রক্তবীজ ২ একটি চমৎকার রাজনৈতিক অ্যাকশান থ্রিলারে পরিণত হয়েছে। একটি নন-ফিকশন বই থেকে তথ্য নিয়ে এগিয়েছে চিত্রনাট্য। যার পরতে পরতে পরতে চমক। আসল গল্পটি আরও চমকপ্রদ।
আজই সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে বহু প্রতিক্ষীত ‘রক্তবীজ ২’। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের এই টানাটান চিত্রনাট্যের নেপথ্যে রয়েছে দুর্দান্ত একটি গল্প। সেটি রিয়াল। সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক ও প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ীর লেখা ‘‘প্রণব মুখার্জি- রাজনীতি ও কূটনীতি’ বইটির ছায়ায় তৈরি হয়েছে চিত্রনাট্য। তাঁর সঙ্গে কথা বলে অনেক না-জানা কথা জেনে এলেন শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী।
শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে রক্তবীজ ২। আপনার ‘প্রণব মুখার্জি- রাজনীতি ও কূটনীতি’ শীর্ষক বইটি থেকে অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে সিনেমায়। যোগাযোগ হল কীভাবে?
গৌতম লাহিড়ী: আমার বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৫-এর বইমেলায়। শান্তিনিকেতনের ডুংরি প্রকাশনির তরফে। তারপরই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর কনসাল্টিং এডিটর কুণাল ঘোষ যোগাযোগ করিয়ে দেন শিবপ্রসাদের সঙ্গে। সেই শুরু।
আপনি তো সিনেমাটির প্রথম দর্শক। উপলব্ধি কেমন?
উত্তর: অসাধারণ একটি সিনেমা পুজো উপহারে পেতে চলেছেন বাংলার দর্শক। আমার বিশ্বাস রক্তবীজের মতোই রক্তবীজ-২ দর্শকদের মন কেড়ে নেবে। এই সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই রয়েছে জঙ্গি দমনের মক ড্রিল। তারপরই দুই কলাকুশলী বলছেন, “ভারত- বাংলাদেশ যখনই কাছাকাছি এসেছে তখনই উগ্র সন্ত্রাসবাদীরা তৎপর হয়। এই দুজনের একজনকে দেখে মনে হয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এবং অন্যজন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখানেই চমক। সীমা বিশ্বাস ‘ফুলনদেবী’ ইমেজ কাটিয়ে প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় অসাধারণ।
আপনার বইয়ের তথ্য অবলম্বনে সিনেমাটি হয়েছে। একটু আভাস দিতে পারেন?
উত্তর: বইতে লিখেছিলাম, ‘মাইনাস টু’। রক্তবীজ ২-তে জঙ্গিদের অপারেশন ‘এম-২’। সেইসময়ে চট্টগ্রামের কাছে মাস্টারদা সূর্য সেনের ভিটেতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা জানানো বিকল্প বার্তা প্রদান। আমার লেখা বইটা ছিল মূলত, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চোখে বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাস। জিনিয়া সেন দক্ষতার সঙ্গে কাহিনিতে রূপান্তরিত করেছেন এবং টানটান উত্তেজনার চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। একটি চমৎকার রাজনৈতিক অ্যাকশান থ্রিলারে যা পরিণত হয়েছে। থ্রিলারের সঙ্গে রয়েছে নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা পঙ্কজ সিংহর সঙ্গে বাংলার এসপি সংযুক্তা চক্রবর্তীর ফ্রয়েডীয় প্রেম।
আপনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই বইটির সম্পদ। বিষয়টি যদি একটু ব্যাখ্যা করেন।
উত্তর: প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রথম বাংলাদেশ সফরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। সে সময় আমি সফরসঙ্গী ছিলাম। বিয়ের পর কখনও যাওয়া হয়নি রিলের রাষ্ট্রপতি অনিমেষ চ্যাটার্জীর। ঠিক যেমনটি রিয়েলের প্রণববাবুর ক্ষেত্রে। জামাই আদরের চিত্র স্পষ্ট হল ‘রক্তবীজ ২’ তে। বাংলাদেশের নড়াইলে প্রণববাবুর শ্বশুরবাড়ি। এখানে ভিন্ন নাম। জামাই দ্বিরাগমনের সময় যেমন আঙিনায় রঙিন মণ্ডপ হয়েছিল এখানেও সেই দৃশ্য। জামাই বরণের জন্য পিঠা, ইলিশের ভুরিভোজ। আবার, পদ্মাপারে পেঁয়াজ ছাড়া ইলিশ রান্নার অর্ডার গোয়েন্দাদের। ফিল্মটির অন্তর্নিহিত বার্তা অবশ্যই ভারত বাংলাদেশের অটুট মৈত্রী।
আসলে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ‘জুলাই বিপ্লব’-এর আগে প্রতি বছর বাংলাদেশ ঘুরেছি। মানুষের মন বুঝতে হেঁটে প্রত্যন্ত প্রান্তে গিয়েছি। এমনকী, বঙ্গোপসাগরের উপর শেষ ভূখণ্ডে গিয়েছি। যেখানে এখনও বহু বাংলাদেশি যাননি। সোনার চর। যেখানে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত একই জায়গা থেকে দেখা যায়।
আপনার সঙ্গে প্রণববাবুর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। সে বিষয় যদি একটু বলেন। বই লেখার ভাবনা কীভাবে এল?
উত্তর: আমি প্রণববাবুর সঙ্গে বাংলাদেশ সফর করেছি। যতবার উনি গিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি হিসাবে। এমনকী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসাবেও। কখনও ভাবিনি বই লিখব। তবে সব কিছুই মনের স্মৃতিকথায় রেখেছিলাম। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, সেনা গোয়েন্দা, পুলিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথা হত।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই কুণাল ঘোষের কথা বলতে হবে। ওঁর আগ্রহেই এক সময় লেখা শুরু করেছিলাম প্রণব মুখোপাধ্যায় কেন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। কীভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন বাংলাদেশে। আরও একটা বিষয়, দিল্লিতে তখন বাংলাদেশ হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি। উনি মুজতবা আলির ভ্রাতুষ্পুত্র। আর বাংলাদেশের সমকাল পত্রিকার পুরস্কারপ্রাপ্ত সম্পাদক (প্রয়াত) গোলাম সরওয়ার। দু’জনেই পরামর্শ দিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় কীভাবে বাংলাদেশ হ্যান্ডেল করেছেন সেই বিষয়ে যদি লিখি। এভাবেই শুরু হল।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ীর আলাপচারিতার কিছু কথা যদি বলেন।
উত্তর: দিল্লিতে নিত্যদিন তালকোটরা রোডের বাংলোয় গভীর রাতে গপ্পো করার রেওয়াজ ছিল। অনেক নেতার ফোন আসত। বা উনি কথা বলতেন। বিশ্বাস করতেন, তাই সে সব কথা বাইরে বলব না। শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেতারা ফোন করতেন। ইন্দিরা গান্ধী ওঁকে (প্রণববাবুকে) বাংলাদেশের অভিভাবক করেছিলেন। অনেক সময় প্রণববাবু ব্যস্ত থাকতেন। বৌদির সঙ্গে কথা বলতাম। উনি বাংলাদেশেরই। সেটাও জেনেছিলাম তখনই। গল্পের ফাঁকে। ইন্দিরা গান্ধী বৌদির হাতের রান্না খেতে ভালবাসতেন। পছন্দ করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেই সব টুকরো টুকরো স্মৃতির মালা গেঁথেছি বইতে।
প্রণববাবু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি কিছু গোপন তথ্য জানাবেন। কোভিড মহামারির সময় টেলিফোন কথা বলতে হত। অনেক সময় বলতে চাইতেন না। বলতেন, চলে আয়। সামনাসামনি বলব। ঝুঁকি নিয়ে একদিন বা দু’দিন গেছিলামও। ওপার বাংলা-এপার বাংলা অশান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ (যার উপর রক্তবীজ ), কলকাতায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা– এসব অশনি সংকেত। আরও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হল। অনেক তথ্য অজানা থেকে গিয়েছে। সেই কারণে ফিল্মে যেমন গল্প প্রকৃত বাস্তবের থেকে ভিন্ন হয়, তেমনই আমার লেখাটাও সবটাই প্রণববাবুর দেওয়া তথ্য নয়। আমার রাজনৈতিক পুস্তকও বটে।
বাংলাদেশ-রক্তবীজ-২ এই দুটি বিষয়কে কীভাবে মেলাবেন?
উত্তর: সিনেমায় দেখানো হয়েছে গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে সীমান্তপারের গভীর চক্রান্ত। ব্যাপ্তি ভারত বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত। কীভাবে ‘জেন জি’-কে ব্রেইন ওয়াশ করা হয় তার নিখুঁত বর্ণনাও রয়েছে। শিক্ষিত চিকিৎসক মুনির কীভাবে জঙ্গি হল। কেন হল? জঙ্গি সংগঠনের শাখা প্রশাখা কীভাবে বাংলার মাটিতে ডাল পালা ছড়াল? কিয়েভে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া প্রেমিকার সঙ্গে গভীর প্রেমের পরেও আদর্শগত কারণে বিচ্ছেদ। মৃত্যুর পর মিলন। ভিলেনের মুখে, ‘মানুষের থেকে মকসদ বড়’। হিংসার আবর্তে ‘শান্তির বাণী’ হয়ে এসেছে কবিগুরুর ‘বরিষ ধারা’। প্রথমে বাংলাদেশ পুলিশ ভারতের ‘দাদাগিরি’ ভাবলেও পরে ভারত-বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গি মুনির আলমের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে হাত মিলিয়েছে। ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ম্যাচের মধ্যে তারা সফল হলেন কি? আকাশচুম্বী ট্রলির উপর রোমহর্ষক ফাইট। সিনেমাটি দেখতে বসলে উঠতে পারবেন না, এটা গ্যারান্টি। একই সঙ্গে মনে হবে, যা ঘটছে ইদানিং, তার পৃষ্ঠভূমি উজাড় করে দিয়েছে রক্তবীজ ২।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন