘কবি’ রায়চৌধুরী অনেক সময়ের ব্যবধানে ছবি তৈরিতে হাত দেন যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সবমহলেই। তবে সুক্ষ্ম কাজের বালুচরী বুনতে হলে ওটুকু সময় তো দিতেই হবে পরিচালক মশাইকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন