পরিবেশে মানুষ যত পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তার মধ্যে রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোর এই ব্যবহার সবচেয়ে নাটকীয়। আলোর দূষণ নিয়ে চিন্তার কথা শোনালেন দেবাশিস
আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে তারা গোনার দিন আর নেই। মনে করতে পারেন শেষ কবে রাতের আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অবসর মিলেছিল? মিললেও নক্ষত্রমালায় জ্বলজ্বল করা আকাশ কি দেখেছিলেন? আসলে কৃত্রিম আলোয় ক্রমশ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অন্ধকারের রোমান্টিকতা।
‘তমসো মা জে্যাতির্গময়’।
হ্যাঁ, আমাকে তুমি মননে, সংস্কারে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। কিন্তু আমি সেই গভীয় গহন অন্ধকারে নিবিষ্ট হতে চাই, যেখান থেকে আকাশে তারাদের আনাগোনা দেখতে পাব। কৃত্রিম এ আলো অপেক্ষা অন্ধকার অনেক শ্রেয়।
যদিও মিছেই এই আবদার। সভ্যতার সঙ্কট আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে রাতের অন্ধকারটুকুও। আর তার কঠিন প্রভাব পড়ছে জীবজগতে। রাতের পৃথিবীর উপর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে প্রত্যেক বছর কৃত্রিম আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাতে তোলা পৃথিবীর উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ গবেষকরা দেখেছেন, প্রতি বছর কৃত্রিম আলো দুই শতাংশেরও বেশি করে বেড়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃত্রিম আলোর বাড়বাড়ন্তে অনেক দেশেই রাতের অন্ধকার কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে গাছপালা, পশুপাখি অর্থাৎ পরিবেশ, এমনকী মানুষের উপরও। তাঁরা একে আলোর দূষণ বলেও উল্লেখ করছেন। এই গবেষণায় রাতের পৃথিবীর যেসব ছবি ও তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে নাসার একটি স্যাটেলাইট থেকে। রাতের আলোর উজ্জ্বলতা মেপে দেখার জন্যই ওই স্যাটেলাইটে রেডিওমিটার নামে বিশেষ একটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।
দীর্ঘ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোর এই তীব্রতা কিন্তু সব দেশে সমান নয়। তা দেশভেদে ভিন্ন। আমেরিকা ও স্পেনে আলোর তীব্রতা তেমনভাবে বাড়েনি। তবে বেশি কৃত্রিম আলো তীব্র হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ায়। এর পাশাপাশি আবার কোনও কোনও দেশে এই ঔজ্জ্বল্য কমেছে। যেমন ইয়েমেন বা সিরিয়া। আসলে দু’টো দেশই যুদ্ধে প্রায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে। কাজেই সেখানে নানা কারণে রাতের আলোর তীব্রতা কমেছে।
রাতের বেলায় তোলা পৃথিবীর উপগ্রহ চিত্র দেখতে খুব সুন্দর লাগে। রাতের উপকূল বা সমুদ্র সৈকতের ছবি, কিংবা মাকড়সার জালের মতো এলেমেলো শহরের রাস্তাঘাট, বাতি সেইসব ছবিতে উজ্জ্বল লাগে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর এই কৃত্রিম আলোর নেতিবাচক কিছু প্রভাব রয়েছে।
গবেষকদলটির প্রধান ক্রিস্টোফার কিবা বলছেন, পরিবেশে মানুষ যত পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তার মধ্যে রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোর এই ব্যবহার সবচেয়ে নাটকীয়। তিনি বলেন, “আমি আশা করেছিলাম যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং জার্মানির মতো ধনী দেশগুলিতে কৃত্রিম আলোর তীব্রতা কমবে। কিন্তু আমরা দেখছি, আমেরিকার অবস্থা একই রকম রয়ে গিয়েছে এবং ব্রিটেন ও জার্মানিতে কৃত্রিম আলো আগের চেয়ে আরও বেশি তীব্র হয়েছে।” বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের আলো ও রাতের অন্ধকারের দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে গাছপালাকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি ‘শর্ট ডে’ গাছ এবং অন্যটি ‘লং ডে’ গাছ। তিনি বলেন, রাতের আলোর দৈর্ঘ্য যদি কমে যায় তার উপর ভিত্তি করে গাছপালার ফুল ফোটার সময় এবং ঋতুর ধরনেও একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ে নিশাচর প্রাণীর জীবনযাপনের উপরও।
আমরা সভ্যতার একটি পর্বে এসে অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকময় করেছি। পরের পর্বে আলোকোজ্জ্বল করেছি। এর পরের পর্বে কৃত্রিম আলোর তীব্রতা কমানোই আমাদের সভ্যতার অগ্রগতি।
Image: Flickr
Post a Comment