বাংলা সাহিত্যের ৫টি আন্দোলন: হাংরি থেকে পত্রলেখা

সাহিত্যের ভিতর দিয়ে সমাজ ও চেতনার বিদ্রোহ: হাংরি আন্দোলন থেকে পত্রলেখা পর্যন্ত বাংলা কবিতা ও গল্পের পাঁচটি দিকচিহ্নকারী মোড়।

বাংলা সাহিত্যের ৫টি আন্দোলন: হাংরি থেকে পত্রলেখা


রাকেশ

বাংলা সাহিত্য মানেই শুধু ক্লাসিকের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং নিরন্তর এক আন্দোলনের মিছিল, সময় ও চেতনার অনবরত বিবর্তন। প্রতিটি যুগেই কিছু সাহসী কণ্ঠস্বর, কিছু বেপরোয়া কলম, কিছু বিদ্রোহী মঞ্চ বাংলা সাহিত্যকে তার কক্ষপথ থেকে টেনে এনেছে নতুন আলোয়, নতুন প্রশ্নে। সেই আন্দোলনগুলির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, বিতর্কিত ও প্রভাবশালী পাঁচটি হল—হাংরি আন্দোলন, নক্ষত্রবৃন্দ, কবিতা ক্যাম্প, কৃত্তিবাস এবং সাম্প্রতিক পত্রলেখা। এই আন্দোলনগুলির প্রতিটিই মূলস্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহিত্যের ভাষা, বিষয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গির ভিতরে বিপ্লব এনেছে।

১৯৬০-এর দশকে কলকাতার রাজপথ আর ক্যাফে হাউসের ভেতর থেকে উঠে আসা হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের স্থবিরতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। অগ্রজদের ক্ল্যাসিক ঘরানার বাইরে এসে তারা যে ভাষা, যে যন্ত্রণার ছবি এঁকেছিল, তা ছিল নগ্ন, আক্রমণাত্মক, এবং গভীরভাবে বাস্তব। মলয় রায়চৌধুরী, সামির রায়চৌধুরী, বসন্ত রায়—এইসব তরুণ কবি-লেখকেরা লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় রক্ত ঢেলেছিল কবিতায়। “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” যেন শুধু একটি কবিতাই নয়, গোটা প্রজন্মের আর্তনাদ হয়ে উঠেছিল। অশ্লীলতার অভিযোগ, গ্রেপ্তার, পুড়িয়ে দেওয়া পত্রিকা—সব মিলিয়ে হাংরি আন্দোলন যেন এক সাহিত্য-আন্দোলনের পোস্টার বালক হয়ে উঠেছিল।

এর ঠিক পরবর্তী দশকে গড়ে ওঠে নক্ষত্রবৃন্দ। হাংরির আত্মবিস্ফোরণের বিপরীতে এই আন্দোলন ছিল অনেক বেশি দার্শনিক, আত্মজিজ্ঞাসামূলক। তার ভাষা ছিল আরও ঋদ্ধ, গাঢ়, আর অন্তর্মুখী। তারা বাংলা কবিতার শরীরকে আধ্যাত্মিকতা ও নিঃসঙ্গতার একটি বিষণ্ন দীপ্তি দিয়েছিল। এই ধারার লেখায় মিশে গিয়েছিল উত্তর-আধুনিক মননের একান্ত যন্ত্রণা, যা রাজনীতি বা সমাজের রূঢ় বাস্তবতা থেকে নয়, বরং চেতনার গহিন অরণ্য থেকে উঠে আসত।

এরপর আসে কবিতা ক্যাম্প। এটি ছিল একধরনের প্রকাশ্য প্রতিরোধের মঞ্চ। যেখানে কবি ও পাঠকের দূরত্ব ঘুচে গিয়ে কবিতা হয়ে উঠেছিল জীবন্ত সংলাপ। মেট্রো চ্যানেল, কলেজ স্ট্রিট, কিংবা কফিহাউসের চত্বরে দাঁড়িয়ে পাঠ করা হতো তাৎক্ষণিক কবিতা, যা প্রতিক্রিয়া দিত রাজনৈতিক হিংসা, সামাজিক অবিচার, কিংবা ব্যক্তিগত রকমফেরের। কবিতা ক্যাম্প আন্দোলন যেন কবিতাকে বইয়ের পাতা থেকে তুলে এনে শহরের রাজপথে দাঁড় করিয়েছিল, যেখানে শব্দের গায়ে লেগে থাকত ট্র্যাফিকের ধুলো আর প্রতিবাদের ঘাম।

সত্তর ও আশির দশকে বাংলা কবিতার এক অনন্য ঠিকানা হয়ে উঠেছিল কৃত্তিবাস। অরুণ মিত্র, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিরা এই পত্রিকায় জড়ো হয়ে এক নতুন আধুনিকতাকে জন্ম দেন। তাঁদের কবিতা কখনও ব্যক্তিগত, কখনও রাজনৈতিক, কখনও নগরচেতনাসম্পন্ন, আবার কখনও একান্তভাবে অন্তর্মুখী। কৃত্তিবাস আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য ছিল, তা বাংলা কবিতাকে নাগরিক করে তুলেছিল; কবিতার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল রাস্তাঘাট, ট্রামলাইন, বিবাহবিচ্ছেদ, অফিসের ধোঁয়া আর রাত্রির একাকিত্ব। এই আন্দোলনের সুর ছিল একান্ত নিজস্ব, যাকে সোজা ভাষায় বলা যায়—নরম অথচ অস্থির।

সবশেষে আসে সাম্প্রতিক ‘পত্রলেখা’ আন্দোলন। যদিও এটি এখনও পরিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত নয়, তবু সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যেভাবে তরুণ লেখকেরা নিজেদের এক নতুন সাহিত্যের আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন, তাকেই অনেকেই আজ ‘পত্রলেখা আন্দোলন’ বলে চিহ্নিত করছেন। এই ধারার লেখায় মিশে থাকে ব্যক্তিগত যন্ত্রণার ডায়েরির গন্ধ, পপ সংস্কৃতির অনুরণন, এবং আন্তঃশরীরী টানাপোড়েনের খোলামেলা স্বীকারোক্তি। ছোট গল্প, কবিতা, স্মৃতিকথা—সব মিলিয়ে এটি একধরনের হাইব্রিড সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী কাঠামো থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে নেই পূর্বসূরির ছায়া, নেই গুরুগম্ভীর দায়বদ্ধতা। আছে কেবল নিজের কথা বলার এক অনর্গল ও নিজস্ব উচ্চারণ।

এই পাঁচটি আন্দোলনের ভিতর দিয়ে বাংলা সাহিত্য তার আত্মাকে পুনরাবিষ্কার করেছে বারবার। হাংরি আন্দোলন সাহিত্যের বুকে বোমা ফেলে দিয়েছিল, নক্ষত্রবৃন্দ সেই ধ্বংসস্তূপে বসে আত্মসন্ধান করেছিল, কবিতা ক্যাম্প শব্দকে রাস্তায় নামিয়েছিল, কৃত্তিবাস নাগরিক আত্মাকে কবিতায় প্রবেশ করিয়েছিল আর পত্রলেখা তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতাকে রূপ দিয়েছে সাহিত্যের নতুন রূপে। সাহিত্যের শরীরে এইসব আন্দোলন শুধু কালি ও কলম নয়, একেকটি ক্ষতচিহ্ন। সেই ক্ষতই সাহিত্যের জীবন্ত ইতিহাস।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন