পেল্লায় স্টলের বাইরে কাচ ঘেরা শো-কেস। তাতে ১০০১ আরব্য রজনীর এক নারী চরিত্র। তার টানে উপচে পড়ছে ভিড়।
![]() |
কলকাতা বইমেলা। ২০২৪। বইতন্ত্র। |
তখন কলকাতা বইমেলা বসত ময়দানে। তোরনে থাকতো লোহার কোলাপসিবল গেট। পাশে দশ-বারোটা টিকিট কাউন্টার। কাউন্টারে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে টিকিট কিনে সেই গেটের ফাঁক গলে বইজগতে প্রবেশ করতে জানুয়ারি শেষের ঠান্ডাতেও বইপ্রেমীদের (!) গলদঘর্ম হতে হত। সেবার কলকাতা বইমেলায় একটা ঘটনা ঘটল। আরব্য রজনী সিরিজের সম্ভার নিয়ে বইমেলায় হাজির কলকাতার এক নামি প্রকাশন সংস্থা। মুখে-মুখে প্রচারেই হইচই কাণ্ড। পেল্লায় স্টলের বাইরে কাচ ঘেরা শো-কেস। তাতে ১০০১ আরব্য রজনীর এক নারী চরিত্র। তাকে দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সব বয়সের পুরুষ পাঠক (পড়ুন দর্শক)। কৌতূহলী মহিলারা স্টলের সামনে দিনে যাওয়ার সময় আড়চোখে দেখে যাচ্ছেন। অন্য প্রকাশকদের (যাঁরা নিজেদের মূলধারার প্রকাশক বলে দাবি করতেন) কপালে ভাঁজ দেখা গেল। এই আরব্য নারী তাদের ক্রেতা টেনে নিচ্ছে। সেইসব প্রকাশকরা মিলে নালিশ জানাল ‘স্বনিয়ন্ত্রিত’ আয়োজক সংগঠনকে। অতঃপর, আয়োজক সংগঠন সেই প্রকাশনী সংস্থাকে মডেল তুলে নিতে বলল। প্রকাশন সংস্থাকে সেই নির্দেশ মানতেও হল।
‘খবরে’ হতাশ সেই সব বইপ্রেমী, যারা বইমেলার ফার্স্ট হাফ মিস করেছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, তাতে কিন্তু ওই প্রকাশনীর বইগুচ্ছ নিয়ে পাঠকের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমল না। অদেখা, গোপন কাম-দুনিয়ার অমোঘ আকর্ষণে পাঠকের দুর্নিবার স্রোত তখন রুধিবে কে? পঞ্জিকার পাতায়-পাতায় কাম-কলা সিরিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন তখন ম্লান, ফুটপাথে হলুদ সেলোফেনে মোড়া চটিবইও মহাপ্রস্থানের পথে। আর কার্ডবোড বাঁধাইয়ে ঝকঝকে ছাপা লেখা-ছবিতে রগরগে ‘কাম-সাহিত্য’ তখন অভিজাত পাঠকের হাতে উঠতে ব্যাকুল।
এটাও ঠিক, হয়তো সে সময়টাও ছিল যৌনতা নিয়ে বাঙালি পাঠকের রক্ষণশীলতা ভাঙার সময়। একটা মৌসুমী বায়ু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের শ্বেতশুভ্র দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিল সেই বইমেলায়। সবাই ভিজেছিল সেই বৃষ্টিতে।
বহু কাল আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যে আদিরসের অভাব নেই। তবে উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় পাঠকের রুচি বদলে যায়। তা বহমান থেকেছে সুদীর্ঘ সময় ব্যাপী। এমনকী, বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নেও বাংলা সাহিত্যে যৌনতা গড় পাঠকের কাছে প্রত্যাশিতও নয়, প্রশংসিতও নয়। কিন্তু, প্রায় আড়াই দশক আগের ওই বইমেলা যেন বাঙালি পাঠকের রুচির একটা দিকনির্দেশ ছিল।
বইমেলার শেষদিকে একদিন সেই প্রকাশনির প্রায় বিধ্বস্ত স্টলে ঢুঁ-মারতে ঢুকলাম। ততদিনে ভীড় খানিকটা পাতলা হয়েছে। তবে দু’দিন আগের অগাধ ভীড়ের ছাপ সর্বত্র। প্রকাশনী একটি বইয়ের সঙ্গে ফ্রি রঙিন অ্যালবাম দিচ্ছিল। আমার পাশে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ় ভিড়ের মধ্যেই টেবিল থেকে সেই বইয়ের শেষ ক’টা পাতা উল্টে আবার রেখে দিলেন। এদিক-সেদিক চেয়ে এবার বিপরীতে দাঁড়ানো সেলসবয়কে বললেন, “দাদা, অ্যালবামটা কেমন একবার দেখা যেতে পারে?”
সেলসবয় বিরক্তি চেপে রেখে বললেন, “না, দেখা যাবে না। বইটা কিনলে তবেই সেটা দেওয়া হবে।”
প্রৌঢ় ভদ্রলোক হতাশ হয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে যেতে সেলসম্যান গজগজ করতে থাকলেন, “আচ্ছা লোক, রোজ এসে এসে পুরো বইটা পড়ে নিল, আবার ফ্রিতে আলব্যামটাও দেখতে চাইছে...।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন