বাংলা সিনেমার শিরে সংক্রান্তি : মুক্তি কিভাবে?

নতুন পরিচালকদের ছবি করা দিনে দিনে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল। বিশেষত যারা অন্য ধারার ছবি করতে চাইছেন।

বাংলা সিনেমার শিরে সংক্রান্তি : মুক্তি কিভাবে?

রাজা চট্টোপাধ্যায়

টলিপাড়া স্তব্ধ! শেষ পর্যন্ত জল নবান্ন পর্যন্ত গড়াবার পর যুযুধান দুই পক্ষ সাময়িক সন্ধিতে পুনরায় কাজ শুরু করলেও এই সমস্যা কি আদৌ মিটবে?

বিবাদের কারণ সম্পর্কে একটি কথা শোনা যাচ্ছে, ডিরেক্টরদের আত্মসম্মান ভার্সেস কর্মীদের ইগো! সমস্যাটা কিন্তু এত সোজা নয়। অংকটাও তাই এত সরলও নয়। এই সমস্যা সুগভীর ও বহুস্তরিয়!

যদি 'পথের পাঁচালী' সিনেমা নির্মাণের দিনে ফিরে যাই, সত্যজিৎ রায় নামের এক যুবক একটি মিচেল ক্যামেরা ভাড়া করে কয়েকজন সিনেমা প্রেমী বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ছবিটি। শুটিংয়ে কলাকুশলী দশ-বারো জনের বেশি ছিল না। কিন্তু সেই ছবি সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস!

উত্তম-সুচিত্রা যুগে ঘরের মা কাকিমারা দুপুরবেলা দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যেতেন। আর অফিস ফেরতা পুরুষেরা ইভিনিং বা নাইট শোতে সিনেমা দেখে ঘরে ফিরতেন। ছুটির দিনে সপরিবার সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল বাঁধা রুটিন। সিনেমা নিয়ে আড্ডা হতো, চর্চা হতো, গল্প হতো। টিকিটের দাম ছিল মধ্যবিত্তের পকেটের নাগালে। দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনে সপ্তাহান্তে একটি সিনেমা ছিল রুপালি আলোয় স্বপ্নের রাজকুমার রাজকুমারী উত্তম-সুচিত্রাকে দেখার রোমাঞ্চ! তাই বেশিরভাগ হলে সাড়ম্বরে ঝোলান থাকতো 'হাউস ফুল' বোর্ড।

এরই মধ্যে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালেরা বুদ্ধি দৃপ্ত ছবি করে চলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তা লাভজনক না হলেও প্রযোজকদের অন্য ছবির লাভের হিসেবে ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না সেভাবে। ফলে সিনেমা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ মিলতো। এছাড়াও পরবর্তীকালে বামপন্থী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালকেরা আর্ট ফিল্ম করার সুযোগ পাচ্ছিলেন।

তবে এই সময় সিনেমা কর্মীদের কোনও সংগঠন ছিল না। ফলে প্রাপ্য টাকা প্রযোজক সংস্থা না দিলে কর্মীরা বঞ্চিত হতো। কেউই আর ব্যয়বহুল দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে যেতে সাহস করতো না। ফলে অনেক কর্মীর টাকাই মার যাচ্ছিল। কর্মীরা যাতে প্রাপ্য টাকা পায় সেই উদ্দেশ্যে তৈরি হলো 'ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান এন্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া'। এর ছত্রছায়ায় এল ক্যামেরা, মেকআপ, এডিট, প্রোডাকশন ইত্যাদির মতো ৪২টি বিভাগ; একত্রে যা 'গিল্ড' নামে পরিচিত।

আশির দশকে হঠাৎ করেই উত্তমকুমার মারা গেলেন। তার বছর কয়েক আগেই সুচিত্রা সেন সিনেমা থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। এদিকে বাঙালির জীবনে বিনোদনের আরেকটি উপকরণ প্রবেশ করছে ধীরে ধীরে - টেলিভিশন। সাপ্তাহিক সিনেমা দেখার প্রয়োজন কমতে থাকল। এরপর থেকে সিনেমা হল গুলিতে দর্শক সমাগম চোখে পড়ার মতো কমে এল। উত্তম-সুচিত্রা যুগে এ রাজ্যে মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৩০০-র মতো। বন্ধ হয়ে গিয়ে তা দাঁড়াল ৮৫০-এ।

এদিকে ততদিনে বম্বেতে এক এংগ্রি ইয়াং ম্যান এসে গেছেন - অমিতাভ বচ্চন। যে বাংলার যুবসমাজ একদা উত্তম সৌমিত্রের ছবি দেখতে হলে ছুটতো, এবার তারাই দেখতে দৌড়ল হিন্দি ছবি। বাংলার বাজারে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করল হিন্দি সিনেমা; পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার হিন্দি ভার্সন।

টলিপাড়ার এই সংকটকালে হাল ধরলেন অঞ্জন চৌধুরী। মধ্যবিত্ত সংসারের গল্প নিয়ে তাঁর ছবি 'শত্রু', 'গুরুদক্ষিণা', 'ইন্দ্রজিৎ', 'মেজ বউ', 'ছোট বউ' আবার দর্শকদের হলমুখী করল। এছাড়াও তরুণ মজুমদারের ছবির আকর্ষণ তো ছিলই। তিনি তৈরি করে চলেছিলেন 'দাদার কীর্তি', 'ভালোবাসা ভালোবাসা', 'আলো'র মতো নান্দনিক ছবিগুলি।

'৯৫ সালে বোকাবাক্সে এল মেগা সিরিয়াল 'জননী'। সুপ্রিয়া দেবীকে জননীর ভূমিকায় এবং ইন্দ্রানী সেনের সুললিত কন্ঠে একটি সুর 'হাসিমুখে যে সব সয় - সেই জননী!' ব্যাস, বাঙালি মা-বোনেদের হৃদয় জিতে নিল। ফলে একদা দল বেধে যাওয়া সেই মহিলা দর্শকরা বাংলা সিনেমার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল।

এরপর প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত। তৈরি হলো অনেকগুলি বাংলা চ্যানেল। প্রতি চ্যানেলেই অনেকগুলি করে মেগা সিরিয়াল। মেগায় মেগায় লড়াই শুরু হলো । এ লড়াইয়ের জয়সূচক মাত্রাটি হলো - টিআরপি। সিরিয়ালগুলি চলার সময় তাতে বিজ্ঞাপন দিলে তা প্রচুর দর্শকের কাছে পৌঁছায় তাই মেগার প্রযোজকেরা প্রচুর টাকা লাভ করতে শুরু করল। সিনেমা কর্মীরা দৈনিক চাহিদার যোগান দিতে টানা ২৪ ঘন্টা, ৩৬ ঘন্টা এমনকি ৪৮ ঘন্টা কাজ করে করে দিশেহারা অবস্থা! টিআরপি কমলেই বদলে দেওয়া হতে থাকলো গল্পকে যেনতেনোপ্রকারেণ টিআরপি বাড়াতেই হবে, তাহলেই ব্যবসা আসবে। ফলে মাথামুণ্ডুহীন বস্তা পচা নিম্ন রুচির অসংখ্য মেগার জন্ম হতে লাগল। কর্মীদের এই অবস্থায় ফেডারেশন আরো কর্মী নেবার নিয়ম জারি করল।

এরই মধ্যে আর্ট ফিল্ম বানানো চলছিল টিমটিম করে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মিচেল বা অরিফ্লেক্সের মতো ভারি, ব্যয়বহুল ক্যামেরার জায়গায় এল স্বল্পমূল্যের ডিজিটাল ক্যামেরা।মুভিওয়ালা মেশিনে ফিল্ম কেটে সিমেন্ট দিয়ে জোড়ার সময় সাপেক্ষ পদ্ধতির জায়গায় এল ফাইন কাট প্রো-এর মতো কম্পিউটারে ডিজিটাল এডিটিং। ফলে সময় ও ব্যায় কমল।

এদিকে মেগার জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা হলের বন্ধ হয়ে যাওয়া চলছিল পাল্লা দিয়ে। আজকের দিনে রাজ্যে মোট হলের সংখ্যা দুশোরও কম। নতুন পরিচালকদের ছবি করা দিনে দিনে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল। বিশেষত যারা অন্য ধারার ছবি করতে চাইছেন।

২০১১ সালে সরকারি অনুদানে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে টেকনিশিয়ান স্টুডিও ঢেলে সাজানো হয়। যদিও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সিনেমা তৈরি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। এই সংকট কালে নতুন পরিচালকদের স্বপ্নপূরণ দুরূহ হয়ে দাঁড়াল! সিনেমার ক্ষেত্রে প্রযোজক মেলা দুষ্কর। এদিকে গিল্ডের নানারকম বিধি-নিষেধ। যেমন কমপক্ষে ৩৭ জনকে নিতে হবে, আট ঘন্টায় ১ সিফট, এরপর ২ ঘন্টায় দেড় সিফট এবং ৪ ঘন্টায় ২ শিফটের হিসেবে কর্মীদের বেতন দিতে হবে ইত্যাদি।

নতুন পরিচালকরা কোনওক্রমে যদিও বা টাকার বন্দোবস্ত করতে পারল তখন গিল্ডের নানা নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে ছবির কাজ মাঝপথেই বন্ধ হতো বা মনোমতো ছবি করা যেত না। এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া, সিনেমা হল পাবার সমস্যা। কিছু সি-গ্রেডের হল মিললেও ছবি দু তিন দিনের মধ্যে সরিয়ে দেওয়া হতো। নতুন প্রযোজকেরা প্রভূত ক্ষতি স্বীকার করে অন্য ব্যবসায় চলে যেতেন বা দেউলিয়া হয়ে যেতেন।

শৈল্পিক চেতনার তাগিদে কিছু পরিচালক গিল্ডের সদস্য নয় এমন কিছু বন্ধুদের নিয়ে ছবি বানাতে গেলে তাদের বলা হত 'গুপী কাজ'। তাদের গিল্ড থেকে এসে নানা রকম ভাবে বাঁধা দেওয়া হতো, শুটিং বন্ধ করে দেওয়া হতো, ক্যামেরার আটকে রাখা হতো, পরিচালককে হেনস্তা করা হতো, প্রযোজকের কাছ থেকে জুলুম করে টাকা নেওয়া হতো। যদিও এর প্রতিটি কাজই বেআইনি।

তবে এভাবে গিল্ডের সঙ্গে সংগ্রাম করে তৈরি হয়েছিল 'বাকিটা ব্যক্তিগত' (২০১৩) নামের একটি ছবি। কিন্তু মুক্তির সময় হল পাওয়া যায়নি। ছবিটি সে বছর জাতীয় পুরস্কার পেলে সকলের টনক নড়ে। তখন সাড়ম্বরে মুক্তি পায়। 'ভবিষ্যতের ভূত' (২০১৯) একদিন প্রদর্শনের পর সরকারের সমালোচনা করার অপরাধে উপরও য়ালার নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এ হেন পরিস্থিতিতে ডিরেক্টররা যখন নাজেহাল এরই মধ্যে বাংলাদেশে গিয়ে কাজ করার 'অপরাধে' এক ডিরেক্টরকে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করে গিল্ড। তিনি টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে নতুন ছবির শুটিং করতে গেলে কোনও বিভাগের কোনও কর্মীই আসে না। এবার ডিরেক্টরের এককাট্টা হয়ে এর প্রতিবাদ করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় এবং একটি পাঁচ সদস্যের কমিটিকে নিয়ম-কানুন ঢেলে সাজাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আগামী নভেম্বর মাসে এই নতুন নিয়ম লাগু হবে। তবে আর্টফিল্মের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন শিথিল না করলে এবং সরকারি উদ্যোগে রাজ্যের ছোট ছোট শহর গুলিতে সিনেমা হল তৈরি করে সেখানে স্বল্পমূল্যে প্রশংসিত ছবিগুলি দেখানো, সিনেমা সংক্রান্ত সেমিনার, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির বিনামূল্যে প্রদর্শন ইত্যাদির আয়োজন না করলে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকবে একথা নি:সন্দেহে বলা যায়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন