সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। সে যুগের নারীর কাছে যা ছিল প্রত্যাশিত, স্বাভাবিক, আজ আর তা নয়। আবার উল্টোটাও ঘটেছে।
দ্বৈপায়ন কর
সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। সে যুগের নারীর কাছে যা ছিল প্রত্যাশিত, স্বাভাবিক, আজ আর তা নয়। আবার উল্টোটাও ঘটেছে। দিনে দিনে বেড়েছে পশ্চিমের প্রভাব। বেশি বেশি করে রুঢ় বাস্তবের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তাই ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে সতীত্বের খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামানোর মানসিকতা। শরীর নয়, মনের সততায় বিশ্বাস বেড়েছে। আর এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে সমাসামিয়ক সাহিত্যে। গত চার দশকে বাংলা গল্প-উপন্যাসের নারীরা।
যুগের কোনও সীমারেখা নেই। ঠিক কবে থেকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ভারতীয় নারীর এই পরিবর্তন, তার কোনও নিশ্চিত দিনক্ষণ নেই। তবে চল্লিশের দশক থেকেই মেয়েরা ব্যাপকহারে শিক্ষিত হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে তারা চাকরি ও জীবিকার সন্ধানে বাইরে বার হয়। খোলা আকাশের নীচে এসেই চার দেওয়ালের চান আর বিশ্বজননীন হাতছানির টানাপোড়েনে নারীর স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনা জেগে ওঠে। একদিকে চিরন্তন নারী সংস্কার, নারী সেন্টিমেন্ট– অপরিদিকে সামাজিক বঞ্চনার নাগপাশের বিরুদ্ধে জেহাদ, ওই দুইয়ের মাঝেই জন্ম নেয় নারী আন্দোলন। ‘অবলা’ নারী আর রাজি নয় শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্রের বশে থাকতে।
এ সবেরই চিত্রগুলি ধরা হয়েছে সমসাময়িক সাহিত্যে। ‘ভারতীয় নারী জন্মায় একবার, মরেও একবার, তাদের বিয়েও হয় একবার।’ এই প্রচলিত সংলাপের মূলে কুঠারাঘাত করলেন সাহিত্যিক অরুণ দে, তাঁর ‘বন্ধুর স্ত্রী’ উপন্যাসে (১৯৮০)। উপন্যাসের নায়িকা মণিকা সুখেই ঘর করছিল স্বামী প্রশান্তর সঙ্গে। উড়ে এসে জুড়ে বসল প্রশান্তর ব্যাচেলর বন্ধু। প্রশান্তর অনুপস্থিতিতে অনিচ্ছাকৃতভাবেই (?) মণিকার সঙ্গে তার একটা হৃদয়ের মেলবন্ধন ঘটে যায়। প্রশান্তর ওই বন্ধু যখন মণিকাকে বিছানায় টেনে নেয়, প্রতিবাদ করে না মণিকা। এর জন্য তার মনে বিন্দুমাত্র পাপবোধও বাসা বাঁধে না। তাদের এই প্রমকে অবৈধ করে গোপনও রাখে না সে। বরং, স্বামীর কাছে অকপটে স্বীকার করে প্রেমের কথা।
এদিকে বাণী বসুর ‘শ্বেত পাথরের থালায়’ দেখি সেই বাল্যবিধবা কিভাবে সংস্কার কাটিয়ে উঠে আসে চাওয়া-পাওয়ার অতিবাস্তব জীবনে। কিন্তু সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ভালোবাসার অন্ধকারে’ (১৯৯০) উপন্যাসে সংস্কারটা কোনও প্রশ্নই তোলে না গার্গীর কাছে। কর্ণেল সিরিজের বড়দের গল্পটিতে গার্গী বরং প্রশ্ন তোলে নিশ্চিত আশ্রয় নিয়ে– ‘আমাকে যদি তাড়িয়ে দেয়?’ স্বামীর যৌনশৈত্য, যা তার মা হওয়ার বাসনাকে অপূর্ণ রাখে, যেন নিজের অজান্তেই সে সায় দেয় পাতানো দেওরের সঙ্গে শারিরীক মিলনে। একবার আচমকা নয়, বারবার। এর জন্য গার্গীর মনে কোনও পাপবোধ নেই। অথচ, মিলনের পর সেই গায়ে সে মন্দিরে যেতে চায় না।
এই সময়ে ব্যাভিচার, পাপবোধ-এর সংস্কার কথাটা বড় সেকেলে। বিয়ের আগে প্রেম, শারিরীক সম্পর্ক, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, আজ আর কোনও ভাবনার বিষয়ই নয়। মুখোরচক গল্প হতে পারে, এই পর্যন্তই। বিশ্বায়ন-পূর্ব সময়ে দিব্যেন্দু পালিতের ‘স্বপ্নের ভিতর দিয়ে’ (১৯৮৭) উপন্যাসের অর্পিতা বিবাহের আগে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। অজাত সন্তানটির প্রতি মাতৃত্বের টান অনুভব করা সত্ত্বেও তাকে বিসর্জন দিতে হয়। এরপর নিজের বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিতেও বাধ্য হয় অর্পিতা। হয়তো জীবনের পথচলায় স্বাভাবিক ছন্দ থাকে না, হয় কিছুটা মন্থর, কিছুটা বিমর্ষ, তবু এগিয়ে চলে সে।
আবার প্রফুল্ল রায়ের ‘রণক্ষেত্র’ (১৯৮৫)-র নায়িকা দীপা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে অনীশকে ভালোবাসে। অতি তাড়িতাড়ি পৌঁছে যায় শারিরীক সম্পর্কে। দীপা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। কিন্তু অনীশ ও তার পরিবার এই সন্তানের দায় নিতে অস্বীকার করে। দীপার পরিবার গর্ভপাতের পরামর্শ দেয়। চাপ আসে অনীশের বাড়ি থেকেও। কিন্তু, একা দাঁড়িয়ে লড়াই করে অনীশকে সে বিয়ে করতে বাধ্য করে। পরের দিনই পাঠায় বিচ্ছেদের নোটিশ। তার আর অনীশের সঙ্গে সংসার করা সম্ভব নয়। শুধু অজাত সন্তানটির একটা পিতৃপরিচয় দরকার ছিল। তাছাড়া, লড়াইটা আত্মসম্মানেরও।
আর এই ‘সংস্কার’ নামক বুলিটিকে নারী যে যথাস্থানে সরিয়ে রাখতে পেরেছে, তার জন্যই তার আত্মত্যাগও। তাও তো আমরা অনেক গল্প-উপন্যাসে দেখেছি। এই নারীরা কেউই কল্পনা নয়, রক্তমাংসের। তাঁরা আমাদের মধ্যেই আছেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন