সোর্ড পেনটা চেয়েছেন ভুরভুরিলাল। পুরানো পেন সংগ্রহ করা নাকি তাঁর নেশা। যত দামই হোক, তিনি ওই পেনের বিনিময়ে দিতে রাজি।
পুরুলিয়া বেড়াতে গিয়ে পিসেমশাইয়ের গিফ্ট করা সোর্ড-পেনটা নিয়ে বড্ড ঝঞ্ঝাট যাচ্ছে তোজোর। বাড়ি ফেরার দিনকতক বাদে একদিন ক্লাসে পেনটা দিয়ে লিখতে গিয়ে তোজো অবাক হয়ে দেখল, ওটা কথা শুনছে না। মানে ও যা লিখতে চাইছে, পেন থেকে সেটা বেরচ্ছে না, উল্টো কথা লেখা হয়ে যাচ্ছে। পেন চলছে তার নিজের মতো। আবার অঙ্ক করতে গিয়ে অন্য ব্যাপার। দেখল, তাকে কিছু করতে হচ্ছে না, পেন নিজের মতো অঙ্ক করে যাচ্ছে। একটা স্টেপও ভুল হচ্ছে না। সেদিন অঙ্ক স্যার রাধেশ্যামবাবু তো আচমকা হওয়া ক্লাস টেস্টে তোজোর নির্ভূল উত্তর দেখে চশমাটা কপালে তুলে সন্দেহের চোখে তার মুখের দিকে তাকালেন। ভাবখানা যেন এই, এ ছেলের হলটা কী! বরাবর তো বলেন, অঙ্কে তুই অশ্বডিম্ব প্রসব করবি! মস্তিষ্কে ঘিলু বলে পদার্থটাই নেই। কিন্তু আজ এ কী হল? ২০তে ২০ পেয়েছে তোজো! সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে স্যারের সামনে সপ্রতিভ থাকার চেষ্টা করল। স্যর খোঁচা দিলেন, ঠিক আছে, ফাইনালে কত নম্বর পাস, দেখব!
ক্লাসে সেদিন তোজোর পাশেই বসেছিল দীপ্র। টিফিনের সময় পিছনের দিকটা তরবারির খাপের মতো দেখতে রংচঙা পেনটার দিকে তার নজর পড়ল। তবে পেনের অদ্ভূত ক্ষমতার ব্যাপারে কিছুই টের পায়নি সে। 'একটু পেনটা দিবি, দেখব?' দীপ্রর আব্দার ফেলল না তোজো। কিন্তু দীপ্র হাতে পেনটা নিতেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। 'উফঃ বাপরে কী ভারী, হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে! ধর, ধর' আর্তনাদ করে উঠল দীপ্র। পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, তোজোর হাতে পেনটা ফিরিয়ে দিল সে। তোজো অবাক--'ভারী কোথায়? এই তো পালকের মতো হালকা!' অবিশ্বাস, সন্দেহের চোখে পেনটার দিকে তাকাচ্ছে দীপ্র। পাছে অন্য কেউ ব্যাপারটা দেখে ফেলে, তোজো সঙ্গে সঙ্গে পেনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। কিন্তু দীপ্র যদি বাকিদের বলে দেয়? রফা হল, তোজো অনলাইনে কেনা দুটো দামী গেম তাকে দেবে, এই শর্তে মুখ বন্ধ রাখবে দীপ্র। তবে তোজো বা দীপ্র-কারও নজরে পড়ল না যে, ওদের পিছনের দুটো বেঞ্চ ছেড়ে তৃতীয়টায় বসা একজন সব দেখে ফেলেছে। গোলকলাল গুড়গুড়িয়া। এলাকার বিশাল মুদি দোকানের মালিক ভুরভুরিলাল গুড়গুড়িয়ার ছেলে।
ছুটির সময় সে এগিয়ে এসে তোজোকে ক্লাস টেস্টের একটা অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করল। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তোজো বলল, আজ একটু তাড়া আছে রে, কাল দেখাব। গোলকলালের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একচিলতে হাসি। নজরে পড়ল না তোজো, দীপ্রর।
কিন্তু ওটা পেন নাকি অন্য কিছু? তোজো নিশ্চিন্ত হতে পারল না। পুরুলিয়ার সেই মেলায় রাস্তায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানী তোজোর সামনে পিসেমশাইকে বলেছিলেন, এ পেন লিয়ে যান বাবু, কলকাতায় এমন জিনিস পাবেন নে কো! এর অদ্ভূত ক্ষমতা। পিসেমশাইয়ের প্রশ্নের মুখে সেই বিক্রেতা ব্যাপারটা ভাঙতে চাননি। কিন্তু তোজোর মনে হচ্ছে, সত্যিই এটা যেমন, তেমন পেন নয়, কিছু একটা রহস্য আছে এর। তোজো একদিন পেনটা খুলে দেখেছিল, ভিতরে অসংখ্য সার্কিট, চুলের মতো সরু সরু তার। পেনের গায়ে রানি ভিক্টোরিয়ার মুখের ছবি। পাছে খারাপ হয়ে যায়, সেই ভয়ে সে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেনি পেনটা।
দেখতে দেখতে সরস্বতী পুজো এসে গেল। অঙ্ক স্যার ডেকে তোজোকে পুজোর খিচুড়ি ভোগ রান্নার সামগ্রী কেনার ভার দিলেন। চাল, ডাল, আলু, মশলাপাতি, তেল-ঘি-শাকসব্জি--সব মিলিয়ে অনেক পদ। কোনটা কতটা লাগবে, ফর্দ করে দিলেন রান্নার ঠাকুর। ভুরভুরিলালের দোকান থেকেই সব কেনা হবে। পুজোর আগের সন্ধ্যায় তোজো, তিন-চারজন সহপাঠীকে নিয়ে ভুরভুরিলালের দোকানে হাজির।
'আইয়ে আইয়ে কিংশুকবাবু (তোজোর ভাল নাম), আপকা সব সামান রেডি হ্যায়।' বলে কী ভুরভুরিলাল! তোজো ভেবেছিল, ফর্দটা জমা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু, সব গোছানো হয়ে গেছে! ভুরভুরিলাল দোকানের কর্মচারী রাঘবলালকে বললেন, সামান মিলাকে ভ্যান মে উঠা দো। রাঘবলালকে মুখে মুখে বলতে লাগলেন, চাওয়াল ৫ কেজি, ডাল ৩ কেজি, আলু ৫ কেজি, ফুলকফি ২০ পিস, ঘিউ ১ কেজি, তেল ২ কেজি, জিরা ৫০০, গরম মশলা ৫০ গ্রাম........তোজো ঘামতে শুরু করল। এটা কী হচ্ছে! তোজো হাতের লিস্ট মিলিয়ে দেখল, সেখানে যে জিনিসের যতটা পরিমান রান্নার ঠাকুর লিখেছেন, ঠিক সেটাই বলছেন ভুরভুরিলাল। কোথাও একচুল কম-বেশি হয়নি। অথচ কোনও তালিকা নেই তাঁর হাতে। এটা কী করে সম্ভব? এ কি মানুষ না যন্ত্র? তবে তোজো একটা ব্যাপার খেয়াল করল। ভুরভুরিলাল প্রতিবার খিচুড়ি রান্নার আইটেমের নাম বলার সময় চকচকে টাকওয়ালা মাথার পিছনে আলতো করে চাপড় মারছেন। তাহলে কি ওনার মাথার ভিতরে কোনও রহস্য আছে? তোজোরা জিনিসপত্র ভ্যানে তুলিয়ে স্কুলে ফিরছিল। দোকান ছাড়ার মুখে তোজোর নজরে পড়ল, এক কোণে বসে চোখ বুঝে ঝিমোচ্ছে একটা প্যাঁচা। ভুরভুরিলাল তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তোজো একটু অবাক হল।
সরস্বতী পুজো মিটে গেল ভালয় ভালয়। অঙ্ক স্যার আয়োজন সফল হওয়ায় তোজোদের প্রশংসা করলেন।
তোজো ভুলেই গিয়েছিল এসব। একদিন হঠাত্ সন্ধ্যায় ভুরভুরিলাল তোজোদের বাড়িতে হাজির হলেন। সঙ্গে ছেলে গোলকলাল। উপলক্ষ্য, ছেলের জন্মদিনের পার্টি দিচ্ছেন বাড়ি ভাড়া করে। সেখানে তোজোর সঙ্গে তার বাবা-মাকেও নেমতন্ন করলেন ভুরভুরিলাল। বেরনোর আগে বেশ কিছুক্ষণ বাবার কানে কানে কী যেন বলে গেলেন। তোজো দেখল, বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
রাতে খাবার টেবিলে বসে বাবা সোর্ড পেনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। তোজো হতবাক। কোনওদিন তো এত কিছু জানতে চায়নি বাবা। তাহলে আজ এত কিছু জানতে চাইছে কেন? বাবাকে কি কিছু বলেছেন ভুরভুরিলাল? তোজো চমকে উঠল, তাহলে কি ওই পেনের খবর ভুরভুরিলালের কাছে পৌঁছেছে! তবে তো মারাত্মক ব্যাপার।
রাতে ঘুমের ভান করে তোজো বাবা-মার কথা শুনছিল। বাবা বলছিল, সোর্ড পেনটা চেয়েছেন ভুরভুরিলাল। পুরানো পেন সংগ্রহ করা নাকি তাঁর নেশা। যত দামই হোক, তিনি ওই পেনের বিনিময়ে দিতে রাজি। কিন্তু বাবা জানিয়ে দিয়েছে, ছেলের উপহার পাওয়া পেন কোনও মূল্যেই কাউকে দেবে না, ছেলে কষ্ট পায়, এমন কিছু করবে না। ভুরভুরিলাল মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন।
তোজোর মনে হল, ভুরভুরিলালের পেন সংগ্রহের নেশার কথা মিথ্যা। কোনওভাবে তিনি ওই পেনের অদ্ভূত ক্ষমতার কথা জেনে ফেলেছেন। তাই ওটা হস্তগত করতে চান। কিন্তু জীবন থাকতে তোজো ওই পেন কাউকে দেবে না সে।
বাড়ি বয়ে এসে নেমতন্ন করে গিয়েছেন, না যাওয়াটা অসৌজন্য হতে পারে। তাই মনে সন্দেহ, অবিশ্বাসের মেঘ নিয়েই তোজো বাবার সঙ্গে ভুরভুরিলালের ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে গেল। বিরাট আয়োজন। ডিজে বাজছে। ডিজের তালে অন্যদের সঙ্গে নাচছেন মাথায় পাগড়ি পড়া ভুরভুরিলাল স্বয়ং। সে এক অদ্ভূত দৃশ্য। নাচতে নাচতে একবার ভল্ট খাচ্ছেন, প্রায় শুয়ে পড়ে আবার সোজা লাফ মেরে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। আবার কখনও উধাও হয়ে যাচ্ছেন। পর মুহূর্তেই মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছেন। তার মধ্যেই আবার হাত নেড়ে আমন্ত্রিতদেরও স্বাগত জানাচ্ছেন! তোজোর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
তোজো ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে পেটভরে কাবাব, মাটন বিরিয়ানি খেল। ফিরে আসার সময় আবার ভুরভুরিলাল বাবাকে এককোণে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। তোজো জানে, পেনের কথাটাই ফের তুললেন তিনি।
এরপর কয়েকটা দিন চলে গেল। সেদিন সকালে আচমকা বাবার মোবাইল বেজে উঠল। ফোন তুললেই বাবা একটু চড়া মেজাজে বলে উঠল, 'আপনাকে তো আগেই বলেছি, ভুরভুরিলালজি, ওই পেন দেব না, যত টাকাই অফার দিন না কেন! কেন ফোন করছেন?' ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ভুরভুরিলালের উত্তেজিত কণ্ঠও শুনতে পেল তোজো। 'ও পেন হামি লিয়েই ছাড়ব!' তোজোর বুকটা দুরদুর করে উঠল। সে ভাবল, বাবাকে বলবে, তাহলে পেনটা ব্যাঙ্কের লকারে রেখে এসো। ঠাম্মিকে কথাটা বলতে তিনিও সায় দিলেন। বাবা বললেন, ঠিক আছে, কালই যাব। পড়ার ঘরে টেবিলের ওপর পেনসিল বক্সে পেনটা রাখা ছিল। ঠিক আছে তো ওটা? তোজো ছুটে গেল। বক্স খুলে দেখা গেল, পেন যথাস্থানেই আছে। নিশ্চিন্ত হল তোজো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খারাপ ঘটনাটাই ঘটল। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে মেঝেতে পা ফেলতেই তোজো দেখল একটা সাদা চিরকুট পড়ে আছে। তাতে লেখা, 'কিংশুকবাবু, ও পেন হাম লে গয়ে। লেকিন ঘাবড়াইয়ে মত, ম্যায় উসসে আচ্ছি এক পেন আপকো ভেজ দুঙ্গা। থোড়া সবর কিজিয়ে'---ভুরভুরিলাল। তোজো লাফিয়ে উঠে টেবিলে রাখা বক্সটা খুলল। সত্যিই, পেন উধাও!
কিন্তু কী করে গায়েব হল, কে ওদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পেনটা হাতিয়ে নিল? বাড়িতে তো সবাই ছিল! ভুলো কোত্থেকে ছুটে এসে কিছু একটা কিছু তোজোর নজরে আনার চেষ্টা করছিল। ভাল করে তোজো মেঝের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল, আবছা জোড়া পায়ের ছাপ। তবে মানুষের নয়, সম্ভবতঃ কোনও পাখির। একটু জমাট বাঁধা চিনিও পড়ে আছে ওখানে। তোজোদের ফ্ল্যাটের জানালা গত কয়েকদিন ধরে খোলাই রয়েছে। আচমকা তোজোর ভুরভুরিলালের দোকানে ঝিমোতে থাকা প্যাঁচার মুখটা মনে পড়ে গেল। প্যাঁচাটা কোনও এক ফাঁকে সবার নজর এড়িয়ে জানালা গলে ঢুকে পেনটা নিয়ে যায়নি তো!
ঠাম্মি তোজোকে শান্ত করার চেষ্টায় বললেন, ঠিক আসে, পিসামশাই সামনের মাসেই পুরুলিয়া যাইব। ওইরকম একটা পেন ঠিক খুঁইজ্যা আনব। কিন্তু তোজোর মন মানল না।
আচমকা পাশের ঘরে খুটখুট শব্দ। তোজো পা টিপে টিপে ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখল, সেই প্যাঁচা। জানালায় বসা। 'আবার কী নিতে এসছিস তুই?' চিত্কার করে হাতে থাকা স্কেলটা ছুঁড়ে মারল তোজো। কিন্তু প্যাঁচাটা পা বাড়িয়ে চুম্বকের মতো সেটা ধরে ফেলল। নির্লিপ্ত, নির্বিকার সে। কোথায় পালাবে, উল্টে ঘরের মেঝেতে নেমে এল! ততক্ষণে ঠাম্মি তোজোর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তোজোকে বললেন, 'প্যাঁচা লক্ষ্মীর দূত। তার লগে এমন করিস না। ভাল হইব না।'
প্যাঁচা ঘরজুড়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল। কী যেন খুঁজছে। এবার সরাসরি তোজোর দিকে চাইল। চাহনির অর্থ, কিছু বলতে চাইছে। তোজোও সোজা প্যাঁচার দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই তোজোর বিস্মিত হওয়ার পালা। এ কী দেখছে সে? প্যাঁচার দুচোখে ভুরভুরিলালকে দেখা যাচ্ছে। তোজোকে আরও অবাক করে প্যাঁচা মানুষের গলায় বলে উঠল, 'ছিঃ কিংশুক। স্কেলটা কিনতে বুঝি পয়সা লাগেনি যে ওটা ছুঁড়ে মারলে! পেনটা আমিই ভুরভুরিলালের নির্দেশে মুখে করে নিয়ে গিয়েছি। আমি দুঃখিত। কিছু করার ছিল না আমার।' তোজো বলল, 'তাহলে এখন কি আমায় সহানুভূতি জানাতে এসেছ?' প্যাঁচা বলল,' মন দিয়ে শোনো, যা বলছি। আমি কোথায় যাই, নজর রাখতে ভুরভুরিলাল আমার পায়ে চিপ বসিয়ে দিয়েছে। মাথায়ও চিপ আছে যাতে চাইলে সব কথা রেকর্ড করতে পারি। পায়ের চিপটা খুলে কোথায় পড়ে গিয়েছে। এই সুযোগে দেখে নাও, ভুরভুরিলাল কী করছে?'
প্যাঁচার চোখে তাকিয়ে তোজো হাঁ হয়ে ভুরভুরিলালের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগল। সে দেখল, চেয়ারে বসা ভুরভুরিলালের হাতে তার সোর্ড পেনটা। মাথার পিছনটা হাতের চাপড় মেরে খুলে ফেললেন ভুরভুরিলাল। মাথার পিছনে অনেকগুলো বাক্সের মতো ঘর! ভিতরে অজস্র তার, স্ক্র। একটা ঘর থেকে একটা চিপ বের করে পেনটা খুলে সেটা ঢুকিয়ে দিলেন। আর পেন থেকে একটা চিপ বের করে নিজের মাথার পিছনের একটা খোপে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর আবার চাপড় মারতেই মাথার পিছনটা জুড়ে গেল। মানুষের মাথা এমন হয় নাকি? এরপর ভুরভুরিলাল একটা খাতা টেনে নিয়ে বললেন, ‘জয় সিয়ারাম, জয় বজরংবলি!’ পেনটা আপনা থেকে লিখে চলল সে কথা। আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন ভুরভুরিলাল। অপারেশন সাকসেসফুল।
তোজো প্যাঁচাকে জিজ্ঞাসা করল, 'এমন কেন করছেন ভুরভুরিলাল? কী চান উনি?' প্যাঁচা বলল, 'আসলে ভুরভুরিলাল এক অদ্ভূত, খাপছাড়া চরিত্রের লোক। স্ত্রী প্রয়াত, একমাত্র ছেলেটাও একা একা থাকে। উনি দোকান সামলান, বাকি সময়টা যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। ওনার বিশ্বাস, একদিন পৃথিবীতে মানুষের কোনও কাজ থাকবে না, মানুষ শুধু নির্দেশ দেবে, যন্ত্রই সব করে দেবে। এখন যেমন রোবট রেস্তরাঁয় খাবার সার্ভ করে, হাসপাতালে সার্জারি পর্যন্ত করে, যদিও তাকে প্রোগ্রামিং করে চালাতে হয়, আগামী দিনে সেটারও প্রয়োজন হবে না। যন্ত্রই সমস্যার সমাধান করে দেবে। মানুষের জায়গা নেবে। যন্ত্রই হবে সর্বশক্তিমান। উনি এমন একটা যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করছেন। তোমার যে সোর্ড পেনটা উনি কব্জা করেছেন, তার আরও ক্ষমতা বাড়াতে চান। দেখলে না, নিজের মাথা থেকে কেমন চিপ খুলে পেনে ঢোকালেন। তারপরই পেন যেমন শুনল, তেমনই লিখে দিল। আর এই যে আমি কথা বলছি, সে তো ভুরভুরিলালের খেলা। আমার গলায়ও চিপ বসানো আছে।'
তোজো বলল, 'তবে তো মারাত্মক ব্যাপার ঘটতে চলেছে। মানুষের চেয়ে যন্ত্র বড় হবে নাকি?' ঠাম্মি বললেন,'মানুষ চুপ কইরা যন্ত্রের কথা মতো চলব! সে কী রে বাবা! তাইলে তোদের স্কুলে কি যন্ত্ররা পড়াইব?'
প্যাঁচা বলল, 'সব তো দেখলে। আমি এখন যাই। দেরি হলে আমায় সন্দেহ করবে ভুরভুরিলাল। আবার আসব।'
তোজো ফোন করল দীপ্র, শুদ্ধ, সৌম্যকে। পেনের ঘটনাটা সবিস্তার বলল। ওরা তোজোকে বলল, 'ভুরভুরিলালের কাণ্ডকারখানা স্বচক্ষে দেখতে ওর বাড়িতে হানা দিলে কেমন হয়!'
প্যাঁচার কাছ থেকে তোজো শুনল, ভুরভুরিলালের শরীর ভাল যাচ্ছে না। পেনের চিপটা মাথার ভিতরে ঢোকানোর পর থেকে বুকে ব্যথা অনুভব করছেন। এটা আগে হোত না।
সামনের বড়দিনে ভুরভুরিলালের জন্মদিন। ঠিক হল, ওরা গোলকলালের বন্ধু পরিচয়ে ভুরভুরিলালের বাড়ি যাবে, তাঁকে ফুল-মিষ্টি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। তোজো ধরা পড়ে যেতে পারে, তাই সামনে থাকবে না। তবে ঠাম্মিকে সে রাজি করাল, তিনি অভিভাবক হিসাবে দীপ্র, শুদ্ধ, সৌম্যদের সঙ্গে যাবেন।
প্যাঁচা পরে এসেছিল। তাকেও তোজো সব জানিয়ে রাখল।
বড়দিনের সকালে ঠাম্মিকে সঙ্গে নিয়ে ভুরভুরিলালের বাড়ির দরজার বেল টিপল ওরা। হাতে মিষ্টির বাক্স, বেশ কয়েকটা গোলাপ দেওয়া রজনীগন্ধার মালা, মিও আমোরের কেক। তোজো গলির মুখে অপেক্ষায় রইল। দূর থেকেই ওরা শুনতে পেয়েছিল, বাড়ির ভিতর থেকে হারমোনিয়াম, বাঁশি, গিটারের শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই ভুরভুরিলালের জন্মদিনে গানবাজনার তোড়জোড় হচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদেই যে দরজা খুলল, তাকে দেখে চমকে উঠল দীপ্ররা। সামনে দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত এক রোবট। তারপরই এক অদ্ভূত কাণ্ড। রোবট জুলজুল করে তাকিয়ে কেকের বাক্সের দিকে। বলতে গেলে, ওদের হাত থেকে ছিনিয়েই নিচ্ছিল বাক্সটা। কোনওমতে সেটা আড়াল করে দীপ্ররা ওর হাতে গুঁজে দিল একটা মালা। গোলাপ, রজনীগন্ধার সুগন্ধে মাতোয়ারা রোবট যেন ভুলেই গেল কিছু অচেনা লোকজন ভিতরে চলে এসেছে। এই সুযোগে ছদ্মবেশে থাকা তোজোও ভিতরে ঢুকে পড়ল। বাইরের বসার ঘরের দৃশ্যে ওদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! হারমোনিয়াম, বাঁশি, গিটার সহযোগে 'হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ' প্র্যাকটিস করছে কতগুলি অদ্ভূত চেহারা। এরা কি ভিনগ্রহী? মাথাগুলো বাক্সের মতো, তার ওপর অ্যান্টেনা। চোখ থেকে বেগুনি রশ্মি বেরচ্ছে। দীপ্রদের দেখে বাজনা থেমে গেল। ওদের নজর তখন মালা, কেকের বাক্সের দিকে। বেঁটে চেহারার একটা যন্ত্র টলোমলো পায়ে এগিয়ে এল। রজনীর মালার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। পিছনে ঘুরে হাত দেখিয়ে ইশারা করল বাকিদের। ওরাও সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর রজনীর মালাগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। ততক্ষণে সেখানে হাজির রোবটও। সে ওদের ঠেলে সরাতে গেল। ওরাও নড়বে না। রোবটের সঙ্গে ওদের রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি শুরু হল।
ধস্তাধস্তির শব্দে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন ভুরভুরিলাল। চিত্কার করে উঠলেন, 'কেয়া হো রহা হ্যায়?' আর তখনই তাঁর চোখাচোখি হয়ে গেল দীপ্রদের সঙ্গে। 'তুম লোগ! ইহা কিউ!' ঠাম্মি এগিয়ে গিয়ে বললেন, 'এই বাচ্চারা আপনার ছেলের স্কুলের সহপাঠী। আপনার জন্মদিন আজ। আপনাকে মালা, কেক-মিষ্টি দিয়ে উইশ করতে এসেছে। তো কেক কাটবেন তো?' 'হাঁ, হাঁ, জরুর।'--- খুশিতে ডগমগ ভুরভুরিলাল। 'আপনার ছেলে কোথায়? ওকে ডাকুন!' বলল ঠাম্মি। কিন্তু ভুরভুরিলালের যেন সেদিকে খেয়াল নেই। ছেলেকে ডাকলেনই না। কেন কে জানে? রোবট গটগট করে হেঁটে দেশলাই, মোমবাতি জোগাড় করে নিয়ে এল। টেবিলে কেক সাজিয়ে মোমবাতি জ্বালাল। ওদিকে বাক্সওয়ালা মাথাগুলোও যে যার যন্ত্র নিয়ে তৈরি। ওরা গান ধরবে। ভুরভুরিলাল ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে কেক কেটে রোবটকে খাওয়াতে গেলেন। কিন্তু ছুটে এসে তাঁর হাত থেকে কেকের টুকরো ছিনিয়ে নিল একটা বাক্সওয়ালা মাথা। বাকি কেকটা নিয়ে টানাটানি শুরু হল ওদের মধ্যেই। রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ। ভুরভুরিলাল সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে একটা কৌটো এনে কিছু ওদের গায়ে স্প্রে করে দিতেই সবাই নেতিয়ে পড়ল। এই হট্টগোলের মধ্যেই প্যাঁচার সিগন্যাল পেয়ে তোজো আর আরেক বন্ধু ওপরে উঠে গেল।
ভুরভুরিলালকে ঠাম্মি বললেন, 'তাহলে হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হবে কী করে?' ভুরভুরিলাল বললেন, 'থোড়া টাইম দিজিয়ে। সব ফির জাগ জায়েগি।' রোবট একটু করে কেক মুখের সামনে ধরতেই সম্বিত ফিরল ওদের। সবাই মিলে কেক খেতে খেতে 'হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, ভুরভুরিলালজি' গেয়ে উঠল। এবার স্বয়ং ভুরভুরিলাল গান ধরলেন, 'আগুনের পরশমনি, ছোঁয়াও প্রাণে.....এ জীবন পূণ্য করো।' কিন্তু বাবার জন্মদিন সেলিব্রেট করা হলো, আর ছেলেই নেই! ভুরভুরিলাল সাফাই দিলেন, 'ও স্টাডিমে হ্যায়। অর আপ সব লোগ তো হ্যায়। ইয়ে লোগ (রোবট ও বাক্সওয়ালা মাথারা) ভি হ্যায়।'
ততক্ষণে তোজো আর এক বন্ধু ভুরভুরিলালের ঘরে ঢুকে দেখে গোলকলাল সেই সোর্ড পেন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। সর্বনাশ! ও নিশ্চয়ই ভুরভুরিলালের নজর এড়িয়ে পেনটা সরিয়েছে। তোজোরা আলমারির পিছনে লুকিয়ে পড়ল। প্যাঁচা চালাকি করে গোলকলালকে বলল, 'তোমার বাবা নিচে ডাকছে। কেক খাবে না? সব তো শেষ হয়ে গেল বোধহয়।'
একথা শুনেও গোলকলালের তেমন ভাবান্তর হল না। বলল, 'বাবা তো আমায় একবারও ডাকল না! সারাদিন তো শুধু রোবট আর ওই বিদঘুটে দেখতে যন্ত্রগুলিকে নিয়ে থাকে।' প্যাঁচা মিথ্যে বলল, 'কই আমাকেই তো পাঠাল তোমায় ডেকে নিয়ে যেতে। যাও, যাও, এরপর আর কেক পাবে না!' 'তাই নাকি!' বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গোলকলাল। সেই সুযোগে প্যাঁচা পেনটা তুলে নিয়ে তোজোর হাতে দিয়ে বলল, দরজার পিছনে সিঁড়ি আছে। ওদিক দিয়ে পালাও। আমি এদিকটা সামলে নেব।
ভুরভুরিলালকে কেক-টেক খাইয়ে ঠাম্মি, দীপ্ররা বেরিয়ে এসেছে। তোজোও পেনটা যত্ন করে লুকিয়ে এনে বাড়ি ঢুকে পড়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভুরভুরিলাল পেন খোয়া গিয়েছে জেনে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়েছেন। তোজো অপেক্ষা করছে, কতক্ষণে প্যাঁচা রিপোর্ট নিয়ে আসে।
বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে প্যাঁচা তোজোর জানালায় হাজির। গম্ভীর মুখে বলল সে, পেন খোয়া গিয়েছে, টের পেয়ে ভুরভুরিলাল সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজছেন। তার চোখে তাকিয়ে দেখা গেল, রোবট, বাক্সওয়ালা মাথাদের ধরে ধরে ঝাঁকাচ্ছেন তিনি। 'বল, তোরা থাকতে কী করে পেনটা খোয়া গেল? জবাব দে।' তবে ওরা বেশিক্ষণ সহ্য করল না। পাল্টা সবাই মিলে ভুরভুরিলালকে আক্রমণ করল। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে ভুরভুরিলালের মাথার পিছনের ঘরগুলি আচমকা খুলে কয়েকটা চিপ পড়ে যেতেই তাঁকে টলতে দেখা গেল। সঙ্গে তীব্র আর্ত চিত্কার। তিনি পড়ে গেলেন। ছুটে গেল গোলকলাল। 'পিতাজি', 'পিতাজি' বলে কান্না। রোবট, বাক্সওয়ালা মাথারাও হকচকিয়ে গিয়েছে। ভুরভুরিলালের কি খারাপ কিছু হল? গোলকলাল বাবার চোখেমুখে জল ছেটাল। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ নেই।
প্যাঁচা তোজোকে বলল, আমি এবার আসি। দেখি, ভুরভুরিলালকে সুস্থ করে তুলতে পারি কিনা। তোমার সোর্ড পেনটা রেডি করে রাখো। আমি ফিরে গিয়ে ভুরভুরিলালকে দাঁড় করিয়ে কথা বলাতে পারলে তা পেন খাতায় লিখে দেবে।
তোজো পেনটা আলমারি থেকে বের করে খাতা খুলে বসল। কিছুক্ষণ বাদেই কলমটা নড়ে উঠল। দেখা গেল, খাতার পৃষ্ঠায় ফুটে উঠছে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লাইভ কথা।
ভুরভুরিলাল বলছেন, পোষা প্যাঁচা ফিরে এসে মাথার চিপগুলি লাগিয়ে না দিলে হয়তো বাঁচতাম না। সোর্ড পেনটা জেদের বশে নিয়ে আসার পর থেকেই শরীরে নানা সমস্যা হচ্ছে। ওটা কিংশুকবাবুকে তুই ফিরিয়ে দিয়েছিস, তাই হোক। ওটার আসল মালিক যে, তার কাছেই থাকা উচিত। তাছাড়া পেনটায় রহস্য আছে। তা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল।
আর দুর্ভাবনার অবকাশ রইল না, নিশ্চিত হল তোজো। ভুরভুরিলাল আর তার সোর্ড পেনের দিকে হাত বাড়াবেন না।
ক্লাসে সেদিন তোজোর পাশেই বসেছিল দীপ্র। টিফিনের সময় পিছনের দিকটা তরবারির খাপের মতো দেখতে রংচঙা পেনটার দিকে তার নজর পড়ল। তবে পেনের অদ্ভূত ক্ষমতার ব্যাপারে কিছুই টের পায়নি সে। 'একটু পেনটা দিবি, দেখব?' দীপ্রর আব্দার ফেলল না তোজো। কিন্তু দীপ্র হাতে পেনটা নিতেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। 'উফঃ বাপরে কী ভারী, হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে! ধর, ধর' আর্তনাদ করে উঠল দীপ্র। পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, তোজোর হাতে পেনটা ফিরিয়ে দিল সে। তোজো অবাক--'ভারী কোথায়? এই তো পালকের মতো হালকা!' অবিশ্বাস, সন্দেহের চোখে পেনটার দিকে তাকাচ্ছে দীপ্র। পাছে অন্য কেউ ব্যাপারটা দেখে ফেলে, তোজো সঙ্গে সঙ্গে পেনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। কিন্তু দীপ্র যদি বাকিদের বলে দেয়? রফা হল, তোজো অনলাইনে কেনা দুটো দামী গেম তাকে দেবে, এই শর্তে মুখ বন্ধ রাখবে দীপ্র। তবে তোজো বা দীপ্র-কারও নজরে পড়ল না যে, ওদের পিছনের দুটো বেঞ্চ ছেড়ে তৃতীয়টায় বসা একজন সব দেখে ফেলেছে। গোলকলাল গুড়গুড়িয়া। এলাকার বিশাল মুদি দোকানের মালিক ভুরভুরিলাল গুড়গুড়িয়ার ছেলে।
ছুটির সময় সে এগিয়ে এসে তোজোকে ক্লাস টেস্টের একটা অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করল। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তোজো বলল, আজ একটু তাড়া আছে রে, কাল দেখাব। গোলকলালের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একচিলতে হাসি। নজরে পড়ল না তোজো, দীপ্রর।
কিন্তু ওটা পেন নাকি অন্য কিছু? তোজো নিশ্চিন্ত হতে পারল না। পুরুলিয়ার সেই মেলায় রাস্তায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানী তোজোর সামনে পিসেমশাইকে বলেছিলেন, এ পেন লিয়ে যান বাবু, কলকাতায় এমন জিনিস পাবেন নে কো! এর অদ্ভূত ক্ষমতা। পিসেমশাইয়ের প্রশ্নের মুখে সেই বিক্রেতা ব্যাপারটা ভাঙতে চাননি। কিন্তু তোজোর মনে হচ্ছে, সত্যিই এটা যেমন, তেমন পেন নয়, কিছু একটা রহস্য আছে এর। তোজো একদিন পেনটা খুলে দেখেছিল, ভিতরে অসংখ্য সার্কিট, চুলের মতো সরু সরু তার। পেনের গায়ে রানি ভিক্টোরিয়ার মুখের ছবি। পাছে খারাপ হয়ে যায়, সেই ভয়ে সে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেনি পেনটা।
দেখতে দেখতে সরস্বতী পুজো এসে গেল। অঙ্ক স্যার ডেকে তোজোকে পুজোর খিচুড়ি ভোগ রান্নার সামগ্রী কেনার ভার দিলেন। চাল, ডাল, আলু, মশলাপাতি, তেল-ঘি-শাকসব্জি--সব মিলিয়ে অনেক পদ। কোনটা কতটা লাগবে, ফর্দ করে দিলেন রান্নার ঠাকুর। ভুরভুরিলালের দোকান থেকেই সব কেনা হবে। পুজোর আগের সন্ধ্যায় তোজো, তিন-চারজন সহপাঠীকে নিয়ে ভুরভুরিলালের দোকানে হাজির।
'আইয়ে আইয়ে কিংশুকবাবু (তোজোর ভাল নাম), আপকা সব সামান রেডি হ্যায়।' বলে কী ভুরভুরিলাল! তোজো ভেবেছিল, ফর্দটা জমা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু, সব গোছানো হয়ে গেছে! ভুরভুরিলাল দোকানের কর্মচারী রাঘবলালকে বললেন, সামান মিলাকে ভ্যান মে উঠা দো। রাঘবলালকে মুখে মুখে বলতে লাগলেন, চাওয়াল ৫ কেজি, ডাল ৩ কেজি, আলু ৫ কেজি, ফুলকফি ২০ পিস, ঘিউ ১ কেজি, তেল ২ কেজি, জিরা ৫০০, গরম মশলা ৫০ গ্রাম........তোজো ঘামতে শুরু করল। এটা কী হচ্ছে! তোজো হাতের লিস্ট মিলিয়ে দেখল, সেখানে যে জিনিসের যতটা পরিমান রান্নার ঠাকুর লিখেছেন, ঠিক সেটাই বলছেন ভুরভুরিলাল। কোথাও একচুল কম-বেশি হয়নি। অথচ কোনও তালিকা নেই তাঁর হাতে। এটা কী করে সম্ভব? এ কি মানুষ না যন্ত্র? তবে তোজো একটা ব্যাপার খেয়াল করল। ভুরভুরিলাল প্রতিবার খিচুড়ি রান্নার আইটেমের নাম বলার সময় চকচকে টাকওয়ালা মাথার পিছনে আলতো করে চাপড় মারছেন। তাহলে কি ওনার মাথার ভিতরে কোনও রহস্য আছে? তোজোরা জিনিসপত্র ভ্যানে তুলিয়ে স্কুলে ফিরছিল। দোকান ছাড়ার মুখে তোজোর নজরে পড়ল, এক কোণে বসে চোখ বুঝে ঝিমোচ্ছে একটা প্যাঁচা। ভুরভুরিলাল তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তোজো একটু অবাক হল।
সরস্বতী পুজো মিটে গেল ভালয় ভালয়। অঙ্ক স্যার আয়োজন সফল হওয়ায় তোজোদের প্রশংসা করলেন।
তোজো ভুলেই গিয়েছিল এসব। একদিন হঠাত্ সন্ধ্যায় ভুরভুরিলাল তোজোদের বাড়িতে হাজির হলেন। সঙ্গে ছেলে গোলকলাল। উপলক্ষ্য, ছেলের জন্মদিনের পার্টি দিচ্ছেন বাড়ি ভাড়া করে। সেখানে তোজোর সঙ্গে তার বাবা-মাকেও নেমতন্ন করলেন ভুরভুরিলাল। বেরনোর আগে বেশ কিছুক্ষণ বাবার কানে কানে কী যেন বলে গেলেন। তোজো দেখল, বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
রাতে খাবার টেবিলে বসে বাবা সোর্ড পেনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। তোজো হতবাক। কোনওদিন তো এত কিছু জানতে চায়নি বাবা। তাহলে আজ এত কিছু জানতে চাইছে কেন? বাবাকে কি কিছু বলেছেন ভুরভুরিলাল? তোজো চমকে উঠল, তাহলে কি ওই পেনের খবর ভুরভুরিলালের কাছে পৌঁছেছে! তবে তো মারাত্মক ব্যাপার।
রাতে ঘুমের ভান করে তোজো বাবা-মার কথা শুনছিল। বাবা বলছিল, সোর্ড পেনটা চেয়েছেন ভুরভুরিলাল। পুরানো পেন সংগ্রহ করা নাকি তাঁর নেশা। যত দামই হোক, তিনি ওই পেনের বিনিময়ে দিতে রাজি। কিন্তু বাবা জানিয়ে দিয়েছে, ছেলের উপহার পাওয়া পেন কোনও মূল্যেই কাউকে দেবে না, ছেলে কষ্ট পায়, এমন কিছু করবে না। ভুরভুরিলাল মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন।
তোজোর মনে হল, ভুরভুরিলালের পেন সংগ্রহের নেশার কথা মিথ্যা। কোনওভাবে তিনি ওই পেনের অদ্ভূত ক্ষমতার কথা জেনে ফেলেছেন। তাই ওটা হস্তগত করতে চান। কিন্তু জীবন থাকতে তোজো ওই পেন কাউকে দেবে না সে।
বাড়ি বয়ে এসে নেমতন্ন করে গিয়েছেন, না যাওয়াটা অসৌজন্য হতে পারে। তাই মনে সন্দেহ, অবিশ্বাসের মেঘ নিয়েই তোজো বাবার সঙ্গে ভুরভুরিলালের ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে গেল। বিরাট আয়োজন। ডিজে বাজছে। ডিজের তালে অন্যদের সঙ্গে নাচছেন মাথায় পাগড়ি পড়া ভুরভুরিলাল স্বয়ং। সে এক অদ্ভূত দৃশ্য। নাচতে নাচতে একবার ভল্ট খাচ্ছেন, প্রায় শুয়ে পড়ে আবার সোজা লাফ মেরে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। আবার কখনও উধাও হয়ে যাচ্ছেন। পর মুহূর্তেই মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছেন। তার মধ্যেই আবার হাত নেড়ে আমন্ত্রিতদেরও স্বাগত জানাচ্ছেন! তোজোর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
তোজো ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে পেটভরে কাবাব, মাটন বিরিয়ানি খেল। ফিরে আসার সময় আবার ভুরভুরিলাল বাবাকে এককোণে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। তোজো জানে, পেনের কথাটাই ফের তুললেন তিনি।
এরপর কয়েকটা দিন চলে গেল। সেদিন সকালে আচমকা বাবার মোবাইল বেজে উঠল। ফোন তুললেই বাবা একটু চড়া মেজাজে বলে উঠল, 'আপনাকে তো আগেই বলেছি, ভুরভুরিলালজি, ওই পেন দেব না, যত টাকাই অফার দিন না কেন! কেন ফোন করছেন?' ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ভুরভুরিলালের উত্তেজিত কণ্ঠও শুনতে পেল তোজো। 'ও পেন হামি লিয়েই ছাড়ব!' তোজোর বুকটা দুরদুর করে উঠল। সে ভাবল, বাবাকে বলবে, তাহলে পেনটা ব্যাঙ্কের লকারে রেখে এসো। ঠাম্মিকে কথাটা বলতে তিনিও সায় দিলেন। বাবা বললেন, ঠিক আছে, কালই যাব। পড়ার ঘরে টেবিলের ওপর পেনসিল বক্সে পেনটা রাখা ছিল। ঠিক আছে তো ওটা? তোজো ছুটে গেল। বক্স খুলে দেখা গেল, পেন যথাস্থানেই আছে। নিশ্চিন্ত হল তোজো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খারাপ ঘটনাটাই ঘটল। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে মেঝেতে পা ফেলতেই তোজো দেখল একটা সাদা চিরকুট পড়ে আছে। তাতে লেখা, 'কিংশুকবাবু, ও পেন হাম লে গয়ে। লেকিন ঘাবড়াইয়ে মত, ম্যায় উসসে আচ্ছি এক পেন আপকো ভেজ দুঙ্গা। থোড়া সবর কিজিয়ে'---ভুরভুরিলাল। তোজো লাফিয়ে উঠে টেবিলে রাখা বক্সটা খুলল। সত্যিই, পেন উধাও!
কিন্তু কী করে গায়েব হল, কে ওদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পেনটা হাতিয়ে নিল? বাড়িতে তো সবাই ছিল! ভুলো কোত্থেকে ছুটে এসে কিছু একটা কিছু তোজোর নজরে আনার চেষ্টা করছিল। ভাল করে তোজো মেঝের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল, আবছা জোড়া পায়ের ছাপ। তবে মানুষের নয়, সম্ভবতঃ কোনও পাখির। একটু জমাট বাঁধা চিনিও পড়ে আছে ওখানে। তোজোদের ফ্ল্যাটের জানালা গত কয়েকদিন ধরে খোলাই রয়েছে। আচমকা তোজোর ভুরভুরিলালের দোকানে ঝিমোতে থাকা প্যাঁচার মুখটা মনে পড়ে গেল। প্যাঁচাটা কোনও এক ফাঁকে সবার নজর এড়িয়ে জানালা গলে ঢুকে পেনটা নিয়ে যায়নি তো!
ঠাম্মি তোজোকে শান্ত করার চেষ্টায় বললেন, ঠিক আসে, পিসামশাই সামনের মাসেই পুরুলিয়া যাইব। ওইরকম একটা পেন ঠিক খুঁইজ্যা আনব। কিন্তু তোজোর মন মানল না।
আচমকা পাশের ঘরে খুটখুট শব্দ। তোজো পা টিপে টিপে ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখল, সেই প্যাঁচা। জানালায় বসা। 'আবার কী নিতে এসছিস তুই?' চিত্কার করে হাতে থাকা স্কেলটা ছুঁড়ে মারল তোজো। কিন্তু প্যাঁচাটা পা বাড়িয়ে চুম্বকের মতো সেটা ধরে ফেলল। নির্লিপ্ত, নির্বিকার সে। কোথায় পালাবে, উল্টে ঘরের মেঝেতে নেমে এল! ততক্ষণে ঠাম্মি তোজোর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তোজোকে বললেন, 'প্যাঁচা লক্ষ্মীর দূত। তার লগে এমন করিস না। ভাল হইব না।'
প্যাঁচা ঘরজুড়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল। কী যেন খুঁজছে। এবার সরাসরি তোজোর দিকে চাইল। চাহনির অর্থ, কিছু বলতে চাইছে। তোজোও সোজা প্যাঁচার দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই তোজোর বিস্মিত হওয়ার পালা। এ কী দেখছে সে? প্যাঁচার দুচোখে ভুরভুরিলালকে দেখা যাচ্ছে। তোজোকে আরও অবাক করে প্যাঁচা মানুষের গলায় বলে উঠল, 'ছিঃ কিংশুক। স্কেলটা কিনতে বুঝি পয়সা লাগেনি যে ওটা ছুঁড়ে মারলে! পেনটা আমিই ভুরভুরিলালের নির্দেশে মুখে করে নিয়ে গিয়েছি। আমি দুঃখিত। কিছু করার ছিল না আমার।' তোজো বলল, 'তাহলে এখন কি আমায় সহানুভূতি জানাতে এসেছ?' প্যাঁচা বলল,' মন দিয়ে শোনো, যা বলছি। আমি কোথায় যাই, নজর রাখতে ভুরভুরিলাল আমার পায়ে চিপ বসিয়ে দিয়েছে। মাথায়ও চিপ আছে যাতে চাইলে সব কথা রেকর্ড করতে পারি। পায়ের চিপটা খুলে কোথায় পড়ে গিয়েছে। এই সুযোগে দেখে নাও, ভুরভুরিলাল কী করছে?'
প্যাঁচার চোখে তাকিয়ে তোজো হাঁ হয়ে ভুরভুরিলালের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগল। সে দেখল, চেয়ারে বসা ভুরভুরিলালের হাতে তার সোর্ড পেনটা। মাথার পিছনটা হাতের চাপড় মেরে খুলে ফেললেন ভুরভুরিলাল। মাথার পিছনে অনেকগুলো বাক্সের মতো ঘর! ভিতরে অজস্র তার, স্ক্র। একটা ঘর থেকে একটা চিপ বের করে পেনটা খুলে সেটা ঢুকিয়ে দিলেন। আর পেন থেকে একটা চিপ বের করে নিজের মাথার পিছনের একটা খোপে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর আবার চাপড় মারতেই মাথার পিছনটা জুড়ে গেল। মানুষের মাথা এমন হয় নাকি? এরপর ভুরভুরিলাল একটা খাতা টেনে নিয়ে বললেন, ‘জয় সিয়ারাম, জয় বজরংবলি!’ পেনটা আপনা থেকে লিখে চলল সে কথা। আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন ভুরভুরিলাল। অপারেশন সাকসেসফুল।
তোজো প্যাঁচাকে জিজ্ঞাসা করল, 'এমন কেন করছেন ভুরভুরিলাল? কী চান উনি?' প্যাঁচা বলল, 'আসলে ভুরভুরিলাল এক অদ্ভূত, খাপছাড়া চরিত্রের লোক। স্ত্রী প্রয়াত, একমাত্র ছেলেটাও একা একা থাকে। উনি দোকান সামলান, বাকি সময়টা যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। ওনার বিশ্বাস, একদিন পৃথিবীতে মানুষের কোনও কাজ থাকবে না, মানুষ শুধু নির্দেশ দেবে, যন্ত্রই সব করে দেবে। এখন যেমন রোবট রেস্তরাঁয় খাবার সার্ভ করে, হাসপাতালে সার্জারি পর্যন্ত করে, যদিও তাকে প্রোগ্রামিং করে চালাতে হয়, আগামী দিনে সেটারও প্রয়োজন হবে না। যন্ত্রই সমস্যার সমাধান করে দেবে। মানুষের জায়গা নেবে। যন্ত্রই হবে সর্বশক্তিমান। উনি এমন একটা যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করছেন। তোমার যে সোর্ড পেনটা উনি কব্জা করেছেন, তার আরও ক্ষমতা বাড়াতে চান। দেখলে না, নিজের মাথা থেকে কেমন চিপ খুলে পেনে ঢোকালেন। তারপরই পেন যেমন শুনল, তেমনই লিখে দিল। আর এই যে আমি কথা বলছি, সে তো ভুরভুরিলালের খেলা। আমার গলায়ও চিপ বসানো আছে।'
তোজো বলল, 'তবে তো মারাত্মক ব্যাপার ঘটতে চলেছে। মানুষের চেয়ে যন্ত্র বড় হবে নাকি?' ঠাম্মি বললেন,'মানুষ চুপ কইরা যন্ত্রের কথা মতো চলব! সে কী রে বাবা! তাইলে তোদের স্কুলে কি যন্ত্ররা পড়াইব?'
প্যাঁচা বলল, 'সব তো দেখলে। আমি এখন যাই। দেরি হলে আমায় সন্দেহ করবে ভুরভুরিলাল। আবার আসব।'
তোজো ফোন করল দীপ্র, শুদ্ধ, সৌম্যকে। পেনের ঘটনাটা সবিস্তার বলল। ওরা তোজোকে বলল, 'ভুরভুরিলালের কাণ্ডকারখানা স্বচক্ষে দেখতে ওর বাড়িতে হানা দিলে কেমন হয়!'
প্যাঁচার কাছ থেকে তোজো শুনল, ভুরভুরিলালের শরীর ভাল যাচ্ছে না। পেনের চিপটা মাথার ভিতরে ঢোকানোর পর থেকে বুকে ব্যথা অনুভব করছেন। এটা আগে হোত না।
সামনের বড়দিনে ভুরভুরিলালের জন্মদিন। ঠিক হল, ওরা গোলকলালের বন্ধু পরিচয়ে ভুরভুরিলালের বাড়ি যাবে, তাঁকে ফুল-মিষ্টি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। তোজো ধরা পড়ে যেতে পারে, তাই সামনে থাকবে না। তবে ঠাম্মিকে সে রাজি করাল, তিনি অভিভাবক হিসাবে দীপ্র, শুদ্ধ, সৌম্যদের সঙ্গে যাবেন।
প্যাঁচা পরে এসেছিল। তাকেও তোজো সব জানিয়ে রাখল।
বড়দিনের সকালে ঠাম্মিকে সঙ্গে নিয়ে ভুরভুরিলালের বাড়ির দরজার বেল টিপল ওরা। হাতে মিষ্টির বাক্স, বেশ কয়েকটা গোলাপ দেওয়া রজনীগন্ধার মালা, মিও আমোরের কেক। তোজো গলির মুখে অপেক্ষায় রইল। দূর থেকেই ওরা শুনতে পেয়েছিল, বাড়ির ভিতর থেকে হারমোনিয়াম, বাঁশি, গিটারের শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই ভুরভুরিলালের জন্মদিনে গানবাজনার তোড়জোড় হচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদেই যে দরজা খুলল, তাকে দেখে চমকে উঠল দীপ্ররা। সামনে দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত এক রোবট। তারপরই এক অদ্ভূত কাণ্ড। রোবট জুলজুল করে তাকিয়ে কেকের বাক্সের দিকে। বলতে গেলে, ওদের হাত থেকে ছিনিয়েই নিচ্ছিল বাক্সটা। কোনওমতে সেটা আড়াল করে দীপ্ররা ওর হাতে গুঁজে দিল একটা মালা। গোলাপ, রজনীগন্ধার সুগন্ধে মাতোয়ারা রোবট যেন ভুলেই গেল কিছু অচেনা লোকজন ভিতরে চলে এসেছে। এই সুযোগে ছদ্মবেশে থাকা তোজোও ভিতরে ঢুকে পড়ল। বাইরের বসার ঘরের দৃশ্যে ওদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! হারমোনিয়াম, বাঁশি, গিটার সহযোগে 'হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ' প্র্যাকটিস করছে কতগুলি অদ্ভূত চেহারা। এরা কি ভিনগ্রহী? মাথাগুলো বাক্সের মতো, তার ওপর অ্যান্টেনা। চোখ থেকে বেগুনি রশ্মি বেরচ্ছে। দীপ্রদের দেখে বাজনা থেমে গেল। ওদের নজর তখন মালা, কেকের বাক্সের দিকে। বেঁটে চেহারার একটা যন্ত্র টলোমলো পায়ে এগিয়ে এল। রজনীর মালার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। পিছনে ঘুরে হাত দেখিয়ে ইশারা করল বাকিদের। ওরাও সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর রজনীর মালাগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। ততক্ষণে সেখানে হাজির রোবটও। সে ওদের ঠেলে সরাতে গেল। ওরাও নড়বে না। রোবটের সঙ্গে ওদের রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি শুরু হল।
ধস্তাধস্তির শব্দে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন ভুরভুরিলাল। চিত্কার করে উঠলেন, 'কেয়া হো রহা হ্যায়?' আর তখনই তাঁর চোখাচোখি হয়ে গেল দীপ্রদের সঙ্গে। 'তুম লোগ! ইহা কিউ!' ঠাম্মি এগিয়ে গিয়ে বললেন, 'এই বাচ্চারা আপনার ছেলের স্কুলের সহপাঠী। আপনার জন্মদিন আজ। আপনাকে মালা, কেক-মিষ্টি দিয়ে উইশ করতে এসেছে। তো কেক কাটবেন তো?' 'হাঁ, হাঁ, জরুর।'--- খুশিতে ডগমগ ভুরভুরিলাল। 'আপনার ছেলে কোথায়? ওকে ডাকুন!' বলল ঠাম্মি। কিন্তু ভুরভুরিলালের যেন সেদিকে খেয়াল নেই। ছেলেকে ডাকলেনই না। কেন কে জানে? রোবট গটগট করে হেঁটে দেশলাই, মোমবাতি জোগাড় করে নিয়ে এল। টেবিলে কেক সাজিয়ে মোমবাতি জ্বালাল। ওদিকে বাক্সওয়ালা মাথাগুলোও যে যার যন্ত্র নিয়ে তৈরি। ওরা গান ধরবে। ভুরভুরিলাল ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে কেক কেটে রোবটকে খাওয়াতে গেলেন। কিন্তু ছুটে এসে তাঁর হাত থেকে কেকের টুকরো ছিনিয়ে নিল একটা বাক্সওয়ালা মাথা। বাকি কেকটা নিয়ে টানাটানি শুরু হল ওদের মধ্যেই। রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ। ভুরভুরিলাল সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে একটা কৌটো এনে কিছু ওদের গায়ে স্প্রে করে দিতেই সবাই নেতিয়ে পড়ল। এই হট্টগোলের মধ্যেই প্যাঁচার সিগন্যাল পেয়ে তোজো আর আরেক বন্ধু ওপরে উঠে গেল।
ভুরভুরিলালকে ঠাম্মি বললেন, 'তাহলে হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হবে কী করে?' ভুরভুরিলাল বললেন, 'থোড়া টাইম দিজিয়ে। সব ফির জাগ জায়েগি।' রোবট একটু করে কেক মুখের সামনে ধরতেই সম্বিত ফিরল ওদের। সবাই মিলে কেক খেতে খেতে 'হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, ভুরভুরিলালজি' গেয়ে উঠল। এবার স্বয়ং ভুরভুরিলাল গান ধরলেন, 'আগুনের পরশমনি, ছোঁয়াও প্রাণে.....এ জীবন পূণ্য করো।' কিন্তু বাবার জন্মদিন সেলিব্রেট করা হলো, আর ছেলেই নেই! ভুরভুরিলাল সাফাই দিলেন, 'ও স্টাডিমে হ্যায়। অর আপ সব লোগ তো হ্যায়। ইয়ে লোগ (রোবট ও বাক্সওয়ালা মাথারা) ভি হ্যায়।'
ততক্ষণে তোজো আর এক বন্ধু ভুরভুরিলালের ঘরে ঢুকে দেখে গোলকলাল সেই সোর্ড পেন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। সর্বনাশ! ও নিশ্চয়ই ভুরভুরিলালের নজর এড়িয়ে পেনটা সরিয়েছে। তোজোরা আলমারির পিছনে লুকিয়ে পড়ল। প্যাঁচা চালাকি করে গোলকলালকে বলল, 'তোমার বাবা নিচে ডাকছে। কেক খাবে না? সব তো শেষ হয়ে গেল বোধহয়।'
একথা শুনেও গোলকলালের তেমন ভাবান্তর হল না। বলল, 'বাবা তো আমায় একবারও ডাকল না! সারাদিন তো শুধু রোবট আর ওই বিদঘুটে দেখতে যন্ত্রগুলিকে নিয়ে থাকে।' প্যাঁচা মিথ্যে বলল, 'কই আমাকেই তো পাঠাল তোমায় ডেকে নিয়ে যেতে। যাও, যাও, এরপর আর কেক পাবে না!' 'তাই নাকি!' বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গোলকলাল। সেই সুযোগে প্যাঁচা পেনটা তুলে নিয়ে তোজোর হাতে দিয়ে বলল, দরজার পিছনে সিঁড়ি আছে। ওদিক দিয়ে পালাও। আমি এদিকটা সামলে নেব।
ভুরভুরিলালকে কেক-টেক খাইয়ে ঠাম্মি, দীপ্ররা বেরিয়ে এসেছে। তোজোও পেনটা যত্ন করে লুকিয়ে এনে বাড়ি ঢুকে পড়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভুরভুরিলাল পেন খোয়া গিয়েছে জেনে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়েছেন। তোজো অপেক্ষা করছে, কতক্ষণে প্যাঁচা রিপোর্ট নিয়ে আসে।
বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে প্যাঁচা তোজোর জানালায় হাজির। গম্ভীর মুখে বলল সে, পেন খোয়া গিয়েছে, টের পেয়ে ভুরভুরিলাল সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজছেন। তার চোখে তাকিয়ে দেখা গেল, রোবট, বাক্সওয়ালা মাথাদের ধরে ধরে ঝাঁকাচ্ছেন তিনি। 'বল, তোরা থাকতে কী করে পেনটা খোয়া গেল? জবাব দে।' তবে ওরা বেশিক্ষণ সহ্য করল না। পাল্টা সবাই মিলে ভুরভুরিলালকে আক্রমণ করল। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে ভুরভুরিলালের মাথার পিছনের ঘরগুলি আচমকা খুলে কয়েকটা চিপ পড়ে যেতেই তাঁকে টলতে দেখা গেল। সঙ্গে তীব্র আর্ত চিত্কার। তিনি পড়ে গেলেন। ছুটে গেল গোলকলাল। 'পিতাজি', 'পিতাজি' বলে কান্না। রোবট, বাক্সওয়ালা মাথারাও হকচকিয়ে গিয়েছে। ভুরভুরিলালের কি খারাপ কিছু হল? গোলকলাল বাবার চোখেমুখে জল ছেটাল। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ নেই।
প্যাঁচা তোজোকে বলল, আমি এবার আসি। দেখি, ভুরভুরিলালকে সুস্থ করে তুলতে পারি কিনা। তোমার সোর্ড পেনটা রেডি করে রাখো। আমি ফিরে গিয়ে ভুরভুরিলালকে দাঁড় করিয়ে কথা বলাতে পারলে তা পেন খাতায় লিখে দেবে।
তোজো পেনটা আলমারি থেকে বের করে খাতা খুলে বসল। কিছুক্ষণ বাদেই কলমটা নড়ে উঠল। দেখা গেল, খাতার পৃষ্ঠায় ফুটে উঠছে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লাইভ কথা।
ভুরভুরিলাল বলছেন, পোষা প্যাঁচা ফিরে এসে মাথার চিপগুলি লাগিয়ে না দিলে হয়তো বাঁচতাম না। সোর্ড পেনটা জেদের বশে নিয়ে আসার পর থেকেই শরীরে নানা সমস্যা হচ্ছে। ওটা কিংশুকবাবুকে তুই ফিরিয়ে দিয়েছিস, তাই হোক। ওটার আসল মালিক যে, তার কাছেই থাকা উচিত। তাছাড়া পেনটায় রহস্য আছে। তা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল।
আর দুর্ভাবনার অবকাশ রইল না, নিশ্চিত হল তোজো। ভুরভুরিলাল আর তার সোর্ড পেনের দিকে হাত বাড়াবেন না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন