অদৃশ্য জলদস্যুর কবলে

হ্যাকাররা কম্পিউটার সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। লিখছেন দ্বৈপায়ন কর 

অদৃশ্য জলদস্যুর কবলে

জলদস্যু নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে কত সব সৃষ্টি। পৃথিবীতে সম্ভবত এমন কোনও ভাষা নেই, যে ভাষায় জলদস্যুদের নিয়ে কোনও অ্যাডভেঞ্চার গল্প-উপন্যাস লেখা হয়নি। হাড় হিম করা তাদের অভিযান। নাবিকদের দুঃসাহসিক প্রতিরোধ। রক্ত আর মৃত্যু। সেই সব সাহিত্যের সব কাল্পনিক নয়, কিছু কিছু ইতিহাস নির্ভর। হতে পারে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঘটনাবলি অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সম্ভবত ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের সময় সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসারতার সময়টিই ছিল জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ। দাপট কমলেও আজও সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে জলদস্যুর ভয়াল সম্পর্ক রয়েই গিয়েছে।

গত ১২ মার্চ ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর দখল নিয়েছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তারপর থেকেই ফের আলোচনায় জলদস‌্যুদের কার্যকলাপ। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের বিষয়টি গল্প-উপন‌্যাসের অ‌্যাডভেঞ্চারের চাইতেও বেশি রোমহর্ষক। সোমালিয়ার জলদস‌্যুদের বাংলাদেশী জাহাজ দখল সাবেক পদ্ধতিতেই। অর্থাৎ, দ্রুতগতির ছোট বোট নিয়ে ঘিরে ধরে জাহাজে জলদস্যুদের অনুপ্রবেশ। তবে যুগের সঙ্গে জলদস্যুদের জাহাজ লুঠের পদ্ধতি বদলেছে। অনেকক্ষেত্রেই এখন তাদের মূল অস্ত্র অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি।

বছর কয়েক আগের ঘটনা। সাইবার কিল নামের একটি সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংস্থা একটি মাঝারি মাপের জাহাজ পরিবহণ সংস্থার ই-মেল আদানপ্রদান সংক্রান্ত একটি গরমিলের তদন্ত করছিল। সেই সময় একটি বিরাট জালিয়াতি তাদের নজরে আসে। দেখা যায়, কেউ একজন সংশ্লিষ্ট সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেমে একটি ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে কোম্পানির অর্থ বিভাগের যে কোনও ই-মেল তারা খুলে দেখতে পারছে। এই জাহাজ সংস্থা যাদের কাছ থেকে জ্বালানি কেনে, তাদের যখন জ্বালানির বিল পরিশোধ করছে, সেই বিল তাদের অ্যাকাউন্ট নম্বরে না গিয়ে অন্য অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে। তদন্তে দেখা যায়, ওই ভাইরাসটিই এই কাজটি করছে। লেনদেনের সময় ভাইরাসটি অ্যাকাউন্ট নম্বর বদলে দিচ্ছে। হ্যাকারদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া অ্যাকাউন্ট নম্বরে জমা হচ্ছে টাকা। এইভাবে কয়েক মিলিয়ন ডলার হ্যাকাররা সরিয়ে নেওয়ার পর বিষয়টি ওই জাহাজ সংস্থার নজরে আসে। কেবল মাঝারি মাপের জাহাজ সংস্থাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ সংস্থাগুলির অন্যতম, ডেনমার্কের মায়েরস্ক এরকম হ্যাকিং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সেই সময় হ্যাকার হানায় তাদের মুনাফার অন্তত ৩০০ মিলিয়ন ডলার হারাবে বলে আশঙ্কা করে সংস্থাটি।

সাইবার সুরক্ষা সংস্থাগুলির আশঙ্কা, হ্যাকাররা চাইলে জাহাজ চলাচলের মতো ব্যাপারেও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। একটি জাহাজ সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাক করতে পারলে বিস্তর স্পর্শকাতর তথ্য হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব।

ইতিমধ্যে এমনই একটি ঘটনার কথা জানাজানি হয়েছে। জলদস্যুরা একটা বড় জাহাজ সংস্থার নেটওয়ার্ক হ্যাক করে জানার চেষ্টা করছিল যে জাহাজে তারা ডাকাতির পরিকল্পনা করছে সেটাতে কী পণ্য পরিবহণ হচ্ছে। একজন সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, সেটি জানা থাকলে জলদস্যুরা একটি জাহাজে উঠে বারকোড দেখেই বুঝে যাবে কোন কনটেনারে কী পণ্য আছে। তখন তারা অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের প্রয়োজনের পণ্যগুলি নিয়ে কেটে পড়বে।

জাহাজ চলাচল এখন পুরোপুরি কম্পিউটার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কেবল পণ্যবোঝাই কনটেনার নয়, পুরো জাহাজটাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। একটি জাহাজের কম্পিউটার ব্যবস্থা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সেটিকে আর চালানো যাচ্ছিল না। ইলেকট্রনিক চার্ট ডিসপ্লের মতো স্পর্শকাতর নেভিগেশন সিস্টেম করাপ্ট হয়ে পড়েছিল। এমন আশঙ্কা বাড়ছে যে হ্যাকাররা কম্পিউটার সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। হ্যাকাররা জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেমও হ্যাক করার চেষ্টা করছে। এমনকী, তারা নেভিগেশন সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ দখল করে একটি জাহাজ যেখানে আছে, সেখান থেকে অনেক দূরের কোনও স্থানে এটি অবস্থান করছে বলে দেখাতে পারে। অর্থাৎ, ট্রাফিক কন্ট্রোলে ভুল তথ্য যাবে। জাহাজটি বিপদে পড়লেও প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবে না। বতর্মানে বিশ্বে প্রায় ৫১ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ আছে। সেগুলি বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ পরিবহণ করে। সেই কারণেই হ্যাকাররা এই জাহাজ চলাচল ব্যবস্থাকে টার্গেট করেছে। তবে এবার তারা অদৃশ্য।
ছবি- একটি হলিউড ছবির স্থিরচিত্র




Post a Comment

Previous Post Next Post