বিশ্বসাহিত্যে নিশ্বব্দ বিপ্লব: ছোট ভাষার সাহিত্য কেন এখন বিশ্বমঞ্চে?

যে বিপ্লবে অস্ত্র নেই, নেই বলপ্রয়োগ, আছে কেবল শব্দের শক্তি, সংস্কৃতির গভীরতা এবং অনুবাদের অনন্ত সম্ভাবনা।

বিশ্বসাহিত্যে নিশ্বব্দ বিপ্লব: ছোট ভাষার সাহিত্য কেন এখন বিশ্বমঞ্চে?

দেবাশিস কর্মকার

বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্র কয়েক দশক আগেও ছিল এককেন্দ্রিক, ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ কিংবা জার্মান ভাষার লেখকরাই তখন বৈশ্বিক পুঁজির দরজায় প্রবেশাধিকার পেতেন। কিন্তু গত দশ বছরে বিশ্বসাহিত্যের ভূকম্পন এমন ভাবে বদলে গেল যে মেইনস্ট্রিমের পুরনো ঘরানাগুলো প্রায় স্তব্ধ হয়ে রইল আর ছোট ভাষার সাহিত্য ক্রমে উঠে এল আলোচনার শীর্ষে। এখন আন্তর্জাতিক বুকারের লংলিস্ট বা শর্টলিস্ট দেখলে চোখে পড়ে—যেসব ভাষার নাম আমরা পাঠ্যবই ছাড়া কোথাও শুনিনি, সেখান থেকেই উঠে আসছে নতুন কণ্ঠস্বর, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন বয়ানে সাজানো বিশ্বমানের সাহিত্য। কানাড়া, বাংলা, কোরিয়ান, আরবি, কাতালান, জর্জিয়ান, স্লোভেন, বাস্ক—এই ভাষাগুলো আজ সেই মহানগরের সাহিত্যদেহে নিজস্ব রঙ ঢেলে দিচ্ছে, যেখানে দীর্ঘদিন শুধু ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাবই সগৌরবে দাঁড়িয়েছিল। এই বদলে যাওয়া সময়টিকে অনেক সমালোচক বলছেন, ‘বিশ্বসাহিত্যের নিশব্দ বিপ্লব’—যে বিপ্লবে অস্ত্র নেই, নেই বলপ্রয়োগ, আছে কেবল শব্দের শক্তি, সংস্কৃতির গভীরতা এবং অনুবাদের অনন্ত সম্ভাবনা।

এই বিপ্লবের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল অনুবাদকেন্দ্রিক সাহিত্যবাজারের দ্রুত উত্থান। এতদিন আন্তর্জাতিক পুরস্কারগুলিতে অনুবাদের স্থানে ছিল প্রায় প্রতীকী এক সম্মান, কিন্তু আজ অনুবাদকের নাম বইয়ের মলাটে পাশাপাশি প্রকাশ পাচ্ছে, পুরস্কারের অর্থে সমান ভাগ পাচ্ছেন, এবং সাহিত্যসমালোচনার আলোচনায় অনুবাদকদের ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অনুবাদই যেন হয়ে উঠেছে ছোট ভাষাগুলোর আন্তর্জাতিক মুদ্রা—এক প্রকার সমতার দরজা—যার মাধ্যমে যে কোনও ভাষা, যতই অল্পবিস্তর পাঠক থাকুক না কেন, বিশ্ববাজারের দৃষ্টি কাড়তে পারে। অনুবাদ ছাড়া বিশ্বসাহিত্যের এই বৈচিত্র্য কোনওদিনই দৃশ্যমান হত না। আগেকার অনুবাদকরা ছিলেন ‘অদৃশ্য শ্রমিক’, আজ তাঁরা নিজেরাই লেখকের সমান শক্তিশালী সৃজনশিল্পী।

কানাড়া সাহিত্য তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কানাড়া ভাষা আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে প্রায় অচেনা ছিল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল ব্যতীত ভারতীয় সাহিত্য বিশ্বমঞ্চে তেমনভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। কিন্তু কানাড়া লেখকদের নতুন প্রজন্ম—গ্রামীণ মনস্তত্ত্ব, ধর্ম ও রাজনীতির উথালপাথাল, আধুনিকতার সংকট—এসবকে এমন নতুন বয়ানের মধ্যে আনছে যা ইউরোপ-আমেরিকার পাঠক আজ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করছে। তাদের গল্পের মানবিকতা, ভাষার আঞ্চলিক স্বাদ আর চরিত্রের বহুমাত্রিকতায় আন্তর্জাতিক সমাজ এক নতুন সত্তা আবিষ্কার করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দক্ষ অনুবাদকদের হাত, যারা স্থানীয় শব্দ, লোকজ বাঁচনভঙ্গি, ধর্মীয়-মিথিকাল প্রতীক—সবকিছুকে রূপান্তর করতে পেরেছেন এমনভাবে যে বিদেশি পাঠক কোনও দূরত্ব অনুভব করেন না।

