বার্তা দিতে ভরসা সেই 'বাজারি' কাগজই

একেবারে সাদামাটা বিজ্ঞাপন, বামপন্থীদের সাবেক লিফলেটের আদলে। তবে অবশ্যই নজরকাড়া। লিখছেন রাখোহরি 

বার্তা দিতে ভরসা সেই 'বাজারি' কাগজই

নয়ের দশকে বাংলায় যখন বাম সরকারের প্রবল প্রতাপ, সেই সময় একমাত্র ‘গণশক্তি’ ও ‘কালান্তর’ ছাড়া 
বাকি চারটি দৈনিক সংবাদপত্রের ‘বুর্জোয়া’ কাগজ বা ‘বাজারি’ কাগজ বলেই প্রচার ছিল। বিশেষ করে, সিপিএম নেতাদের মুখে শোনা শব্দদুটি তখন বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের ছেলে-মেয়েদের মুখে-মুখে ঘুরতো। কলেজ-বিশ্ববিদ‌্যালয়েক ক‌্যান্টিন থেকে পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় ওই সংবাদপত্রগুলিকে তাচ্ছিল‌্য করা হত। ওইসব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের প্রতি ঘৃণা ও করুণা ঝড়ে পড়ত, যেন তারা পুঁজিপতি মালিকের পদতলে থাকা দাস।

কাট টু ৩১ মার্চ ২০২৪। আনন্দবাজার পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায় সিপিআই (এম)-এর একটি সোলাস বিজ্ঞাপনে অনেকেরই চোখ আটকে গিয়েছে। ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলির দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মধ্যে কোনও নতুনত্ব নেই। তবে সিপিআই (এম)-এর এই বিজ্ঞাপন যদি ‘বুর্জোয়া’, ‘বাজারি’ কাগজে ছাপা হয়, তা চমকে ওঠার মতো বিষয় তো বটেই। তবে কি সিপিআই (এম) এ ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করল? সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলবে, কোনও পার্টি কংগ্রেসে অনেক কাটাছেঁড়ার পর।

বাংলার প্রথম শ্রেণির দৈনিকে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বায়নটি এই রকম– এটা একটা বিজ্ঞাপন..... ঠাকা দিয়ে ছাপানো যায়। ইলেক্টোরাল বন্ডে যারা হাজার হাজার কোটি পেয়েছে তারা এরকম অনেক ছাপাবে। তাই ভাড়া করা বিজ্ঞাপন ছেড়ে, রুটি-রুজির লড়াইয়ে সঙ্গে থাকুন। এর নিচে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে প্রতিক লাল রঙে। এরপরে ছোট্টে স্লোগান– হক্‌ রুটি রুজি...জনতাই পুঁজি। একেবারে সাদামাটা বিজ্ঞাপন, বামপন্থীদের সাবেক লিফলেটের আদলে।

এই মুহুর্তে ইলেক্টারাল বন্ড নিয়ে জাতীয় রাজনীতি সরগরম। লোকসভা নির্বাচনের মুখে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ স্টেট ব‌্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) দেওয়া বন্ড-তথ‌্য নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। সেগুলি বিশ্লেষণের পর স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে শ’-হাজার কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে। এর ফলে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ‌্য সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কর্পোরেটের প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। কিন্তু, মমলা চলাকালীনই সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বামদলগুলি দাবি করেছে, তারা নীতির পরিপ্রেক্ষিতে এক পয়সা অনুদানও নির্বাচনী বন্ড মারফত নেয়নি। সিপিআই (এম), সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই-এমএল এই নিয়ে তাদের তথ্য পেশ করে সুপ্রিম কোর্টে। সেই তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে।

এবার ‘সর্বাধিক প্রচারিত’ দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই কথাই আমজনতাকে জানাতে চেয়েছে সিপিআই (এম)। অবশ‌্যই, এর মাধ‌্যমে সর্বাধিক সংখ‌্যক জনতার কাছে কমিউনিস্ট পার্টির বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে বলে তারা মনে করেছে। যে বার্তায় ‘পুঁজিবাদি’দের অনুদান গ্রহণ করা রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি তীব্র শ্লেষ রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই বার্তা পৌঁছে দিতে তথাকথিত পুঁজিবাদি মিডিয়া প্ল‌্যাটফর্মকেই ব‌্যবহার করা হল। আরও অবাক হওয়ার বিষয় হল, পার্টি মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়নি।

ব‌্যাক টু নাইন্টিস। ততদিনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে জনগণের ভোটে জিতে বাংলায় দেড় দশক কাটিয়ে ফেলেছে সিপিআই (এম)-এর নেতৃত্বের বাম সরকার। মুখ‌্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বের সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি, কিন্তু প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া উঠতে শুরু করেছে। একটিই রাজনৈতিক দলই যদি একাধিক্রমে দেড় দশক ক্ষমতায় থাকে, তা হওয়া স্বাভাবিক। আর সংবাদপত্রের ভূমিকাই হল, সরকারের সমালোচনা। বাণিজ্যিক সংবাদপত্রগুলি সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বাম নেতাদের চোখে ‘শ্রেণীশত্রু’ হয়ে ওঠে। যেন মনে হতে থাকে, তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেসের চেয়েও হয়তো তাদের বড় ‘প্রতিপক্ষ’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত চারটি সংবাদপত্র। সে সময় কাগজকে গালাগাল না দিয়ে কমরেডরা জলপান করতেন না, প্রতিটি জনসভায় হয় কাগজের নাম করে বা না করে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদাগার চলত। দলীয় মুখপত্রেও কাগজের নাম করেই নানা চটুল কিন্ত্ত বিরূপ টীকা-টিপ্পনি থাকত৷ অনেক সময় থাকত ব্যক্তিগত আক্রমণও।

তারপর হুগলি নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। বাংলায় ক্ষমতা হারিয়েছে সিপিআই (এম)। তারপর ত্রিপুরাতেও। গত ১০ বছরে দেশের রাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। রাজনৈতিক বার্তা আমজনতার কানে পৌঁছে দেওয়ার পদ্ধতিতেও এসেছে পরিবর্তন। সিপিআই (এম) সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলছে। বহুদিন ধরেই সোশ‌্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে তাদের প্রচারের অন‌্যতম নির্ভরযোগ‌্য ‘হাতিয়ার’। এবার ‘বাজারি’ কাগজও। হয়তো আজ সেই সব কমিউনিস্ট নেতারা স্বীকার করবেন, তাদের সেদিনের মন্তব‌্য ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ছিল। অন্তত, আড়ালে হলেও।

তবে, বাণিজ্যেক সংবাদপত্রের ‘খবর’ পড়ে মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়ে সেটা নিশ্চিত করতে ভূমিকা ছিল দলীয় মুখপত্রের। আজ তার প্রচার কমেছে। কাজেই বার্তা পৌঁছে দিতে একটা বড় মাধ‌্যমের তো দরকার ছিলই।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন