হায়! হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা

বিশ্ব রাজনীতিতে ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ হোয়াইট হাউসে বছর চারেক আগে হঠাৎ ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়। ঘুম ছোটে কর্তাদের। ইঁদুর বৃত্তান্ত লিখলেন সেনবাবু

হায়! হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা

ঘটনাটি ৭০০ বছর আগের। ঘটেছিল জার্মানিতে। ছোট্ট, কিন্তু অগোছালো শহর হ্যামলিনে একবার ইঁদুরের ভয়ংকর উৎপাত শুরু হল। শহরের মানুষ অতিষ্ঠ তাদের জ্বালায়। রোগ-ব্যাধি মহামারীর রূপ নিয়েছে। চিন্তায় ঘুম ছুটেছে শহরের প্রশাসনিক কর্তাদের। কীভাবে মূষিকদের বাগে আনা যায়, তার আর পথ মিলছে না। শহরের মেয়র শেষমেশ ঘোষণা করে দিলেন, যে শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করবে তাকে মোটা অঙ্কের আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হবে। 

সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে হাজির হল রহস্যময় এক বঁাশিওয়ালা। দাবি করল, তার বাঁশির সুরে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করা সম্ভব। তার কথা শুনে তো সবাই অবাক। ব্যাটা বলে কী! পাগল নাকি? কিন্তু নিরুপায় হ্যামলিনবাসীর তাকে একটা সুযোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। শহরকে ইঁদুরমুক্ত করার জন্য বাঁশিওয়ালাকে আদেশ দিলেন মেয়র। সঙ্গে পুরস্কারের আশ্বাস। 

বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন বাঁশিওয়ালা। বড় অদ্ভুত সেই সুর। বাঁশি শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ইঁদুরগুলো। যেখানে যত ইঁদুর ছিল সবই বেরিয়ে এল বঁাশিওয়ালার মায়াবী সুরের টানে। বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলেছে সেই বাঁশিওয়ালা, তার পিছু পিছু চলেছে হাজারে হাজারে ইঁদুর। ওইভাবেই ইঁদুরগুলোকে নিয়ে গিয়ে ওয়েজার নদীতে ফেলে দিয়েছিল বাঁশিওয়ালা।

আমরা কলকাতায় হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে পাইনি। পেলে, সে হয়তো শহরের ইঁদুরগুলোকে তার মোহময় বাঁশির সুরে টেনে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিত। ক্যানাল স্ট্রিটের ডালের আড়ত, ঢাকুরিয়া ব্রিজের পিলার, কার্জন পার্ক, মহাকরণ থেকে ‘দুষ্টু ইঁদুর’গুলো লেজ নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এসে সলিলসমাধি নিত। আহা, সেটা হয়নি।

মহাকরণের কথা মনে পড়ল। শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটি তখন রাজে্যর সচিবালয়। একসময় সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল সেখানকার ইঁদুর। এক মন্ত্রী তো বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে ইঁদুর মারা বিষ মেশানো আলুর চপ নিয়ে এসেছিলেন আপিসে। তাতে কতটা কাজ হয়েছিল, সে গল্প অবিশ্যি গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে। তুলে আনতে সময় লাগবে।

তা বলে হোয়াইট হাউসে ইঁদুরের তাণ্ডব! বিশ্ব রাজনীতিতে ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ হোয়াইট হাউসে বছর চারেক আগে হঠাৎ ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আধিকারিকরা রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের কাছে ভবনটি নিয়ে বেশ কিছু সমস্যার কথা জানান। যার মধ্যে রয়েছে ইঁদুরের উপদ্রব। সেই কাগজটি উড়ে আসে ‘এনবিসি ওয়াশিংটন’-এর হাতে। তা তারা ফাঁস করে দেয়। সেখান থেকেই জানা গিয়েছে, হোয়াইট হাউসে নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের মেসে খাবার সরবরাহ করা হয় যে কিচেন থেকে, সেখানে এবং হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমেও ইঁদুর দেখা গিয়েছে। 

সে সময় আরও জানা যায়, হোয়াইট হাউসে ইঁদুরের উপদ্রব নতুন নয়। সাম্প্রতিক অতীতে ইঁদুর সমস্যার সমাধানের জন্য কয়েকশো অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ইউ এস জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএসএ) হোয়াইট হাউসের রক্ষণাবেক্ষণ কাজগুলির তদারকি করে। ইঁদুর তাড়াতে তার আধিকারিকদের কালঘাম ছোটে।

হোয়াইট হাউস এমনিতেই খুব পুরনো ভবন। এমন বাড়িতে ইঁদুরের আস্তানা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা কোন পদ্ধতিতে হোয়াইট হাউসকে ইঁদুরমুক্ত করবে, সেটাই মুখ্য। দু’টি পথ দেখতে পাচ্ছি। কলকাতা থেকে অবনী ঘোষের ইঁদুর মারা বিষ আমদানি করা যেতে পারে। দ্বিতীয়, হ্যামলিনের বঁাশিওয়ালার খেঁাজ।

‘বড় বাড়িতে’ ইঁদুরের উপদ্রবের আরও নজির আছে। বাদ নেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কেন্দ্রভূমি বাকিংহ‌াম প‌্যালেসও। বছর পাঁচেক আগে প্রাসাদে ইঁদুরের দৌরাত্বে‌্য নাকি অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন মহারানী  দ্বিতীয় এলিজাবেথ। প্রাসাদে ইঁদুরের উৎপাতকে রীতিমতো ‘ভীতিকর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন রানী। এরপরেই, প‌্যালেস থেকে ইঁদুর তাড়াতে পেস্ট কন্ট্রোলে খবর দেওয়া হয়। 

আম আদমির গেরস্থ আর প্রাসাদের ইঁদুরের চরিত্রে কোনও প্রার্থক‌্য নেই। তারাও পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে খাবারে মুখ দেয়। সেল্ফ থেকে বাসন-কোসন ফেলে দেয়। দৌড়া-দৌড়ি করে জানালা-দরজায় শব্দ করে। রাতের বেলা তো রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেয়। জানা যায়, ওই সময় ব‌্যতিব‌্যস্ত বাকিংহাম প‌্যালেস পেস্ট কন্ট্রোলের ব‌্যবস্থা ছাড়াও ইঁদুর মোকাবিলায় কিচেনের কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব‌্যবস্থা করে। বিশ্ব সাহিত্যে বহুবার ইঁদুরের উল্লেখ হয়েছে। তারমধ্যে জর্জ অরওয়েলের ‘লাইন্টিন এইট্টি-ফোর’, বিট্রিক্স পটারের ‘দ‌্য টেল অফ স‌্যামুয়েল হুইস্কারস’, রবার্ট সাউদির ‘গড’স জাজমেন্ট অন এ উইক্‌ড বিশপ’, জেমস হারবার্টের ‘দ‌্য র‌্যাটেস’, রবার্ট ব্রাইনিংয়ের ‘দ‌্য পাইড পিপার’ ইত‌্যাদি। 

তবে স‌্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস সিরিজের ‘দ‌্য অ‌্যাডভেঞ্চার অফ দ‌্য সাসেক্স ভ‌্যাম্পায়ার’-এর যে দৈত‌্যাকার ইঁদুরের বর্ণনা রয়েছে, সেটি অন‌্য কোনও লেখকের লেখায় মিলবে না। এখানে হোমস ওয়াটসনের কাছে মাতিলদা ব্রিগস এবং সুমাত্রার দৈত্য ইঁদুরের ঘটনাটি উল্লেখ করেন। গল্পের পটভূমির কারণেই আর্থার এই কাল্পনিক ঘটনাটির উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু, সেটিই পরবর্তীকালে অনেক লেখক এবং নাট‌্য অভিনেতা আলাদাভাবে এটিকে ব‌্যবহার করেছেন। যেমন, এডিথ মেইজার রেডিও সিরিজ দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ শার্লক হোমসের রেফারেন্সের উপর ভিত্তি করে একটি স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন । স্ক্রিপ্টটি ৯ জুন ১৯৩২-এ সম্প্রচারিত ‘দ্য জায়ান্ট র‌্যাট অফ সুমাত্রা’ শিরোনামের একটি পর্বে ব্যবহার করা হয়েছিল। একই শিরোনামের একটি পর্ব ১ মার্চ ১৯৪২ -এ একটি রেডিও সিরিজ ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চারস অফ শার্লক হোমস’-এও সম্প্রচারিত হয়েছিল।

Image: Wallpaper Flare

Post a Comment

Previous Post Next Post