কোরিয়ান সাহিত্যও আজ আর কোনও ‘এশিয়ান বিভাগ’-এর অংশ নয়—এটি আজ বিশ্ব সাহিত্যের কেন্দ্রে। মানুষের ভেতরের একাকিত্ব, প্রযুক্তির আগ্রাসন, সমাজের নিঃশব্দ চাপ, নারী-অভিজ্ঞতার অনন্য সূক্ষ্মতা—কোরিয়ান বইগুলির বয়ান বিশ্বজুড়ে এক অদ্ভুত সমকালীনতা তৈরি করেছে। শুধু জনপ্রিয় হওয়া নয়, কোরিয়ান লেখকরা সাহিত্যে এক বিশেষ দার্শনিক গভীরতা আনছেন যা পশ্চিমী বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে—বিশেষত ব্যক্তির ভেতরের অন্ধকার ও শূন্যতা বিষয়ে।

আরবি সাহিত্যও এবার নতুন করে বিশ্বমঞ্চে শোনা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে থেকেও লেখকরা যে ভয়হীনভাবে নিজেরা লিখছেন, তা আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে এক অদ্ভুত কৌতূহল ও শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, ধর্মীয় সংঘাত, নারীর শরীর ও স্বাধীনতা, যুদ্ধ-পরবর্তী ট্রমা—সবই আরবি সাহিত্যে নতুন করে উঠে আসছে। অনুবাদ এই সবকিছুকে এক বৈশ্বিক পাঠের জন্য খুলে দিচ্ছে, যার ফলে ছোট ভাষার অভিজ্ঞতা আজ হয়ে উঠছে মানবজাতির অভিজ্ঞতা।

কাতালান, জর্জিয়ান ও আর্মেনীয় সাহিত্যও একই রকম এক ছন্দ মেনে বাড়ছে। ভাষাগতভাবে বিচ্ছিন্ন, সাংস্কৃতিকভাবে অনন্য, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল—এই অঞ্চলগুলোর সাহিত্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক নতুন করে সভ্যতার চিত্র আঁকছে। কাতালান গল্পগুলো সামাজিক পরিবর্তন, স্বাধীনতার রাজনীতি, ব্যক্তিগত শিকড়ের সন্ধান—এসব দিয়ে নতুন পাঠ জাগাচ্ছে। জর্জিয়ান সাহিত্য সেই দ্বন্দ্বকে সামনে আনে, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা ক্রমে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করে। আর্মেনীয়রা লিখছেন ইতিহাসের অন্ধকার নাড়িভুঁড়ি ছুঁয়ে, যা মানবসভ্যতার অপরাধবোধকে জাগিয়ে দেয়।

বিশ্বের সাহিত্যপ্রবাহের এই পরিবর্তন আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রবণতায়। আগেকার ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন বা প্যারিস বইমেলায় বড় ভাষার প্রকাশকরা ছিল প্রধান আকর্ষণ। ছোট ভাষার স্টলগুলো ছিল একধরনের ‘সাংস্কৃতিক সমীকরণ বজায় রাখা’র জন্য রাখা আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী। এখন সেই ছবিই বদলে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বইমেলায় ছোট ভাষার সাহিত্য নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে বহুগুণ। প্রকাশকরা অচেনা দেশের সাহিত্য খুঁজে বের করছেন যেন নতুন খনিজের সন্ধান। পাঠকের আগ্রহও আশ্চর্যভাবে বদলে গিয়েছে—মানুষ এখন অন্য সমাজের কষ্ট, সংগ্রাম, প্রেম-অনুভূতি, ভয়ের বৃত্ত—এসব জানতে চায় ভিন্ন ভাষার বয়ানের মাধ্যমে। একদম দেশজ অভিজ্ঞতা—যেমন বাংলার নদী-বিল, কানাড়ার গ্রাম-মঠ, কোরিয়ার নগর-নীরবতা, আরব মরুভূমির শ্বাসরুদ্ধ রাজনীতি—এসবই এখন বৈশ্বিক পাঠের অংশ হয়ে উঠছে।

এই আগ্রহের পিছনে আছে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ। বিশ্ব এখন দ্রুত জমাট বাঁধছে, মানুষ একই ধরনের বিনোদন, একই ধরনের রাজনীতি, একই ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে বদ্ধ। এই সমরূপতার ক্লান্তিতে পাঠক চায় ভিন্নতাকে খুঁজে পেতে। ছোট ভাষার সাহিত্য সেই ভিন্নতাকে উপহার দিচ্ছে। যেসব গল্প বড় ভাষার কেন্দ্রীভূত সংস্কৃতিতে হারিয়ে যায়, সেসব গল্প ছোট ভাষার লেখকরা নিষ্ঠার সঙ্গে, স্থানীয় অভিজ্ঞতার গভীরতা নিয়ে লিখে যাচ্ছেন—এবং ঠিক সেই স্থানিকতাই আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে এক অনন্য আকর্ষণ হয়ে উঠছে।

এই নীরব বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—ছোট ভাষার লেখকরা ক্রমশ ‘বিশ্বায়িত ব্যাকরণ’ অস্বীকার করে নিজেদের ভাষা ও বয়ানকে সামনে এনে দিচ্ছেন। তারা ইংরেজি বা ফরাসি সাহিত্যধারার অনুকরণ করার চেয়ে বরং নিজের ভাষার স্বর, মাটি, শব্দের স্বাদ—সবই জোরালোভাবে তুলে ধরছেন। এই আত্মবিশ্বাসটিই বড় বদল। আন্তর্জাতিক সাহিত্যবিশ্বে আর উপনিবেশোত্তর লজ্জা নেই, নেই অজানা ভাষার জড়তা। বরং এই বইগুলো এখন পড়া হচ্ছে গবেষণায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে, উৎসবে এবং পুরস্কার মঞ্চে—ঠিক যে জায়গাগুলিতে আগে শুধুই পশ্চিমের সাহিত্যই প্রকাশ পেত।

বাংলা সাহিত্যের সামনে এই পরিবর্তন বড় সুযোগ ও বড় চ্যালেঞ্জ দু’টিই নিয়ে এসেছে। বাংলা ভাষার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, লোকজ অভিজ্ঞতা, নদী-বেষ্টিত ভূগোল ও জনজীবনের বহুবর্ণতা আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্য এখনও বিশ্ববাজারে যে জায়গাটি পাওয়ার কথা, সেখানে পৌঁছাতে পারেনি পুরোপুরি। তার প্রধান কারণ অনুবাদের সীমাবদ্ধতা। এখনও খুব কম সংখ্যক বাংলা বই উচ্চমানের ইংরেজি বা ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। অনুবাদে তহবিলের অভাব, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের ঘাটতি, দক্ষ অনুবাদক গড়ে না ওঠা—এসবই বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিকে একটি ছোট বৃত্তের মধ্যে আটকে রাখে।

তবুও আশার আলো রয়েছে। গত কয়েক বছরে কলকাতা ও ঢাকা—দুই বাংলাতেই তরুণ অনুবাদকরা উঠে আসছেন, যাদের অনুবাদ আন্তর্জাতিক মানের। পাশাপাশি বইমেলায় বিদেশি প্রকাশকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ বেড়েছে। ডিজিটাল প্রকাশনা ও স্বতন্ত্র অনুবাদ ল্যাবগুলো তৈরি হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—বাংলা লেখকরা এখন নিজের ভাষার গৌরব নিয়ে লিখছেন, এবং অনেকেই জানেন যে বিশ্ববাজার তাদের দরজা খুলে দেবে অনুবাদের মাধ্যমেই। বাংলা সাহিত্য যদি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, তবে কলকাতা ও ঢাকা দুই শহরই পরবর্তী দশকে বিশ্বের সাহিত্যমানচিত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

বিশ্বসাহিত্যের এই নীরব বিপ্লব মূলত মানবসভ্যতার ভেতরকার একটি পরিবর্তনকেই প্রতিফলিত করে—এখন আর সাহিত্য কোনও নির্দিষ্ট মহাদেশের একাধিকার নয়। মানুষ আজ পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকে, প্রতিটি ভাষা থেকে, প্রতিটি সংস্কৃতির গভীরতম মর্ম থেকে গল্প শুনতে চায়। ছোট ভাষাগুলো এই অনুভূতিরই অমূল্য ভাণ্ডার। তাই ভবিষ্যতের সাহিত্য হবে আরও বহুস্তরীয়, বহুভাষিক, বহুপরিচয়ের। আর এই বহুত্বের ভেতরই লুকিয়ে আছে মানবতার প্রকৃত সৌন্দর্য—যা হয়তো কোনওদিন বড় ভাষার সাম্রাজ্য কখনও দিতে পারত না। ছোট ভাষার গল্পগুলোই আজ বিশ্বকে বলছে—প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতার ভেতরেই থাকে এক সমগ্র পৃথিবীর প্রতিধ্বনি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন