বাংলা সাহিত্যে মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবন: না বলা যন্ত্রণা ও নীরব স্বপ্নভঙ্গ

মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবনের চুপচাপ যন্ত্রণা, অভিমান ও সীমাবদ্ধতা বাংলা সাহিত্যে কেমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—তা নিয়েই এই আত্মদর্শী ফিচার।

বাংলা সাহিত্যে মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবন: না বলা যন্ত্রণা ও নীরব স্বপ্নভঙ্গ

কে. দেবাশিস 

বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে যতটা কল্পনা ও ততটাই গ্লানি, ততটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ঠিক ততটাই অপূর্ণতা। সে শহরে হোক বা মফস্বলে, বাংলা সাহিত্য বারবার ফিরে গিয়েছে এই মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট স্বপ্ন, ভাঙা প্রত্যাশা, নিরব অভিমান ও চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া বেদনার দিকে। কিন্তু মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবন যেন আরও একধাপ নিঃসঙ্গ, আরও একধাপ নিঃশব্দ। তার বুকে বাস করে না কোনও বিপ্লব, তার মুখে নেই স্লোগান—সে শুধু নিজেকে ঠেকিয়ে রাখে, সমাজকে না বলে নীরবে হজম করে যায় গ্লানির ভার।

রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ অথবা শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’-তে আমরা মধ্যবিত্ত সংস্কারের ভেতর জন্মানো প্রেম ও প্রতিবাদের অঙ্কুর দেখি। কিন্তু সেই সময়েও শহরের তুলনায় মফস্বলের যন্ত্রণাকে সাহিত্যে স্থান দেওয়া হত অনেক বেশি আবেগ ও মমতার সঙ্গে। মফস্বলের মধ্যবিত্ত মানেই—আংশিক শিক্ষিত, সীমিত উপার্জন, রক্ষণশীল সমাজ, এবং সবচেয়ে বড় কথা, একধরনের নিরুত্তাপ বেঁচে থাকা, যেখানে চিৎকার নেই, কিন্তু হাহাকার অনেক।

বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’, বা বিমল করের ছোটগল্পগুলিতে আমরা এই মফস্বলের নীরব জীবন দেখি, যেখানে না আছে রাজনীতি, না আছে সেলিব্রিটি জৌলুস, আছে শুধু মধ্যবিত্তীয় হিসেব-নিকেশ আর অনিচ্ছায় বয়ে চলা জীবন। সন্ধ্যাবেলার খবরের কাগজ, শীতকালে সস্তা কম্বল, প্রতিবেশীর ঈর্ষা, সামান্য আত্মসম্মান—এই সবই মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক বদ্ধ জগৎ, যেখান থেকে পাঠক নিজেকে বের করে আনতে পারে না।

এই জীবনটিই পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুবোধ সরকারের কবিতা রূপ নেয় একধরনের নাগরিক বিষণ্ণতায়। কিন্তু মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবনের সংকোচ, তার সীমাবদ্ধতা, এবং নীরব চিৎকার অনেক সময়ই সাহিত্যের মূল প্রেক্ষাপটে আসে না—সে থেকে যায় ফাঁকে ফাঁকে, গৌণ চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ডে।

সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত ছোটগল্প ও স্বল্পপরিসরের উপন্যাসে, আবার ফিরে আসছে মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্র। পিতৃহীন পরিবারে বড় হওয়া ছেলেটির চোখ দিয়ে দেখা সমাজ, একা বৃদ্ধার রোজ সন্ধ্যার অপেক্ষা, অথবা বিবাহিত জীবনের খোলস গায়ে বয়ে বেড়ানো এক নারী—এইসব চিত্র সাহিত্যে যতই ফিরে আসুক না কেন, সেই যন্ত্রণাগুলো ঠিক ঠিক শোনা যায় না। কারণ, এই জীবন নিজেই কোনওদিন জোরে কিছু বলতে শেখেনি।

মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবন আসলে আত্মরক্ষার গল্প। সে নিজেকে আগুনে ফেলে না, শুধু আঁচে ঝলসে ওঠে। তার ছেলেমেয়েরা হয় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তাদের প্রথম প্রেমের গল্পটা হারিয়ে যায়। তার ঘরে আজও পুরনো থার্মাস, রেডিও, বাবার ছবি আর নীল ভাঙা ট্রাঙ্ক। সে বেঁচে থাকে, চুপ করে।

বাংলা সাহিত্য আজ যদি সত্যিই সমসাময়িক হতে চায়, তবে তাকে আবার ফিরে যেতে হবে এই চুপ করে বেঁচে থাকা, না বলা অভিমান, গোপন চাওয়া, এবং নীরব স্বপ্নভঙ্গের দিকে। কারণ এই মফস্বলীয় মধ্যবিত্ততা শুধুই আর্থিক বাস্তবতা নয়—এ এক মানসিক গঠন, যা ভাঙতে পারে না, কাঁদতেও পারে না।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন