Escape Plan : রাষ্ট্র ও ক্ষমতার সামনে মানুষের প্রতিরোধ কি?

আমরা প্রত্যেকে কোনও না কোনওভাবে এক অদৃশ্য জেলের মধ্যে বাস করি, এবং স্ট্যালোন আমাদের মনে করিয়ে দেন—শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব, পালানো সম্ভব, মুক্তিও সম্ভব। লিখছেন দেবাশিস কর্মকার

Escape Plan : রাষ্ট্র ও ক্ষমতার সামনে মানুষের প্রতিরোধ কি?
প্রতীকী ছবি

সিলভেস্টার স্ট্যালোন। নামটি উঠলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক কঠিন, জেদী, অদম্য মানুষের ছবি, যে বারবার দমে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ায়। ‘রকি’ আর ‘র‍্যাম্বো’-র পর স্ট্যালোন যখন হাজির হলেন বারবার জেলে যাওয়া আর জেল ভেঙে পালানোর চরিত্রে, তখন দর্শকের কাছে তিনি যেন নতুন এক ‘প্রতীক’ হয়ে উঠলেন। তাঁর সিনেমাগুলি— Escape Plan সিরিজ —কেবলমাত্র উত্তেজনাপূর্ণ থ্রিলার নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা, অন্যায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের দমননীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার প্রতীকী উপস্থাপনা।

প্রথম ছবি, Escape Plan (২০১৩), শুরু হয় রে ব্রেসলিনকে (স্ট্যালোন) নিয়ে, যিনি একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাজই হলো বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জেলগুলির দুর্বলতা খুঁজে বের করা। ছবির প্রথম দৃশ্যগুলিতেই আমরা দেখি কিভাবে ব্রেসলিন জেল থেকে পালিয়ে প্রমাণ করে দেন যে বন্দিদের মনস্তত্ত্ব ও কারাগারের গঠন দুটোকেই সমানভাবে বোঝা প্রয়োজন। এই চরিত্রটি আসলে একধরনের সামাজিক মন্তব্য—রাষ্ট্র যতই শৃঙ্খল ও নিয়মের বাঁধন শক্ত করুক না কেন, মানুষের মনের স্বাধীনতা ও বুদ্ধিমত্তাকে বন্দি করা যায় না।

কাহিনি মোড় নেয় যখন ব্রেসলিন নিজেই ফেঁসে যায় এক গোপন, সর্বোচ্চ সুরক্ষিত কারাগারে, যেখানে রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থ মিলে তৈরি করেছে ‘অদৃশ্য জেলখানা’। এখানে তাঁর সঙ্গী হন আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার অভিনীত চরিত্র। কারাগারের প্রতিটি দৃশ্য—লোহার দেওয়াল, নজরদারির ক্যামেরা, অদম্য রক্ষীদের শৃঙ্খল—প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক। আবার স্ট্যালোন ও তাঁর সঙ্গীরা যখন ফন্দি আঁটে, পথ খুঁজে বের করে পালিয়ে যায়, তখন তা প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় মানুষের অবিচল স্বাধীনচেতা সত্তার।

এরপর আসে Escape Plan 2: Hades (২০১৮) এবং Escape Plan 3: The Extractors (২০১৯)। দ্বিতীয় ছবিতে জেলখানার রূপ আরও ভয়ঙ্কর, যেন আধুনিক প্রযুক্তি ও অ্যালগরিদমের কারাগার, যেখানে বন্দিদের আচরণকেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ যেন একবিংশ শতকের সমাজের প্রতিচ্ছবি—মানুষ স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে কর্পোরেট ও রাষ্ট্রের প্রযুক্তিনির্ভর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তৃতীয় ছবিতে কাহিনি আরও আন্তর্জাতিক রূপ নেয়, যেখানে রাজনৈতিক বন্দি বিনিময়, কর্পোরেট ষড়যন্ত্র, এবং রাষ্ট্রের অমানবিক দিক ফুটে ওঠে।

স্ট্যালোনের এই বারবার জেল ভাঙা আর পালিয়ে যাওয়ার গল্পগুলি কেন এত জনপ্রিয় রয়ে গেছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে দর্শকের অবচেতন মনে। মানুষ সব সময়ই শৃঙ্খল ভাঙতে চায়—তা হোক রাজনৈতিক দমননীতি, সামাজিক কুসংস্কার, কিংবা কর্পোরেট আধিপত্য। জেলখানা এখানে কেবল কংক্রিটের দেওয়াল নয়; এটি প্রতীক—মানুষের জীবনকে ঘিরে থাকা সেই অদৃশ্য বেড়াজাল, যা ভাঙতে সবাই চায় কিন্তু পারে না। স্ট্যালোনের চরিত্র সেই অদম্য ইচ্ছার প্রতিফলন। তিনি বারবার বন্দি হন, যেমন সাধারণ মানুষ বারবার সমাজ, আইন, রাজনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বন্দি হয়। কিন্তু তিনি আবারও পালিয়ে যান, যেমন মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা মুক্তির স্বপ্ন কখনও নেভে না।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিনেমাগুলিকে দেখলে স্পষ্ট হয়, এগুলি নিছক অ্যাকশন-থ্রিলার নয়। এগুলি এক ধরনের বিদ্রোহের গল্প—রাষ্ট্র ও ক্ষমতার মুখে মানুষের প্রতিরোধের চিত্র। বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে শাসকশক্তি ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, তখন এই ছবিগুলি দর্শকদের মনে করিয়ে দেয় যে কোনও কারাগারই চিরস্থায়ী নয়, কোনও শৃঙ্খলই চিরঅটুট নয়।

আজও সিরিজটি জনপ্রিয় কারণ এটি কেবল রক্তগরম অ্যাকশন নয়, বরং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক মুক্তির কাহিনি। জেলখানা, বন্দিদশা, পালানোর পথ খোঁজা—সবই দর্শকের মনে জীবনের বাস্তব প্রশ্নগুলিকে উসকে দেয়। আমরা প্রত্যেকে কোনও না কোনওভাবে এক অদৃশ্য জেলের মধ্যে বাস করি, এবং স্ট্যালোন আমাদের মনে করিয়ে দেন—শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব, পালানো সম্ভব, মুক্তিও সম্ভব।

তাই বলা যায়, স্ট্যালোনের এই জেল ভাঙা ও পালানোর গল্প শুধু সিনেমার গল্প নয়, এটি মানুষের চিরন্তন সংগ্রাম ও স্বাধীনতার স্বপ্নের রূপক—যা কোনও সমাজে, কোনও রাজনীতিতেই অনন্তকাল ধরে প্রাসঙ্গিক।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন