ছেলেটিকে আমি চিনতে পারলাম। দিন কয়েক আগে জ্বলন্ত বইমেলার স্টল থেকে তাকে বই বাঁচাতে দেখেছি।
![]() |
কলকাতা বইমেলা। ২০২৪। বইতন্ত্র। |
আকাশ: ময়দানের কলকাতা বইমেলা বসছে ১৯৭৬ সাল থেকে। তবে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের বিপরীতে বসত পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা। ১৯৮০ সালে এই পৃথক মেলার আয়োজন করা হয়। আয়োজক ছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিক্ষা দফতর। প্রথম ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা’ শুরু হয় পার্ক সার্কাস ময়দানে। পরে সেটা সরে আসে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের উল্টোদিকের মাঠে; যা এখন ‘মোহরকুঞ্জ’ নামে পরিচিত। লোকমুখে এটি হয়ে ওঠে ‘সরকারি বইমেলা’। তবে কলকাতা বইমলার তুলনায় সে গ্রন্থমেলা ছিল বহরে অনেক ছোটো।
’৯২-এর গ্রন্থমেলা। আমি তখন প্রথমবর্ষের ছাত্র। বন্ধুরা মিলে এক দুপুরে গ্রন্থমেলায় গিয়েছি। ভীড় হালকা। চোঙা মাইকে কিশোর কুমারের রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। আমরা জনাকয়েক এ স্টল থেকে স্টল উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ছাড়া স্কুলের বইয়ের বাইরে পড়াশোনা বলতে ততদিনে চাঁদমামা, শুকতারা আর স্বপনকুমার সিরিজ। সেই আমার প্রথম একলা যাওয়া বইমেলা। অবাক চোখে দেখছিলাম চারদিক।
একটি স্টলে বই দেখছিলাম, হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাশের জন একটু যেন উসখুশ করছে। চোখাচোখি হতে ইশারায় আমাকে আড়াল হয়ে দাঁড়াতে বলল সে। চোখের পলকে বইয়ের তাক থেক একটা ‘শেষের কবিতা’ তুলে নিয়ে কাঁধের শান্তিনেকতনী ব্যাগে পুরে নেওয়া হল। নাম বলব না, আজ বিখ্যাত লেখক আমার সেই বন্ধু।
চুরি বিদ্যা, মহা বিদ্যা...। কিন্তু বই চুরির বিদ্যা হল মহাবিদ্যা। বই চোর আমাদের লেখককুলের অহংকার। তিনিই তো প্রমাণ করেন বই কত বড় সম্পদ। যিনি বই চোর, তিনি শিক্ষিত। শুধু তাই নয় তাঁর কাছে বইটি অর্থবহ। এবং, সেটি এতটাই যে তার জন্য তিনি বইটি যেনতেনপ্রকারেন হস্তগত করতে মরিয়া। সেই বইয়ের জন্য তিনি নাও নিয়ে সমুদ্র পারি দিতে পারেন। শৃঙ্গে চড়তে পারেন। মধ্যরাতে ফুলশয্যায় নববধূকে ছেড়ে অরক্ষিত লাইব্রেরিতে হানা দিতে কুণ্ঠিত হন না।
বইচুরিকে কখনও চুরির মতো অপরাধের তালিকায় ফেলা হয় না। বরং তাঁর প্রতি সমাজ সহানুভূতিশীল।
১৯৯৭। কলকাতা আন্তর্জাতি বইমেলা। ময়দান।
সাংবাদিক হিসাবে সে বছর প্রথম একটি দৈনিকের হয়ে বইমেলা কভার করার দায়িত্ব পেয়েছি। তখন ভীষণ উৎসাহ আমার। বেলা একটাতেই বইমেলায় ঢুকে যা-ই। আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের দেওয়া পাস রয়েছে পকেটে। সারা বইমেলা টো-টো করে ঘুরে বেরাই খবরের খোঁজে। মাঝে-মাঝে গিন্ডের প্রেস কর্নারে ঢুকে বিনে পয়সার চা খাই। অস্থায়ী বাথরুমের ঘেরা জায়গায় ঢুকে বিড়ি ফুঁকে নিই। সারাদিনের খবর আর রাত আটটায় গিল্ডের প্রেস কনফারেন্সে দেওয়া তথ্য নিয়ে অফিসের দিকে রওনা হই।
এমন একদিন মেলা শেষে বেরোচ্ছি, দেখলাম বইমেলার নিরাপত্তারক্ষীরা এক ‘বইচোর’কে ধরেছে। গালে খোঁচা দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, ট্যাংট্যাঙে চেহারার এক যুবককে ধরেছে। সে নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে হাতজোড় করে কাকুতি-মিনতি করছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বারবার বলছে যে সে বই চুরি করেনি।
ছেলেটিকে আমি চিনতে পারলাম। দিন কয়েক আগে জ্বলন্ত বইমেলার স্টল থেকে তাকে বই বাঁচাতে দেখেছি। আমি কাছে গিয়ে ব্যপারটা জানতে চাইলাম। নিরাপত্তারক্ষীরা কিছু বলার আগেই ছেলেটি আমাকে দেখে ভরসা পেয়ে বলতে লাগল, “দাদা আমি বই চুরি করিনি। বন্ধ গেটের কাছে বইটা পড়ে থাকতে দেখে ভিতরের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম, যাতে কেউ নিয়ে না নেয়।”
সে দফায় একটা মিটমাট হয়েছিল। ছেলেটির কাছে বিল না থাকা কোনও বই না মেলায় তাকে ছেড়ে দিয়েছিল নিরাপত্তারক্ষীরা। সে বার বইমেলা পুড়ে যাওয়ার দিন তিনেক পরেই সাজসজ্জাহীন আরেকটা বইমেলা দাঁড় করানো হয়েছিল রাজ্য সরকারের সহায়তায়।
পরের বছর গিল্ড একটি ব্যবস্থা করেছিল। বই চুরি ধরা পড়লে ‘চোরকে’ একটি বই সংক্রান্ত রচনা লিখতে হবে। কোনও চোর ধরা পড়েছিল কিনা জানি না। কিংবা আজ আর মনে নেই।
শুনলাম, এবার বইমেলায় নাকি একশ্রেণির দুর্বৃত্তের উদয় হয়েছে। তারা কম দামি বই বেছে বিলিং কাউন্টারে গিয়ে পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছে দাবি করে ব্যালান্স ফেরত নিচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে কোনও তর্ক-বিতর্কের সুযোগ থাকছে না, বা সব প্রকাশকের স্টলে সিটিটিভি ক্যামেরা বসানোর সামর্থ না থাকার কারণে তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এরা বইচোর থেকে আলাদা।
আরও শুনলাম এবার নাকি বইমেলার স্টল থেকে নাকি সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে লেখা বইয়ের একটি কপি চুরি হয়ে গিয়েছে। তাতে যারপরনাই সন্তোষপ্রকাশ করেছেন সুমনবাবু। আহ্লাদিত লেখক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, "বেশ করেছে। আমার বইটি মেলায় ভালোই বিকোচ্ছে এই সুসংবাদের চেয়েও বইচুরির ঘটনাটি শুনে আমি বেশি আহ্লাদিত হয়েছি। ধরা না পড়লে চৌর্যবিদ্যা বরাবরই মহাবিদ্যা হিসেবে স্বীকৃত। বই-চুরি আরও মহা-মহাবিদ্যা বলে আমার মনে হয়।"
সুমানবাবুর পোস্টের একটি অংশ এখানে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। তিনি লিখেছেন, "ঘটনাটি শোনার পর থেকেই ‘দ্য বুক থিফ’ উপন্যাসটির মর্মন্তুদ কাহিনী আমার মনে পড়ে গেল। সেই বাচ্চা জার্মান মেয়েটির কথা, নাৎসি জমানায় যে বই চুরি করতে করতে একদিন লিখিত শব্দের প্রেমে পড়ে গেল, শেষ অবধি নিজেই হয়ে উঠল লেখক। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে পালানোর সময় তার আত্মজীবনীর পান্ডুলিপিটি সে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারল না। বহু বছর পরে অস্ট্রেলিয়ায় পরিণত বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার মুহূর্তে যমরাজ স্বয়ং এসে তাকে ফিরিয়ে দিল সেই পান্ডুলিপি।"
কিন্তু সব বই চোর কি শব্দকে এমন ভালবাসতে পারেন?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন