‘পুড়ে যায় জীবন নশ্বর’ : লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পথ দেখাবেন একটি বিশ্বাসকে

ইতিহাসের বিচার ও রাজধর্মে পরাক্রান্ত শাসকের হাতে প্রতিবাদীর কণ্ঠ নিষ্পেষিত হয়, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তির স্বপ্ন ও স্বাধীনতার আদর্শ আপস করে না। বলিষ্ঠ লেখনির মাধ‌্যমে সজাগ করেছিলেন লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

‘পুড়ে যায় জীবন নশ্বর’ : লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও পথ দেখাবেন

 দ্বৈপায়ন কর


একজন আদ‌্যন্ত রাজনীতিক। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র শীর্ষ নেতৃত্বদের অন‌্যতম ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু, এর বাইরেও তাঁর আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি ছাত্র-জীবন থেকেই সাহিত্যচর্চায় নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন একজন মনোযোগী পাঠক। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, রবীন্দ্রনাথ, মায়কোভস্কি, কামু, কাফকা, মার্কেজের বই তাঁর পড়ার টেবিলে থেকেছে পাশাপাশি। আমি নিজে দেখেছি, তিনি তখন রাজ্যের তথ‌্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী, ময়দানে কলকাতা বইমেলার সময় প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ‌্যাবেলায় আসতেন। কাজকর্মের ফাঁকে কখনও-সখনও বইমেলা ঘুরে দেখতেন। কোনও তরুণ-তরুণী হয়তো নতুন কোনও বই নিয়ে এসেছেন তাঁর স্বাক্ষরের জন‌্য, তিনি প্রথমে বইটির কভার দেখতেন। তারপর হাসিমুখে স্বাক্ষর করে দিতেন। কখনও আবার সেই লেখকের অন‌্য কোনও বইয়ের নাম উল্লেখ করে জিজ্ঞাসা করতেন, অমুক বইটি পড়েছো? বিশ্বসাহিত‌্য নিয়ে অগাধ পড়াশোনা ছিল তাঁর।

তবে, লেখক হিসাবে বুদ্ধবাবুর নাম আলোচনা উঠে আসে ১৯৯৩ সালে তাঁর লেখা নাটক ‘দুঃসময়’ হেতু। এই নাটকের বিষয়বস্তু– সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবতার জয় ঘোষণা। এই নাটক যখন পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়, সেখানে ছয়টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক ছিল। দুঃসময় ছাড়া অন্য কোনও নাটক সেভাবে মঞ্চস্থ হয়নি। তবে সংকলনের ‘ইতিহাসের বিচার’ নাটকে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে ফিরে দেখতে দেখতে পৃথিবীতে মৌলবাদ এবং স্বৈরতন্ত্রের পুনরুত্থানের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে এবং আরেকটি নাটক ‘রাজধর্ম’-এ উনিশ শতকে ভারতে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী চেহারা দেখানো হয়েছে। দুটি নাটকেরই উপজীব‌্য হল– পরাক্রান্ত শাসকের হাতে প্রতিবাদীর কণ্ঠ নিষ্পেষিত হয়, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তির স্বপ্ন ও স্বাধীনতার আদর্শ আপস করে না।

ধ্রুপদী সাহিত্যের একাগ্র পাঠক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একজন মার্কসবাদী হিসাবে শ্রেণীদ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রমকে কখনও অস্বীকার করেননি। পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর লেখা নাটক ‘পোকা’ নিয়েও বহু আলোচনা হয়েছিল। তবে এটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়। ফ্রানজ কাফকা রচিত ‘মেটামরফোসিস’ অবলম্বনে লেখা। অন‌্যদিকে, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস অনুবাদ করেছেন ‘বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প’। সেটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায় পাঠক মহলে। তবে, তাঁর এ যাবৎ সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ ‘পুড়ে যায় জীবন নশ্বর’ (১৯৯৯ সালে প্রকাশিত)। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোটোগল্প নিয়ে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অসাধারণ বিশ্লেষণ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যে আলোচনা কোনওভাবেই একদেশদর্শী নয়।

কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রবন্ধের লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর দৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দশ বছর ও শেষ দশ বছর নিয়ে দুই খণ্ডে 'ফিরে দেখা' নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলি ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে আরও দুটি গ্রন্থ– ‘নাৎসি : উত্থান ও পতন’ এবং ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’ (সাম্প্রতিক কালে চিনের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা) বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে।

আজ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে বাংলার প্রগতিশীল সাহিত‌্যচর্চারও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন