বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসেবে ‘অরবিটাল’ লিখতে চাইনি: সামান্থা হার্ভে

২০২৪ সালের বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ১৫ আগস্ট বুকারের পক্ষ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। আমরা ‘বইতন্ত্র’-এর পাঠকের জন‌্য সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশের বাংলা তর্জমা প্রকাশ করলাম।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসেবে ‘অরবিটাল’ লিখতে চাইনি: সামান্থা হার্ভে


‘অরবিটাল’ উপন্যাসের জন‌্য ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে ২০২৪ সালের বুকার পুরস্কার পেয়েছেন। হার্ভের জন্ম ১৯৭৫-এ ইংল্যান্ডের কেন্টে। ৮৯ বছর বয়সী লেখক নিজেকে একজন প্রকৃতি-সচেতন মানুষ ভাবতে ভালোবাসেন এবং তাঁর লেখালেখির জগতেও তার ছাপ স্পষ্ট। তেমনই তাঁর ‘অরবিটাল’ উপন‌্যাসটিও ছাপ রয়েছে। মানুষের চিরকৌতূহলের অন‌্যতম– মহাবিশ্বের সর্বাধিক অজানা মহাকাশকেও তিনি সযত্নে সাহিত্যের অংশ করে তুলতে পেরেছেন, সেই গভীর প্রকৃতি-প্রেম থেকেই। 

প্রসঙ্গ: বুকার শর্ট লিস্টে স্থান পাওয়া ‘অরবিটাল’ লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা

সামান্থা হার্ভে: আমাদের নিম্ন-ভূ-কক্ষপথ (বা, লো আর্থ অরবিট। পৃথিবীর উপরে বৃত্তাকারে ১৪০ থেকে ৭৯০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা আকাশ) নিয়ে কাজ করা মানুষের পেশা নিয়ে পঁচিশ বছর ধরে লিখতে চেয়েছি। কোনও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসেবে নয় বরং বাস্তবতা নিয়ে লিখতে চেয়েছি। বইটি লেখার সময় নিজেকেই কতগুলো চ‌্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছিলাম– আমি কি লেখায় একজন প্রকৃতিবিষয়ক লেখকের মমতাসহ ওই সুবিধাজনক দিকের সৌন্দর্যকে বর্ণনা করব? আমি কি আকস্মিক বিস্ময় তৈরি করে এমন কিছু লিখব? আমি কি একটি মহাকাশের আদর্শ রূপ বর্ণনা করব?

প্রসঙ্গ: আপনাকে বই পড়ার প্রেমে ফেলেছে যে বই

সামান্থা হার্ভে: রোয়াল্ড ডালের লেখা ‘ড্যানি দ্য চ্যাম্পিয়ন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটি, আমি বলতে পারি। বইটিতে একটি ছেলে ও তার বাবার সম্পর্ককে আশ্চর্যজনকভাবে আঁকা হয়েছে। বইটি পড়ে সন্তান ও বাবা-মার মধ্যে ভালোবাসা-টান-মমত্বের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কার করেছি, যেটা আমার নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করেছে। আবার আমার নিজের বাবা-মার প্রতি যে ভালোবাসা, তারও নতুন দিগন্ত আমার কাছে উন্মোচিত হয়েছে।

প্রসঙ্গ: যে বই পড়ে আপনার লেখক হওয়ার বাসনা জাগে

সামান্থা হার্ভে: এটা একটু জটিল প্রশ্ন। তবে গ্রাহাম সুইফটের ‘ওয়াটারল্যান্ড’ এরমধ্যে একটি। সুইফটের বইয়ের মধ্যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ তৈরির আশ্চর্য শক্তি এবং গুণ রয়েছে। জমকালো বহস্তর বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন গল্প বলার ধরন এবং এ উপন্যাসের দৃঢ় প্রত্যয় আমাকে অশান্ত করেছে কিছু একটা লেখার জন্য। এ বইটি আমাকে এটা ভাবায়নি যে, আমিও এ রকম একটি বই লিখতে পারতাম, বরং ভেবেছি, আমার দূরকল্পনা, আমি কি কখনও এমন একটা বই লিখতে পারব? আমি বইটি বারবার পড়িনি, পড়ার সাহসও হয়নি। এরপর যখনই লেখক সুইফটের অন্যান্য বই পড়েছি, তখন তাঁর লেখার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনিবার্যভাবে বেড়ে গিয়েছে।

প্রসঙ্গ: যে বই বারবার আপনাকে টানে

সামান্থা হার্ভে: সেই বইটি হল ভার্জিনিয়া উলফের ‘মিসেস ডালোওয়ে’। গোটা বইটি বার দুয়েক আগাগোড়া পড়েছি। কিন্তু যখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনও বিষয় নিয়ে বলার জন‌্য প্রস্তুতি নিই, তখন প্রায়ই এই বইটির মধ্যে ডুব দিই। কারণ, এটার গদ্য বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে এমনভাবে ঠিকরে পড়ে, এত সতেজভাবে এবং এত চমৎকারভাবে এটার ক্রম-উন্মোচন হয় তা বিস্ময়কর। ‘মিসেস ডালোওয়ে’ অন্তত ৯৯ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি এখন পর্যন্ত বইটির ভাষার কারুকাজে বুঁদ হয়ে থাকি। এর ভাষা বহুমাত্রিক সচেতনতার সূক্ষ্ম ঠাসবুননে দ্রুত প্রবহমান, কালজয়ী এবং বইটি আবার পড়তে গিয়ে দেখি যে তার শিল্পকৌশল শুধু পর্যাপ্ত নিয়মানুসারী নয় বরং অনেক বেশি দক্ষতার প্রকাশ।

প্রসঙ্গ: যে বই আপনার চিন্তা-চেতনা থেকে বের করতে পারছেন না

সামান্থা হার্ভে: গত শীতে ফার্নান্দো মেলচোর লেখা ‘হারিকেন সিজন’ (স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন সোফি হিউজ) পড়ছিলাম। সেই থেকে আমি বইটির কথা মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারছি না। অথচ নানাভাবে বইটি স্মৃতি থেকে বের করে দিতে চাইছি। এটি যেন পাঠকের উপরে উপন্যাসের একটি নৃশংস আক্রমণ, যা পাঠকের মনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে যায়। আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, হিউজ কীভাবে বইটি অনুবাদ করলেন! কিন্তু কাজটি মনে রাখার মতো, এ বইয়ের প্রতিটি বিষয় নিপুণ এবং অনস্বীকার্য।

প্রসঙ্গ: যে বই আপনার পৃথিবী দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল

সামান্থা হার্ভে: এটির উত্তরও জটিল হবে। যদি সিনক্লেয়ার লুইসের ‘মিরাকলস’-এর কথাই বলি– বইটি খ্রিষ্টানত্বের অলৌকিকত্বের ধারণার কেন্দ্রবিন্দু নিয়ে লেখা ঠিকই, তবে সেখানে আমাদের জীবনে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া সব অলৌকিক ঘটনার বিষয়ে একটি প্রাণবন্ত বাদানুবাদ রয়েছে। একজন অ-খ্রিষ্টান এবং প্রচলিত ধর্মগুলোয় আনুষ্ঠানিক বিশ্বাস না থাকা ব্যক্তি হিসেবে, তাঁর লেখা আমাকে ঋণী করেছে। লুইসের বিশ্বাসবোধ সম্মোহনী এবং রোমাঞ্চকর।

প্রসঙ্গ: উপন্যাস সম্পর্কে আপনার আগের ধারণা বদলে দিয়েছিল যে বই

সামান্থা হার্ভে: সেটি একটি ফিকশন, উপন্যাস নয়। ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের ‘ব্রিফ ইন্টারভিউস উইথ হাইডিয়াস মেন’। আমি বইটি পড়েছি, পড়ার পরে পাশে রেখে দিয়েছি। বইটি নিয়ে ভেবেছি, –আমার তো কোনও ধারণাই ছিল না যে লেখালেখিও এমনটা করতে পারে। তাই বইটি আমার পাশে এমন ভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছে।

প্রসঙ্গ: যে বই আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে

সামান্থা হার্ভে: আমি নাম করতে পারি জর্জ এলিয়টের ‘সাইলাস মার্নার’ অথবা জে এম কোয়েটজির ‘ডিসগ্রেস’ অথবা মার্লিন রবিনসনের ‘হোম’ অথবা ইয়ানসুরি কাওয়াবাতার ‘স্নো কান্ট্রি’। আমি এগুলোর মধ্য থেকে কোনও একটিকে বেছে নিতে বললে পারব না। আমার মতে, প্রতিটি বই-ই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে সর্বাঙ্গসুন্দর কিন্তু সবই অতি সাধারণ গল্প, যেগুলি বাছাই করা যথাযথ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সুচারুরূপে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গ: এখন যে বই পড়ছেন

সামান্থা হার্ভে: সিগরিড নুনেজের ‘দ্য ফ্রেন্ড’ বইটি সবে শেষ করলাম। এখন পড়ছি নবোকভের লেখা ‘পেল ফায়ার’। বইটি পড়ে খুব বেশিদূর এগোতে পারিনি। এর অক্ষরগুলো এত ছোট এবং আমার এই মধ্যবয়সী চোখ এত দুর্বল যে বইটি পড়তে ছোট্ট কিন্তু তীব্র উজ্জ্বলতার দরকার পড়ছে। বই পড়াটা মনে হচ্ছে এবার একটা অভিযানে রূপ নিতে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গ: যে বুকার-মনোনীত বই সবার পাঠ করা উচিত

সামান্থা হার্ভে: ওহ্‌ গড! এর জবাব দেওয়া অসম্ভব! আমি কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা রাখব: রোজ ট্রেমেইনের ‘বেস্টোরেশন’ যেমন প্রাণ কেড়ে নেওয়া বই এবং জে জি ফারেলের লেখা ‘দ্য সিজ অব কৃষ্ণপুর’... আমার মতে এটা গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন