এলোমেলো বই নয়, তাঁদের লক্ষ্য ছিল ১৫ ও ১৬ শতাব্দীর দুষ্প্রাপ্য বই—লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, গ্যালিলিওর বিজ্ঞানের নথি, নিউটনের বিখ্যাত কাজের প্রথম সংস্করণ।
 |
| এআই জেনারেটেড প্রতিকী ছবি। |
হিথরোতে তখন ক্রমে রাতের নিস্তব্ধতা গাঢ় হচ্ছে। লন্ডনের অদূরে এই শহরে একটি নিরাপত্তা ঘেরা কাস্টমস গুদাম ঘুমিয়ে রয়েছে বুকে বিরল কিছু রত্ন নিয়ে– যা শুধু কাগজগুচ্ছ নয়, যা ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষ্য বহন করে। এই রাতেই ঘটে দুঃসাহসিক অভিযান। চুরি যায় ১৬০টি দুষ্প্রাপ্য বই ও পাণ্ডুলিপি। ফেলথামের একটি কাস্টমস গুদাম ফ্রন্টিয়ার ফরওয়ার্ডিং-এ এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে, যেখানে লাস ভেগাসে ৫০তম বার্ষিক ক্যালিফোর্নিয়া আন্তর্জাতিক প্রাচীন পুস্তক মেলায় ডাক পরিবহনের জন্য দুর্লভ বই এনে রাখা হয়েছিল।
২৯ জানুয়ারি, ২০১৭। ড্যানিয়েল ডেভিড ও ভিক্টর ওপারিউক একেবারে সুপরিকল্পিতভাবে নেমে পড়লেন অভিযানে। দু’জনেই দাগি চোর, দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা করেছেন। কেইকি করেছেন। প্রথম ধাপে তারা কাটা হল গুদামের চৌহদ্দি ঘেরা কাঁটাতারের বেড়া। সেখান থেকে তারা দেয়াল বেয়ে উঠে পড়ল ছাদের উপর। কিন্তু শুধু এখানেই থেমে থাকলে হয়তো কাহিনিতে উত্তেজনা থাকত না। তারা যা করল, তা নিঃসন্দেহে চোখ ছানাবড়া করার মতো— স্পাই মুভির হিরোদের মতো একটি স্কাইলাইট কাচ খুলে দড়ি বেড়ে নেমে পড়ল গুদামের ভেতর।
তাঁরা জানতেন তাঁরা কী খুঁজছে। যেন হাতে একটি নিখুঁত তালিকা রয়েছে। এলোমেলো বই নয়, তাঁদের লক্ষ্য ছিল ১৫ ও ১৬ শতাব্দীর দুষ্প্রাপ্য বই—লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, গ্যালিলিওর বিজ্ঞানের নথি, নিউটনের বিখ্যাত কাজের প্রথম সংস্করণ। মোট বইয়ের সংখ্যা? ১৬০টির বেশি। তাদের দক্ষতা এমন ছিল যে, তারা নিচে নেমে ঠিক সেই জায়গাতেই ল্যান্ড করল, যেখানে দরজার পাশে কিছু তাক ছিল। নিরাপত্তা ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দিয়ে, নাড়াচাড়া না করে, একে একে তুলে নিলো কোটি কোটি টাকার সেই বইগুলি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অপারেশন সম্পূর্ণ। শহরটা যখন ঘুমিয়ে, তাদের গাড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল লন্ডনের রাতের অন্ধকারে।
চুরি যাওয়া বইয়ের মধ্যে ছিল কোপার্নিকাসের ডি রেভোলিউশনিস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিয়ামের ১৫৬৬ সালের সংস্করণ (যার মূল্য প্রায় ২১৫,০০০ পাউন্ড), দান্তের ডিভাইন কমেডির ১৫৬৯ সালের সংস্করণ, দা ভিঞ্চির আ ট্রিটিস অন পেইন্টিং- এর ১৬৫১ সালের সংস্করণ, নিউটনের ফিলোসফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকার ১৭৭৭ সালের সংস্করণ, ঈশপ , ইউরিপিডিস এবং গ্যালিলিওর অন্যান্য রচনা। বইগুলির মূল্য ছিল ২ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি, যা তিনটি পৃথক হাই প্রোফাইল ডিলারের কাছ থেকে আনা হয়েছিল। তদন্তকারীর অনুমান করে যে চুরির জন্য বিশেষজ্ঞ সংগ্রাহককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কারণ সেগুলির অনন্য বিরলতার কারণে বইগুলি নিলাম করা অসম্ভব হবে। অ্যান্টিকোয়ারিয়ান বুকসেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রতিনিধি বলেছিলেন যে এই ধরণের ডাকাতি তাদের শিল্পের জন্য নজিরবিহীন।
এ যেন এক নিখুঁত ‘বুক হান্ট’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক সময়ের মতো এখানেও প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা দক্ষতার কাছে তাঁদের হার মানতেই হল। তদন্তকারী দলের প্রথমেই অনুমান করতে অসুবিধা হল না যে কোনও আন্তর্জাতিক দুষ্প্রাপ্য বইয়ের কালোবাজারি চক্র। বহু মাস পরে ধরা পড়েই গেলেন ড্যানিয়েল ও ভিক্টর। পরবর্তী তিন বছরে, পুলিশ তিনটি দেশে ৪৫টি অভিযান চালায়। গ্রামীণ রোমানিয়ার একটি বাড়ির মেঝের তলা থেকে ২০০টি দুষ্প্রাপ্য বই উদ্ধার হয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—হিথরোয় চুরি যাওয়া বইগুলোর সবগুলিই কি উদ্ধার হয়েছিল? নাকি কিছু এখনওছডড়িয়ে চলেছে ইউরোপের কোনও প্রাচীন সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে?
এই কাহিনি শুধু একটি চুরির গল্প নয়, বরং ইতিহাস-ভিত্তিক এক চমকপ্রদ থ্রিলার—যেখানে অস্ত্র নেই, রক্ত নেই, কিন্তু রয়েছে বুদ্ধির স্নায়ুযুদ্ধ, রহস্যময় বই, আর মানুষের লোভ ও সাহসিকতার অসীম মিশ্রণ। আপনারা এর পর যখন কোনও লাইব্রেরিতে প্রবেশ করবেন, একবার ভাবার চেষ্টা করবেন, সেই প্রাচীন বইগুলোর মধ্যে কোনওটি কি হিথরোর সেই নিঃশব্দ রাতের চিহ্ন বহন করছে?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন